আজ শুক্রবার। তাই আদনানদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটে ওনাদের মালামাল নিয়ে সাজাতে গোছাতে ব্যস্ত। যেহেতু শুক্রবার ছুটির দিন, তাই নির্ঝঞ্ঝাটভাবে মালপত্রগুলোকে জায়গা মত রাখার কাজটা করা যাবে।
মালপত্র তিনতলায় ঠিকমত ওঠানোর কাজটি তদারকি করছেন মোঃ জাহিদ হাসান। ওনার বয়স বেশী না হলেও অকালেই চুল পেকে গেছে। নাকের উপরে ভারী চশমা বসে আছে। দেখলে খুব গম্ভীর এবং ৬৫ বছরের একজন বয়স্ক নাগরিক বলে মনে হয়। বলাই বাহুল্য যে তিনিই পরিবারের হর্তাকর্তা।
আদনান বিকেলবেলা মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাবার সময় সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে অসতর্কতাবশত জাহিদের পায়ের উপর আদনানের পা পড়ে যায়। জাহিদ “উফ!” বলে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠেন। আদনান তখন কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে এক দৌড়ে প্রধান দরজা দিয়ে মাঠের দিকে চলে যায়।
জাহিদ ব্যাথায় কোঁকাতে কোঁকাতে “বেয়াদব” বলতে বলতে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে এগুতে থাকেন। মালামাল ঠিকঠাক মত ফ্ল্যাটে তোলা শেষ হয়েছে। পরদিন সকাল দশটার দিকে জাহিদের স্ত্রী সাইমুন হাসান এবং ওনাদের একমাত্র কন্যা নিশাত কোমল এসে উপস্থিত হয়।
জাহিদ একজন ব্যাংকার। সারাদিন ব্যাংকেই কেটে যায় ওনার। সাইমুন একজন গৃহিণী। কোমল দশম শ্রেণিতে পড়ে। সে খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে। আজ পর্যন্ত মা বাবার অবাধ্য সে কখনও হয়নি।
কোমল একটি জাদুর বাক্সের মত। একজন জাদুকরের বাক্স থেকে যেমন বিচিত্র সব জিনিস একটির পর একটি বের হয়ে আসে, ঠিক তেমনই কোমলের ভিতর নানা গুণের সমাহার দেখা যায়। সে পড়ালেখায় খুবই ভালো; নিয়মিত নাচ শেখে; কবিতা আবৃত্তিরও শখ আছে বেশ; এছাড়াও তার গানের গলা অসাধারণ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কোমল অংশ নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তার বাবা মা তাকে নিয়ে যারপরনাই গর্বিত।
অন্যদিকে কলেজ পড়ুয়া আদনানকে নিয়ে কলেজ শিক্ষক বাবা রেহমান সোবহান এবং মা নিপুন আরার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তার ভিতর কোনও গুণের ছিটেফোঁটাও যদি থাকতো তবে তার বাবা মা কিছুটা হলেও খুশী হতেন।
আদনান নিয়মিত কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে কুরুচিপূর্ণ বাংলা সিনেমা দেখে বাসায় আসে। কলেজে প্রায়ই সে তার সতীর্থদের সাথে হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। কতবার যে তার শিক্ষকগণ রেহমানের কাছে তার ছেলের কুকীর্তির জন্য নালিশ করেছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। রেহমান নিজে একজন শিক্ষক হয়েও ওনার ছেলেকে সঠিক শিক্ষাটা আজ পর্যন্ত দিতে পারেননি। এই ব্যর্থতার জন্য তিনি ওনার স্ত্রীকে দোষারোপ করেন না। তিনি মনে করেন যে তার ছেলের এই অধঃপতনের জন্য তিনিই দায়ী। তিনি মনে মনে ভাবেন যে নিশ্চয়ই ওনার প্রতিপালনের মধ্যেই কোথাও কোনও ঘাটতি রয়েছে।
রেহমান আদনানের এত বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও কখনও তার গায়ে হাত তোলেনি। যখনই কেউ ওনার ছেলের সম্পর্কে ওনার কাছে কিংবা নিপুনের কাছে অভিযোগ করেছেন, তখন তিনি সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে আদনানের সাথে একান্তে আলাপ করেন, তাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। প্রতিবারই আদনান তার বাবাকে কথা দেয় যে এমনটি আর কখনও হবে না। কিন্তু দেখা যায় যে পরদিনই কেউ না কেউ আরও অভিযোগের ডালা নিয়ে বাসায় হাজির!
রেহমানের পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে আদনান একদিন পরিবর্তন হবেই। সে তার বাজে আচার আচরণ পরিবর্তন করে একজন ভালো মানুষে পরিণত হয়ে নিশ্চয়ই সকলের মন জয় করবে। একদিন আদনান যথারীতি তার ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের বেগে দৌড়ে নামতে গিয়ে আবারও জাহিদের সাথে প্রায় ধাক্কা খেয়েই বসেছিল। কোনওমতে সে নিজেকে সামলে নিয়ে চলে যাবে এমন সময় জাহিদ আদনানকে বলেন-
- এই ছেলে শোনো।
- আমাকে বলছেন?
- হ্যাঁ তোমাকেই বলছি। এখানে কি আর কাউ আছে যে তাকে বলব?
- জি আঙ্কেল বলুন।
- তোমার বাবা মা কি তোমাকে আদব কায়দা কিছু শেখায়নি?
- মানে?
- মানে হচ্ছে এই যে গত শুক্রবারে তুমি আমার পায়ে আঘাত দিয়ে পালিয়ে গেলে। আমি তখন তোমাকে কিছু বলার সুযোগ পাইনি।
- ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঐদিন তো আমি ইচ্ছে করে আপনাকে ব্যাথা দেইনি আঙ্কেল।
- তা জানি, কিন্তু তুমি তো একবার সরি বলতে পারতে তাইনা? তাছাড়া বয়স্কদের দেখলে সালাম দিতে হয় সেটাও কি জানো না?
- হ্যাঁ, তাইতো! আপনি ঠিকই বলেছেন। সরি আঙ্কেল, এমন ভুল আর কখনও হবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- এখন যাই আঙ্কেল। আসসালামুয়ালাইকুম!
যখন সূর্য দিগন্তে মিলিয়ে যায় যায় করছে, ঠিক তখন আদনান ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরে আসতে থাকে। যখন সিঁড়িতে সে প্রথম পা দেয়, তখন তার কানে একটি মেয়ের সুমিষ্ট কণ্ঠ ভেসে আসে। আদনান যত সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে থাকে কণ্ঠটিও যেন তার দিকে আরও স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে।
সে লক্ষ করে যে জাহিদ আঙ্কেলের বাসা থেকেই সেই কোকিলের মত কণ্ঠটি ভেসে আসছে। এত অসাধারণ করে মানুষ গায় কি করে? ক্রিকেট খেলে শরীরে যে ক্লান্তি ভর করেছিল তা যেন এখন বাস্পের মত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তার দেহ মন আবারও চাঙ্গা হয়ে গেছে।
জাহিদ তার বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কলিং বেল চেপে বাসায় প্রবেশ করতে তার মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না। তার মনে হয় যেন এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটির গান সে শুনতেই থাকে অনন্তকাল জুড়ে।
আদনান মেয়েটির কণ্ঠ শুনে আঁচ করতে পেরেছে যে মেয়েটির বয়স নিশ্চয়ই খুব বেশী নয়। তার চেয়ে ছোট হবে অবশ্যই। কণ্ঠ শুনে সে এতটাই পুলকিত হয়েছে যে মেয়েটিকে এক পলক দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মনের গহীনে ভর করেছে। মনে মনে সে ঠিক করে যে মেয়েটির সাথে যে করেই হোক সে কথা বলবে এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে।
পরদিন বিকেল বেলা আদনান আর খেলতে যায়নি। ক্রিকেট তার কাছে একটি নেশার মত। প্রতিদিন তার ক্রিকেট খেলা চাই। কিন্তু আজ নাম না জানা এবং অদেখা এক মেয়ের জন্য সে তার প্রিয় খেলাটিকে কনুই মেরে বাসায় অবস্থান করছে। তার মা তো তাকে বাসায় বসে থাকতে দেখে অবাক! মা তাকে প্রশ্ন করেন, “কিরে আজ খেলতে যাচ্ছিস না যে? শরীর খারাপ নাকি তোর?” আদনান উত্তরে মাকে একটি মিথ্যা কথা বলে, “আজ টিভিতে একটা মজার অনুষ্ঠান আছে, সেটা মিস করতে চাই না।”
আদনানের চোখ টিভির পর্দায় ঠিকই কিন্তু তার মন পাখীর মত উড়ে বেড়াচ্ছে অন্য কোথাও। সে মনে মনে ভাবছে যে কিভাবে মেয়েটির সাথে কথা বলবে। কথা বলতে হলে তো মেয়েটিকে একা পাওয়া লাগবে। এখন পর্যন্ত কখনও সেই সৌভাগ্য তার হয়নি। তাছাড়া মেয়েটি বিকেলে ছাদে পায়চারী করতে যায় কি না তাও সে জানে না।
হঠাৎ আদনানের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে! সে নিজের বাসার কাজের মেয়ে আম্বিয়াকে ডেকে বলে যে ছাদে কাপড় আনতে গেলে যদি সে তাদের পাশের বাসার মেয়েটিকে দেখে তবে সে যেন অবশ্যই তাকে এসে বলে। আদনান খুব কঠোরভাবে তাকে বারণ করে দিয়েছে যাতে এ কথা সে অন্য কাউকে না বলে।
আদনান অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। কবে যে সেই মেয়েটির সাথে তার দেখা হবে? তাকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত। আম্বিয়া একদিন ছাদ থেকে নেমে এসে আদনানকে জানায় যে ছাদে একজন অল্পবয়স্ক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাচ্ছে। আম্বিয়া নিজেও কখনও পাশের বাসার মেয়েটিকে দেখেনি, তবে সে নিশ্চিত যে এই মেয়েই সেই মেয়ে যার কথা আদনান বলেছে।
আদনান তখন তার নিজের রুমে গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। কফির মগটি টেবিলে রেখে পড়িমরি করে বৈশাখী ঝড়ের দমকা হাওয়ার মত ছাদের দিকে ছুটে যায়। সে ছাদে পৌঁছতেই মেয়েটি পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে পেছন ফিরে তাকায়।
কোমল দেখতে পায় আদনানকে। আদনান তখন মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে তো হাঁপাচ্ছেই। যেন সে এইমাত্র কোনও এক দৌড় প্রতিযোগিতার শেষ রেখাটি স্পর্শ করেছে।
কোমল ছাদের অন্য পাশে সরে গিয়ে একটু পরপর মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। সে লক্ষ করে যে মেয়েটির গায়ের রং আকাশের মেঘের মত শুভ্র। একটি লম্বা স্কার্টের উপরে একটি নীল টি শার্ট জড়ানো। তার দীর্ঘ কালো চুল হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত। এত সুন্দর চুল আদনান আজ পর্যন্ত দেখেনি।
আদনান মনে মনে আশা করে যে মেয়েটি যাতে তার দিকে অন্তত একটিবার তাকায়। কিন্তু তাকে পুরোপুরি হতাশ করে দিয়ে কোমল বাসায় ফিরে যাবার জন্য সিঁড়ির দিকে যেতে থাকে। তখন আদনানের মনে হয় যে কেউ যেন এইমাত্র তার হৃদয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
আদনান দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়ায়। কোমল ইতস্তত বোধ করতে থাকে। আদনান তখন তার পরিচয় দেয় এবং মেয়েটির কাছে নাম জানতে চায়। মেয়েটি “কোমল” বলতেই আদনান বলে যে “যথার্থ নাম, যেমন কোমল আপনার কণ্ঠ, তেমনই আপনার নাম”।
আদনান যখন কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারে যে কোমল স্কুলে পড়ে তখন সে তাকে “তুমি” বলে সম্বোধন করার অনুমতি চাইলে কোমল হাসতে হাসতে রাজি হয়ে যায়। আরও মিনিট পাঁচেক এই দুই ছেলে মেয়ের মাঝে টুকটাক কথা হয়। এই প্রথম কোমলকে হাসতে দেখে আদনান মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয়। তার হাসিও যে অসাধারণ! তার ধারণা ছিল না যে কেউ এমন সুন্দর করে কখনও হাসতে পারে?
প্রথম দেখাতেই কোমলকে আদনানের ভালো লেগে যায়। কোমলের মনেও আদনানের জন্য একটি অন্যরকম ভালোলাগা বোধের জন্ম হয়। প্রেম কখন যে চুপিসারে কার মনের মাঝে ভালোবাসার বীজ বপন করে দেয় তা বুঝা বড় দায়!