বাংলাদেশে দ্বৈত পরিচয়ধারী মানুষ খুব বেশী নেই। তবে জনাব শিহাব হাসান বহু দিন ধরেই সমাজে দ্বৈত সত্তা বিরাজ করে চলেছেন।
শিহাব পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি অল্প বয়সেই নিজ বুদ্ধি, পরিশ্রম এবং সুবিবেচনার মাধ্যমে আজ সুপরিচিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে ওনার বাবার মৃত্যুর পরে যখন তিনি ব্যবসার কাণ্ডারি সামলানোর কাজে নেমে পড়েন, তখন তিনি টগবগে যুবক।
যাইহোক, নীলা সুলতানার সাথে শিহাবের বিয়েটা বেশ ধুমধাম করেই হয়। প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে সে বিয়েতে। খরচ করতে মোটেও কার্পণ্য করেনি বড় এবং কনে পক্ষ। সুস্বাদু নানা পদের খাবারের স্বাদ নিয়ে অতিথিরা বেজায় খুশী।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে বিয়েটি বেশী দিন টিকেনি। শিহাবের ঘরে নীলার সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করেনি, কোনও দিক থেকে কোনও রকম অভাব অনটনেও তাকে পড়তে হয়নি। তরমুজের ঠিক মাঝখানে দা দিয়ে কোপ দিলে যেমন সহজেই দুই ভাগ হয়, ঠিক তেমনি অদৃষ্টের নিষ্ঠুর কোপে দুটি হৃদয় তিন মাসের মাথায় আলাদা হয়ে যায়।
আসলে নীলার আগে থেকেই একজন প্রেমিক ছিল, বিয়েটা নাকি সে বাবা মার জোরাজোরিতে করেছে। সোজা কথায় বললে বলতে হয় যে তার অমতেই বিয়েটা হয়েছে। বিয়ের পরও নীলা সেই ছেলেটিকে ভুলতে পারেনি। শিহাব যখন ঘরের বাইরে যায়, নীলা তখন সেই ছেলেটির সাথে কথা বলে।
একদিন শিহাব নীলাকে হাতেনাতে কথা বলা অবস্থায় ধরে ফেলে। যার ফলে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হয়। শিহাব রেগে পাকা মরিচের মত লাল হয়ে যায়। অন্যদিকে নীলাও ছেড়ে কথা বলেনি। সে বলেছে যে সে তালাক চায়- এই বলে সে তার মায়ের বাসায় চলে যায়।
শিহাব তার মা নুসরাত জাহানের সাথে পরামর্শ করে তালাকের কাগজ পাঠিয়ে দেয়ার ফলে খুব দ্রুতই তালাকটি সম্পন্ন হয়। এ ঘটনার পর শিহাব কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। আগের প্রাণচাঞ্চল্য এবং হাসিখুশী ভাব তার নেই। সারাক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে ঘরের মধ্যে কুনো ব্যাঙের মত পড়ে থাকে।
নুসরাত অনেকবার বুঝানোর পরও শিহাবের আচার আচরণে কোনও পরিবর্তন আসে না। মা ছেলেকে যখনই দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেন, ছেলে এমনভাবে রাগান্বিত হয় যেন কেউ তার চুল ধরে খুব জোরে টান দিয়েছে!
যাইহোক, রোড রোলারের মত সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে একদিন শিহাব একা ট্রেনে চেপে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়। এমন নয় যে সিলেটে তার পরিচিত কেউ আছে, শুধু খামখেয়ালীর বশে শিহাব এ কাজটি করে।
সেই ট্রেন যাত্রা তার জীবনটাকে আমুল পাল্টে দেয়। একজন ভালো শিক্ষক যেমন ছাত্রদেরকে পথের দিশা দেখায় ঠিক তেমন পথের দেখা পেয়ে যায় সে। যাত্রার সময়টাতে বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে তার কথা হয়। যে আসনটিতে শিহাব বসেছে, তার পাশের আসনে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসা। ওনার সাথে অনেক কথা হয়।
একপর্যায়ে বাদামওয়ালা ‘বাদাম বাদাম’ বলে ডাকতেই শিহাব পাঁচ টাকার বাদাম কিনে নেয়। পাশে বসা ভদ্রলোককেও সৌজন্যমুলকভাবে কিছু বাদাম দেয়। চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখার অভিজ্ঞতা তার কাছে অসাধারণ লাগে; যেন স্বর্গীয় অনুভূতি! অদূরে এক ঘর্মাক্ত কৃষক পাকা ধান কাটছে; শিহাব সেই কৃষকের স্বপ্ন নিয়ে ভাবে, তার পরিবার নিয়ে ভাবে; ট্রেন যখন নদীর উপরের একটি সেতু দিয়ে প্রচণ্ড আওয়াজ করে যেতে থাকে, তখন নদীতে বিশাল জাল ছড়িয়ে বসে থাকা রোদে পোড়া একজন মানুষকে দেখে সে পুলকিত হয়। কিছু ছোট ছোট ছেলে মেয়ের দল ট্রেনের সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে; সবার মুখে নিষ্পাপ হাসির ছটা লেগে আছে; সবাই যেন আজ বিদ্যুতের বেগে চলতে থাকা ট্রেনকে পেছনে ফেলে জয়ী হবে! শিহাব ট্রেনের জানালায় হাতের উপর মুখটা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে; সুমিষ্ট বাতাসের ঝাপটা এসে তার গালে যেন চুমু খেয়ে যায়; বাতাসে তার আঁচড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হতে থাকে; যেন বাতাস আর চুলের এক রহস্যময় খেলা! শিহাব ভাবে- ঢাকার ব্যস্ত ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে জীবন নেই; জীবন যেন ঠিক এখানে। এই মুহূর্তে!
শিহাব আগেও অনেকবার ট্রেনে যাতায়াত করেছে কিন্তু এবারকার যাত্রা যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম! আসলে নীলা চলে যাবার পর থেকে শিহাবের মনোজগতে ঘূর্ণিঝড়ের মত যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, শিহাব সে দুঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি পাবার একটি উপায় খুঁজে পেয়েছে যেন!
পুণ্যভূমি সিলেটের মাটিতে পা রেখেই শিহাব বন্ধ করে রাখা মোবাইলটা চালু করে। যাত্রাকালীন সময়ে ফোনটা ইচ্ছে করেই বন্ধ রেখেছে কারণ সে জানে যে তার মা ফোন দিতে তার রোমাঞ্চের আমেজটাই মাটি করে দেবে। মাকে ফোন দিয়ে শিহাব,
- মা!
- কিরে! তুই কোথায় বাবা?
- আছি ঠিকমত, চিন্তা করো না।
- কোথায় আছিস বলবি তো নাকি!
- সিলেটে।
- সিলেটে! সেখানে কেন? আর যাবিই যখন আমাকে বলে যাবি না!
- বলা হয়নি আর কি।
- আচ্ছা তুই কি দিনে দিনে পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি?
- কি যে বল না মা!
- এ কেমন ব্যাপার! কথা নেই বার্তা নেই সিলেটে গিয়ে হাজির! ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিস।
- আচ্ছা সরি মা!
- আমি তোকে ফোনে না পেয়ে তোর বন্ধুদেরকে ফোন করতে করতে হয়রান হয়ে গেছি! তোর ফোন না পেলে আমি কিছুক্ষণ পরেই পুলিশে খবর দিতাম!
- এখন আর চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। দু একদিন এখানে থেকে ঢাকায় ফিরব।
- কোথায় থাকবি?
- হোটেলে উঠবো।
- ঠিক আছে, খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করিস।
- করব মা।
- আরেকটা ব্যাপার!
- কি?
- কথা দে তুই ফোনটা আর বন্ধ রাখবি না।
- আচ্ছা মা, কথা দিলাম। এখন রাখি। আল্লাহ হাফেজ।
- ভালো থাকিস বাবা। আল্লাহ হাফেজ।
সেই থেকে শিহাবের দ্বৈত সত্তার শুরু। যেন তার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে! বাসায় ফেরার পথেও একই রকম মুগ্ধতা তাকে জাদুর মত গ্রাস করে! তার দুই পা যখন বাড়ির উঠানে পড়ে, মা নুসরাত তখন বাচ্চার মত দৌড়ে এসে তাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরেন। শিহাবের কপালে এবং গালে চুমু খেতে থাকেন।
কয়েকদিন পর, নুসরাত শিহাবকে আবারো দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে চাপ দিতে থাকেন। ওনার জানা ছিল যে ছেলে এত সহজে রাজী হবার মানুষ নয়। কিন্তু ওনাকে অবাক করে দিয়ে শিহাব বিয়েতে মত দেয়! শুধু তাই না, সে মাকে বলে যে তিনি যে মেয়েকে যোগ্য হিসেবে পছন্দ করবেন, তাকেই সে বিয়ে করবে।
অতি দ্রুততার সাথেই দ্বিতীয় বিয়েটা হয়ে যায়। প্রথমবারের মত এত ধুমধাম করে না হলেও সবকিছু ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়। কনের নাম রোকেয়া আমীন; সে সবেমাত্র অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেছে। রোকেয়ার পিতা সিরাজ উদ্দীন একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল এবং ওনার স্ত্রী তাহেরা বানু একজন গৃহিণী।
বউ হিসেবে রোকেয়া খুব সুন্দরী না হলেও তাকে দেখে মায়া লাগে। তার চোখ দুটো হরিণের মত টানা টানা। সেই চোখ যেন কথা বলে! যাইহোক, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই রোকেয়া তার নতুন পরিবারের সাথে সম্পূর্ণরূপে মানিয়ে নিয়েছে। সকলেই তার ব্যবহারে এবং কাজে কর্মে মুগ্ধ।
শিহাব অবশ্য তার নতুন সত্তা সম্পর্কে রোকেয়ার কাছে কিছুই লুকায়নি। সে বলেছে যে যদি রোকেয়ার কোনও সমস্যা না থাকে তবে তাদের এ জুটি কেউ কোনও দিন ভাঙতে পারবে না। শিহাব তাকে এও বলে যে তার সকল সাধ আহ্লাদ ও স্বপ্ন সে একে একে পূরণ করবে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্বামী হিসেবে নিজেকে তার সামনে উপস্থাপন করবে যদি রোকেয়া তার পাশে ছায়ার মত থাকে।
রোকেয়াও কথা দেয়; সে বুঝে গেছে যে প্রায়ই শিহাবের একা একা এরকম ঘুরতে যাওয়াটা তার শরীরের একটি অঙ্গের মত হয়ে গেছে। এটি থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা মানে তার শরীর থেকে একটি অঙ্গ কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
এভাবে চলতে চলতে সংসার নামক দুনিয়ায় কখন যে পঁচিশটি বছর কেটে গেছে তা যেন কেউই টের পায়নি! রোকেয়া তার কথা রেখেছে; সে আছে এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত থাকবে। শিহাবও প্রমাণ করেছে যে সে পৃথিবীর সর্বোত্তম স্বামী!
এক হাতে যেমন তালি বাজে না ঠিক তেমনি দুই মনের মিলন না হলে সম্পর্ক টেকে না। এক হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয় ঠিক তেমনি পৃথিবীতে একেক মানুষ একেক রকম। কোনও মানুষের চিন্তা চেতনা কিংবা আচার আচরণ একটি ভিন্ন ধরণের হলেই তাকে আবর্জনার মত অবজ্ঞা বা ঘৃণা করে দূরে ঠেলে না দিয়ে তার মনটাকে বোঝার চেষ্টা করা এবং তাকে ভালোবাসার ছোঁয়ায় কাছে টেনে নেয়াই অনেক বেশী মানবিক।