৫০০ টাকা = একটি নবজাতক শিশু! [Bangla Story]

করিম মিয়ার তিন সন্তান। রুনা, সেলিনা এবং জাবেদ। তার স্ত্রী জরিনা বেগমের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। যে কোনও দিন পরপারে চলে যেতে পারে। তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে জরিনার পেটে ভূমিষ্ঠ হবার অপেক্ষায় থাকা চার নম্বর সন্তান।

 

করিম রিক্সা চালিয়ে যা পায় তাতে সংসার চলে না বললেই চলে। রুনা এবং সেলিনা অন্যের ঘরে কাজ করে। তারা যে সামান্য কটা টাকা পায় তার সানন্দে মায়ের হাতে তুলে দেয়।

 

জাবেদের বয়স মাত্র তিন বছর। সে সারাক্ষণ তার মায়ের আশেপাশেই লাটিমের মত ঘুরঘুর করে! যেদিন করিম অসুস্থ বোধ করে, সেদিন ঘরে খাবার দাবারের ব্যবস্থা করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।    

 

এমনও অনেক দিন গেছে যখন রুনা এবং সেলিনা অদূরের ডোবার পাশে জন্মে থাকা কচু গাছের লতি সংগ্রহ করে আনে। যখন ওরা পুকুর পারে কলমি শাক দেখতে পায়, তখন তাদের খুশীর বাঁধ ভেঙ্গে যায়! তুচ্ছ কলমি শাক যেন তাদের কাছে কোরমা পোলাওয়ের চেয়ে কম নয়!

 

যাইহোক, দিন যত যায়, করিম এবং জরিনার দুশ্চিন্তা ততই বাড়তে থাকে। বলাই বাহুল্য যে বর্তমানে সকলের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দেবার সামর্থ্য করিমের নেই, সেই অবস্থায় আরেকজন সদস্যের আগমন ক্ষণে সে এবং জরিনা কেউই আনন্দিত বোধ করতে পারছে না।

 

চতুর্থ সন্তান নেয়ার ব্যাপারে জরিনার কোনও নিষেধেই করিম বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। এ কারণে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে জরিনা করিমের সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে বললেই চলে।

 

শুরুতে করিম ভেবেছিল আরেকটি সন্তানের ভরণপোষণ করাটা খুব একটা সমস্যা হবে না, কিন্তু এখন সে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে; তাইতো বুদ্ধিমানেরা বলেন, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না

 

অবশেষে জরিনা একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। সেলিনা এবং রুনা খুব খুশী কিন্তু করিম এবং জরিনার মনে আনন্দের ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে।

 

সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ছেলের নাম রাখা হয়েছে চাঁন মিয়া। ছেলেটির গায়ের রং চাঁদের মতই সুন্দর। নামকরণটি যথার্থই হয়েছে বলা যায়। দুর্ভাগ্যবশত পরিবারে অভাব অনটন বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। করিম স্বামী হিসেবে মোটেও সফল নন, তবে যেহেতু তিনি একজন পুরুষ এবং একটি পুরুষ শাসিত সমাজের অংশ, তাই জরিনার কোনও অভিযোগই সে গায়ে লাগায় না।

 

জরিনার যুক্তিসংগত কোনও কথাই সে মানতে চায় না। করিম যদি স্ত্রীর কথা শুনতে থাকে, তবে তার পুরুষত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হবে এই চিন্তায় সে সবসময় তার জরিনার উপর চটে থাকে।

 

প্রায় কয়েকদিন পরপর চাঁন অসুস্থতায় পড়ে। তাকে সময়মত ঔষধ না খাওয়ালে মারা যাবে। জরিনার এই অবস্থায় বাইরে গিয়ে কোথাও কোনও কাজ করার সামর্থ্য নেই। সে করিমকে বারবার তাগদা দেয় যাতে কিছু একটা করে; প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে কয়েকদিনের জন্য কিছু টাকা ধার আনতে।

 

করিম জরিনার মুখের উপর না বললেও ভিতরে ভিতরে তার পরিচিত মানুষদের কাছে ধরনা দিয়েছে কিন্তু কেউই তাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। করিম অবশ্য বাসায় কাউকেই এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

 

জরিনার দুই চোখে অন্ধকার। সে জানে না কিভাবে এই নিষ্পাপ শিশুটিকে লালন পালন করবে। একদিন করিম রিক্সা নিয়ে বাইরে গেলে জরিনা চাঁনকে নিয়ে বাইরে যায়। সন্ধ্যার দিকে করিম বাসায় ফিরে জরিনাকে না দেখে রুনাকে জিজ্ঞেস করে তার মা কোথায়। রুনা বলে যে সে নিজেও জানে না; সেলিনাও একটু আগেই বাসায় এসেছে; তারও কোনও ধারণা নেই।

 

ইতোমধ্যে রুনা প্রতিবেশী রেশমার বাসায় গিয়েও খুঁজেছে কিন্তু জরিনা সেখানেও যায়নি। ঠিক সেই মুহূর্তে জরিনা ধীরে ধীরে বাসার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন মরুভূমিতে পথহারা মৃত্যু পথযাত্রী কোনও মানুষ যে তার দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

 

করিম বিদ্যুতের গতিতে দৌড়ে গিয়ে জরিনাকে ধরে এনে উঠোনের এক কোণায় বসায়। রুনা ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে মাকে দেয়ার জন্য। জরিনার চোখের পাতা ওঠানামা করছে না; সে একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।

 

করিম জানতে চায় যে চাঁন কোথায় কিন্তু জরিনার মুখ ফুটে একটি শব্দও বের হয় না। এদিকে রুনা, সেলিনা এবং জাবেদও তাদের মাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে এবং একটু পরপর জিজ্ঞেস করছে তাদের প্রিয় ছোট ভাইটি সম্পর্কে, কিন্তু জরিনা রোবটের মতই বসে আছে।

 

     একপর্যায়ে করিম জরিনার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে ও জরিনা! আমরার চাঁন কই? উত্তরে নিজের কান্নার বন্যাকে সামলে নিয়ে জরিনা বলে, পাশশো টেহায় বেইচা দিসি!

View kingofwords's Full Portfolio