সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল উঁকি দিয়েছে সেটা যেন টেরই পাওয়া যায়নি। বৃষ্টির আজ মন ভালো নেই। সে জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি দেখছে বৃষ্টিকে! এ এক অসাধারণ মুহূর্ত যেন!
বৃষ্টির মন খারাপ কারণ তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু সায়েম দুদিন ধরে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। অবস্থা খুবই গুরুতর। বৃষ্টির মা লতিফা বেগম মোটেই চাননা যে ওনার মেয়ে ঐ ছেলেকে দেখতে যাক কারণ ওনার মনে পাথরের মত দৃঢ় এক সন্দেহ দানা বেঁধেছে। তিনি আগে খেয়াল করেছেন যে বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি ঐ সায়েমের সাথে ফোনে কথা বলে। এমনিতে বৃষ্টি গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে কিন্তু সায়েমের ফোন আসলেই তার আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। সে যেন এক অন্য মানুষে পরিণত হয়ে যায়!
মায়ের চোখকে ফাঁকি দেয়া এত সহজ নয়। লতিফা যতবারই ছেলেটির নাম, পরিবার ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে, বৃষ্টি ততই ওনার কথাগুলো এড়িয়ে খুব চতুরতার সাথে রান্নাবান্না কিংবা নতুন ডিজাইনের কাপড়চোপড় সম্পর্কে আলাপ শুরু করে দেয়।
সত্যি কথা বলতে বৃষ্টি নিজেও জানে না যে সায়েমের সাথে তার নিজের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চেয়ে বেশী কিছু কিনা। কারো জন্য মনে ভালোবাসার মালা সে আজ পর্যন্ত গাঁথেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধুদের তালিকায় বেশীরভাগই মেয়ে। ছেলেদের সংখ্যা হাতেগোনা।
সায়েমের প্রতি মায়ের সন্দেহটুকু বৃষ্টির কাছে একেবারেই অর্থহীন মনে হয়েছে এতদিন। এটা ঠিক যে বৃষ্টি তার সঙ্গ বেশ উপভোগ করে। তবে ছেলেটির বর্তমান করুণ অবস্থার কথা জেনে তার মনটাও আকাশের মত কাঁদছে আজ। আকাশের কান্না যেমন সময়ের মতই বিরামহীন, তেমনই বৃষ্টির কান্নারও কোনও বিরতি নেই। তার অশ্রু কাঁদছে না, কাঁদছে তার মন।
কোনও ছেলের মনে পাহাড়সম কষ্ট থাকলে সেটা সহজেই ধরা পড়ে যায় কিন্তু কোনও মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। বৃষ্টি জানালার বাইরে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন জানালার ওপাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন চোখ সরালেই সেই মানুষটি মারা যাবে।
বৃষ্টির কাঁধে আঙুলের উপস্থিতি টের পেয়ে সে ভয়ে কেঁপে ওঠে। “হেমলেট” নাটকে হেমলেট তার বাবার ভুতটিকে দেখে যেমন আঁতকে উঠেছিল, বৃষ্টিও যেন তেমন কোনও ভৌতিক কিছু দেখেছে। বৃষ্টি মুহূর্তেই বিদ্যুতের গতিতে পেছন ফিরতেই দেখে যে তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার হাতে চায়ের কাপ ধরা। কাপটি থেকে গরম গরম ধোঁয়া উড়ে হাওয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে।
- নে, চা খা।
- খাবো না মা।
- কেন?
- ভালো লাগছে না।
- তোর কি শরীর খারাপ? দেখি জ্বরটর হয়েছে কিনা।
- আরে না না, তেমন কিছুই না।
- তবে এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন তোকে?
- কৈ বিষণ্ণ দেখাচ্ছে? আমি ঠিকই আছি।
- সত্যি করে বলত, তোকে কি ভার্সিটিতে কেউ কিছু বলেছে?
- ধুর! কি যে বলো না মা? কে কি বলবে? তাছাড়া যদি এমন কিছু হত তবে আমি কি তোমাকে বলতাম না? আমি কখনও তোমার কাছে কিছু লুকাই?
- তা লুকাস না, তবে তোর গোমড়া মুখ দেখলে আমার ভালো লাগে না। আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তুই তো জানিস, তাই না?
- মা, প্লীজ আমাকে নিয়ে তোমার কোনও দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ভালো আছি। দাও, চায়ের কাপটা আমার হাতে দিয়ে তুমি তোমার রান্নাবান্না করো গিয়ে লক্ষ্মী মা আমার।
বৃষ্টি চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়েই সেটা টেবিলে রেখে দেয়। আবারও তার চিন্তাগুলো সায়েম কেন্দ্রিক হতে থাকে। এই প্রথম বৃষ্টির মনে হচ্ছে যে সায়েম যদি পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তবে সে নিজেও বাঁচবে না। যেন তাদের দুটি আত্মা একই সুতোয় গাঁথা।
বৃষ্টির বান্ধবী নিশা এবং অন্যান্য অনেকেই সায়েমকে দেখতে গিয়েছে। তারা যাবার আগে সায়েমের চেতনা ছিল না। কিছুক্ষণ পরে তার চেতনা ফিরে আসার সাথে সাথেই সে অস্ফুটে একটি শব্দ উচ্চারণ করে আর সেটি হচ্ছে ‘বৃষ্টি’। বৃষ্টির নামটি এভাবে সায়েমের মুখে শুনতে পেয়ে সকলেই অবাক হয়ে যায়। নিশা সাথে সাথেই ফোনে বৃষ্টিকে এ ব্যাপারে বলার পর বৃষ্টিরও আর বুঝতে বাকী থাকে না যে সায়েম তাকে গভীরভাবেই ভালোবেসে ফেলেছে। বৃষ্টি আরও বেশী অবাক হয়েছে এটা ভেবে যে সায়েম এতদিন ধরে বৃষ্টিকে বুঝতেই দেয়নি যে সে বৃষ্টিকে ভালোবাসে। বৃষ্টির নিজেকে বোকা বোকা মনে হচ্ছে! কেন সে সায়েমের চোখের ভাষা পড়তে পারেনি?
বৃষ্টির ঠিক কি করা উচিত সে জানে না। সে মাকে মিথ্যা কথা বলে যে কোনও মুহূর্তেই সায়েমকে একটিবার দেখতে যেতে পারে কিন্তু সে তার মাকে কখনও ধোঁকা দেয়নি, আজও দেবে না।
রাতে কোনও কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে সে। সারারাত মনে মনে সায়েমের জন্য দোয়া করতে করতে কখন যে সূর্যের আলো জানালার ভেতরে এসে উপচে পড়েছে বৃষ্টি তা টেরই পায়নি।
বৃষ্টি জানে যে সায়েমের কথা শুনলেই তার মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। তার বাবা বেঁচে থাকলে এতটা কষ্ট করতে হত না। বাবার কাছ থেকে সহজেই সে অনুমতি পেয়ে যেত। যাইহোক, বৃষ্টি সিদ্ধান্ত নেয় যে নাস্তার টেবিলে মাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। অনুমতি পেলে পাবে, না পেলে নাই, চেষ্টা করতে তো কোনও দোষ নেই।
নাস্তা করার সময় বৃষ্টি তার মাকে সায়েমের অবস্থাটা খুব ধীরে সুস্থে বুঝিয়ে বলে। বৃষ্টি কথা বলা অবস্থায় মা কোনও কথা বলেননি। তিনি বাধ্য শিশুর মত শুধু শুনেই গেছেন।
বৃষ্টির কথা বলা শেষ হবার পর সে মায়ের হাতটি ধরে করুণ চোখে ওনার চোখের পানে তাকিয়ে থাকে। কেন জানি বৃষ্টির মনে হচ্ছিল যে তার মা বলবে “ঠিক আছে যাও, তবে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফিরতে হবে”।
লতিফা বৃষ্টিকে বলেন যে “দেড় ঘণ্টার বেশী দেরী করা যাবে না”। এ কথা শুনার পর বৃষ্টি আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে ওনার গালে একটি চুমু দিয়ে এক দৌড়ে তার নিজের রুমে চলে যায়। সময় যেহেতু খুব কম, তাই তাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বের হতে হবে।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর বৃষ্টির সাথে তার বন্ধু বান্ধবীদের দেখা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কেউ কেউ বাচ্চার মত কাঁদছে। বৃষ্টির হৃদয়ের ওঠা নামা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
সে কোনও দুঃসংবাদের গন্ধ পাচ্ছে। অবশেষে বৃষ্টি শয্যাশায়ী সায়েমের কাছে গিয়ে একজন ডাক্তারকে দেখতে পায়। কি হয়েছে জানতে চাইলে ডাক্তার বলেন যে একটু আগেই সায়েম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
এ দুঃসংবাদ শোনার জন্য বৃষ্টি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে যে হয়তো বৃষ্টি স্বপ্ন দেখছে; এসব কিছুই সত্যি নয়! কিন্তু বিধাতার লীলা বোঝার সাধ্য কি এই নগন্য মানুষের দ্বারা সম্ভব!
ঐ মুহূর্তে পুরো পৃথিবী জুড়ে যতগুলো ‘চমৎকার’ ঘটনা বা ব্যাখ্যারও অতীত কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ঘটনা কয়েক মিনিটের মধ্যেই বৃষ্টির জীবনেও ঘটতে যাচ্ছে সেটি সম্পর্কে কারো কোনও ধারণাই নেই এবং থাকার কথাও নয়।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বৃষ্টি তার ডান হাত সায়েমের কপালে রাখতেই সায়েমের নিঃশ্বাস আগের মতই স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে। উপস্থিত সকলেই পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে একে অন্যের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!