মিলার তালাক হয়েছে প্রায় চার মাস হয়। সে একটা টেইলার্সে কাজ করে। টেইলার্সটিতে মেয়েদের পোশাক তৈরির কাজ করে সে। কিন্তু ব্যাবসা আর আগের মত চলে না। কোনও রকমে গরুর গাড়ির মত চলছে।
যে কারণে টেইলার্সটির মালিক রিতু হায়দার কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কয়েক মাস ধরে। মিলা এখনও পাঁচ হাজার টাকা পাবে ওনার কাছ থেকে। রিতু তাকে খুব মায়া করে বলেই মিলা কখনও সেই টাকা নিজ থেকে চাওয়ার কথা ভাবে না কখনও।
কিন্তু টেইলার্সে অর্ডার কমতে কমতে এমন অবস্থা হয়েছে যে সারাদিনে এক টাকাও উপার্জন হয় না। যে কয়েকজন কর্মচারী আছেন তারা এই টেইলার্স টিকিয়ে রাখার পক্ষে কোনও শক্ত যুক্তি খুঁজে পায় না। ধীরে ধীরে প্রায় সবাই টেইলার্স ছেড়ে অন্যত্র কাজ খুঁজে নিয়েছে বা নিচ্ছে।
টেইলার্সে কর্মচারী বলতে শেষপর্যন্ত টিকে আছে শুধুমাত্র দুজন। একজন মিলা এবং আরেকজনের নাম খুশী আক্তার। খুশীর কথাবার্তায় মিলা আঁচ করতে পেরেছে যে সেও মাত্র কয়েকদিনের অতিথি এই টেইলার্সে। হয়তো যে কোনোদিন সেও চলে যাবে খাঁচার পাখীর মত ফুড়ুৎ করে।
মিলা খুব লাজুক এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। তার বিশ্বস্ততায় খুব বেশী আস্থা রিতুর। তাইতো তিনি টেইলার্সের চাবি দিয়েছেন তাকে। মিলার কাজ হল প্রতিদিন সকাল দশটায় টেইলার্স খোলা এবং রাত নয়টায় বন্ধ করা। তার দুপুরের খাবার অবশ্য তার বড় ভাই এসে দিয়ে যায়।
টেইলার্সে অনেকক্ষণ সময় দেয়ায় তার তেমন অসুবিধা নেই। কিন্তু তার একমাত্র ছেলে রিয়াজের জন্য মন খুব কাঁদে। যার বয়স তিন বছর। রিয়াজকে সে তার দাদীর কাছে যখন রেখে আসে তখন ছেলেটি ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করে এবং যখন বাসায় ফিরে তখন ছেলেটি ঘুমানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। মজার বিষয় হচ্ছে রিয়াজ তার দাদীকে মা বলে ডাকে আর তার আপন মাকে বলে ফুফু!
মায়ের আদর থেকে ছেলে দিনদিন বঞ্চিত হচ্ছে এটা ছেলে তেমন না বুঝলেও মা তো বুঝে। এদিকে খুশীর আর মন টিকে না এই টেইলার্সে। সে একদিন মিলাকে বলেই বসে,
- আমি এই টেইলার্সে আর থাকতে চাই না।
- আমিও থাকতে চাই না।
- আমি দুয়েকটা জায়গায় বলে রেখেছি।
- কি মনে হয় অন্য জায়গায় এত সহজে কাজ মিলবে?
- দেখি কি হয়। চেষ্টা তো করতে হবে।
- হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, এখানে বসে বসে মাছি মারার কোনও মানে নেই।
- তোমার কি পরিচিত কোনও টেইলার্স আছে যেখানে একটা ব্যবস্থা হতে পারে?
- আমার বাসার কাছেই একটা আছে।
- প্লীজ বোন! আমার জন্য একটু বলে দেখো না!
- আচ্ছা দেখি কি করা যায়।
- আমি কি খুব স্বার্থপরের মত কথা বললাম বোন? তোমার নিজেরও তো অন্য জায়গায় চাকরি দরকার, তাই না?
- আরে না না, এভাবে ভেবো না। সত্যি কথা বলতে আমি আর কোথাও কাজ করতে চাই না।
- কাজ করবে না মানে? তাহলে খরচ চলবে কিভাবে?
- কাউকে বলিও না বোন, আমি একটা বাসায় গত কয়েকমাস ধরে কাজ করি। সেখানে বেশ ভালো বেতন পাই। এতেই আমার ভালোভাবে চলে যাবে। তাছাড়া এই টেইলার্সে কাজ করার ফলে আমি আমার বাচ্চাটাকে একটুও সময় দিতে পারি না।
মিলা তার কথা রেখেছে। সে খুশীর কথা বলেছে তার বাসার নিকটে যে টেইলার্স আছে সেখানে। সৌভাগ্যবশত কয়েকদিনের মধ্যেই খুশীর চাকরি হয়ে যায় সেখানে। যেদিন সে জানতে পারে যে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে মিলার সামনে কৃতজ্ঞতায় বাচ্চার মত কেঁদে উঠে। সে যে কি করলে মিলার ঋণ শোধ করতে পারবে তা তার অজানা। চাকরিটা তার খুব বেশী প্রয়োজন ছিল সেই মুহূর্তে।
যাইহোক, একদিন মিলাও সরাসরি রিতুকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে আর টেইলার্সে আসতে পারবে না। এ কথা শোনার পরে রিতুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। যদি মিলা চলে যায় তাহলে টেইলার্স বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। মিলার মত বিশ্বস্ত মানুষের হাতে দায়িত্ব দিয়ে এতদিন বেশ নিশ্চিন্তেই ছিলেন তিনি।
মিলাকে রাজি করানোর জন্য রিতু একদিন তার বাসায় গিয়ে হাজির। কিন্তু মিলা এখন তার মনকে পাথরের মত শক্ত করে আছে। সে তার সিদ্ধান্ত থেকে এক পাও নড়বে না। চাকরিটা ছাড়ার পর থেকে মিলার সময় যেন অফুরন্ত। আগে টেইলার্সে সময় যেন দমকা হাওয়ার মত দ্রুত বয়ে যেত। এখন সারাদিন বাসায় বসে শুয়ে কাটতে থাকে তার দিনগুলো।
গোধূলি লগ্নে পুকুরের পানি যেমন সোনালী আভায় রঙিন হয়, ঠিক তেমনি মাকে কাছে পেয়ে রিয়াজের চোখে মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠেছে। সন্তানের আনন্দের কাছে অন্য সব কষ্ট এবং না পাওয়ার বেদনা পৃথিবীর সব মায়ের কাছেই একেবারেই তুচ্ছ। মা এবং সন্তানের মাঝে যে অদৃশ্য ভঙ্গুর সেতু ছিল সেটা যেন এতদিনে জোড়া লেগেছে।
একদিন রিয়াজ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে মিলা খুব বিপাকে পড়ে যায়। এমনিতেই তার উপার্জন খুবই সামান্য তার উপর ছেলের ঔষধ কেনার জন্য প্রচুর টাকা প্রয়োজন। তার ভাই আক্কাস রিক্সা চালিয়ে যা পায় তা দিয়ে কোনওমতে সংসারের চাকা চলে।
নিরুপায় হয়ে মিলা পাশের বাড়ির নাজমা আপার কাছে দুই হাজার টাকা ধার চায়। নাজমা টাকা নেই বলার পর মিলা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাবে এমন সময় নাজমা তাকে ডেকে খাটের উপর বসায়। মিলার হাত ধরে নাজমা বলে যে একটা কাজ করলে তার আর কখনও টাকার অভাব হবে না।
মিলা জানতে চায় কি কাজ। নাজমা একটু ইতস্তত করে তার কানেকানে বলে যে কাজটা রাতে করতে হবে। মিলা নাজমার আকার ইঙ্গিতে বুঝে যায় যে তাকে কু প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের তারের সংস্পর্শে আসলে যেভাবে মানুষ দূরে ছিটকে যায়, মিলা তেমন করে নাউজুবিল্লাহ বলতে বলতে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।