ফাহিম হক সিলেট শাহ্ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ অনার্স কোর্সে ভর্তির জন্যে যে নির্ধারিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সে পরীক্ষা দেবার জন্যে মোটেও প্রস্তুত নয়।প্রথমত তার ছোটবেলার বেশীরভাগ সময় কেটেছে যে মায়াময়ী, অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম শহরে, সেই চির চেনা, চির আপন শহর ছেড়ে সিলেটে এসে পরীক্ষা দেবার ইচ্ছা তার একেবারেই নেই। দ্বিতীয়ত তার মন খুব কাঁদে এই ভেবে যে যদি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তবে তার মায়ের কাছ থেকে, ওনার স্নেহ, ভালোবাসার কাছ থেকে তাকে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে হবে।
মূল ঘটনায় যাবার আগে ফাহিমের অতীতে একটু ঢুঁ মারা যাক। চট্টগ্রামের যে স্থানে ফাহিমের ছেলেবেলার সিংহভাগ কেটেছে সেই জায়গাটির নাম হালিশহর। তার প্রচুর বন্ধু রয়েছে সেখানে। তাদের মধ্যে জুয়েল হচ্ছে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। একেবারে প্রাণপ্রিয় বন্ধু যাকে বলে আর কি!
জুয়েলের বাসা ফাহিমের বাসার ঠিক পাশেই ছিল। এলাকায় শত রকম দুষ্টামি এবং ফাজলামি করে বেড়াতো এই দুই জন। কখনও বিদ্যুৎ চলে গেলে রাতের আঁধারে ছাদে উঠে পাশের বাড়ির নারকেল গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়া, সারাদিন টইটই করে দিশেহারা গরুর মত ঘুরে বেড়ানো, বেলা অবেলায় ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া ইত্যাদি করাই ছিল এই দুই অস্থিরমনা মানব সন্তানের প্রধান কাজ।
কখনও কখনও সারাদিন বাইরে থাকার ফলে দুপুরের খাবার খাওয়া হতো না যার ফলে সন্ধ্যায় মায়ের বকুনি এবং বেতের মার একটাও মাটিতে পড়তো না। ফাহিম এবং জুয়েলের মা খুব কড়া থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের সহজাত প্রকৃতি বদলাতে পারতেন না এতো সহজে। দুনিয়ার এ এক অদ্ভুত অলিখিত নিয়ম- ছোটবেলায় সন্তানরা দুষ্টামি-ফাজলামি করবে এটাই স্বাভাবিক; অন্যদিকে বড়রা তাদের সেই ফাজলামিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় লিপ্ত হন প্রতিনিয়ত।
ফাহিম যখন চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হল তখন জুয়েলের সাথে তার কিছুটা দূরত্ব বাড়তে লাগলো। জুয়েল হালিশহরের স্থানীয় একটা কলেজে ভর্তি হলো। যার ফলে তাদের মধ্যে আগের মত দেখা সাক্ষাত খুব একটা হতো না। ফাহিমের বাসা থেকে সমুদ্র খুব বেশী দূরে নয়। সমুদ্র যেন তাকে এক অদৃশ্য চুম্বক শক্তির মত টানতো। প্রায়ই সে কলেজ থেকে ফিরে এসে জুয়েলের বাসা থেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র তীরে চলে যেতো পায়ে হেঁটে।
সমুদ্র দেখার আনন্দের কাছে পায়ে হাঁটার ফলে যে ব্যথা অনুভব হতো তা নিতান্তই নগন্য মনে হত ফাহিম এবং জুয়েলের কাছে। সমুদ্রতীরে পৌঁছার পর যে অনাবিল আনন্দ এসে ভর করতো দুজনের মনে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। স্নিগ্ধ বাতাস শরীর এবং দুটোই জুড়িয়ে দিতো। যেন স্বর্গের দরজা খোলা এবং স্বর্গীয় বাতাস বিরামহীনভাবে বয়ে যেতেই থাকলো।
এখন একটু বর্তমানে ফিরে আসা যাক। জুয়েল এইচ. এস. সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি কিন্তু ফাহিম তার বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে। জুয়েলের মনের রাজ্য জুড়ে হতাশার কালো ছায়া বিরাজ করছে, অন্যদিকে ফাহিম যেন আকাশে পাখীর মত উড়ে বেড়াচ্ছে। সে কয়েকটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফর্ম যোগাড় করেছে ঠিকই কিন্তু পড়ালেখায় মন একেবারেই নেই। এর কারণটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সে চায় না চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে।
তার বাবা আরিফুল হক একটু বদরাগী ধরণের মানুষ। ওনাকে পটিয়ে রাজি করানোর জন্য ফাহিম তার মা নুরজাহান বেগমের কাছে প্রায় প্রতিদিন অনুরোধের পাহাড় নিয়ে আসে। তার মা এ ব্যাপারে স্বামীর সাথে একবার কথা বলেছে কিন্তু আরিফুল হক ওনার সিদ্ধান্তে পিরামিডের মত অনড়। তিনি চান যে ছেলে পরীক্ষা দিক। তাছাড়া পরীক্ষা দেয়া মানেই তো আর ঘর ছেড়ে নতুন জায়গায় যাওয়া বুঝায় না। সেখানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া না হওয়ার ব্যাপার জড়িত।একদিন রাতে খাবার খেতে বসে ফাহিম তার বাবাকে বলে,
- বাবা, আমি সিলেটে পরীক্ষা দিতে যেতে চাই না।
- কেন? এতে সমস্যা কি?
- সমস্যা আছে।
- কি সমস্যা বল, আমরা সবাই শুনি।
- আমি খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পরীক্ষা দেবো।
- তুমি নিজেকে কি মনে করো? পরীক্ষা দিলেই কি উত্তীর্ণ হওয়া যায় নাকি?
- আমি উত্তীর্ণ হবোই, তুমি দেখে নিও।
- পরীক্ষা কি তোমার হাতের মোয়া নাকি? হাজার হাজার পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেবে;সেখানে যদি তুমি উত্তীর্ণ না হও তখন তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
- যদি উত্তীর্ণ না হই সেই ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কলেজে পরীক্ষা দেবো। সেখানে তো ইংরেজিতে সম্মান কোর্স আছে।
- চুপ করো, পড়ালেখা শিখে দিনদিন বেয়াদব হচ্ছ!
- এখানে বেয়াদবির কি হলো বাবা?
- তুমি মুখেমুখে তর্ক করা শিখে গেছো দেখছি!
- আমি কিছু বললেই তর্ক হয়ে যায়!
- তুমি কলেজে সম্মান কোর্স করলে ভবিষ্যতে ভালো চাকরীর বাজারে তুমি পিছিয়ে পড়বে কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির একটা অন্যরকম মূল্য আছে। তোমার চোখের সামনে তোমার বন্ধুরা সফলতার শিখর ছোঁবে আর তুমি ছাইয়ের মত নিচে পড়ে থাকবে। তখন শত আফসোসেও নিজের ভুল শোধরানোর কোনও সুযোগ তুমি পাবে না। এ বিষয় নিয়ে আমি আর কোনও কথা শুনতে চাই না। ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে থাকো। নিজের পায়ে নিজে এভাবে কুড়াল মেরো না।
ফাহিম তার খাবার অসম্পূর্ণ রেখে চোখেমুখে বিরক্তির রেখা ফুটিয়ে উঠে চলে যায়। তার মা অনেক ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও সে আর ফিরে আসেনি। যাইহোক, ফাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখানে মেধাতালিকায় তার নাম না দেখে সে দুঃখী না হয়ে বরং খুশীই হয় বেশী কারণ তাকে ঘর ছেড়ে ঢাকায় পড়াশুনার জন্য যেতে হবে না। তবে ওয়েটিং লিস্টে তার নাম ঠিকই আসে।
পরবর্তীতে সিলেটের শাহ্ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ফাহিম অংশ নেয়। আসলে অংশ না নিয়ে যে আর কোনও উপায় তার ছিল না। যাইহোক, যখন ফল বের হয় তখন ফাহিম সেটা পত্রিকায় দেখার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নয় কারণ সে জানে যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কথা দূরে থাকুক, তার নাম ওয়েটিং লিস্টেও থাকবে না।
যেহেতু সে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেয়নি এবং চরম বিরক্তি এবং রাগ ছিল মনে, তাই সে নিশ্চিত যে তাকে শাহ্ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে না। কিন্তু তার বাবা তাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেন যে সে ফল দেখেছে কি না। ফাহিম উত্তরে বলে যে সে দেখেনি। এতে তার বাবা বেশ ক্ষেপে যান এবং তার কাছ থেকে রোল নাম্বারটা চেয়ে নেন।কিছুক্ষণ পরেই তিনি ফাহিমকে ফোন দিয়ে সুসংবাদটা দেন।
ফাহিম পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ২৭তম স্থান অধিকার করেছে। ফাহিমের মা বাবা, ভাইবোন, বন্ধুরা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন খুব খুশী কিন্তু যাকে ঘিরে এই আনন্দজজ্ঞ, সেই ফাহিমের হৃদয় যেন আয়নার মত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
জীবনে এই প্রথম ফাহিম একা এতদূরের পথ অতিক্রম করতে যাচ্ছে। তার গন্তব্য সিলেট। চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে গেলে ৭ অথবা ৮ ঘণ্টার মত লাগে। কিন্তু ট্রেনে গেলে ১০ ঘণ্টা লাগেই। কখনও কখনও ট্রেন দেরী করলে আরও অনেক বেশী সময় লাগে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফাহিম ট্রেনে উঠে বসে। তার কাছে মনে হচ্ছিল এই মনে হয় তার জীবনের শেষ দিন। আর কখনও সে তার পরিবারের কারো মুখ দেখতে পাবে না। কি এক অচেনা ভয় তার মনকে গ্রাস করে ফেলছে আগুন যেমন ধীরে ধীরে কাগজকে গ্রাস করে ফেলে তেমন করে।
সিলেটে পৌঁছেই ফাহিম তার মাকে ফোন করে। তার গলার স্বর খুব ভারী শোনায়। আর কয়েক মিনিট কথা বললেই সে হয়তো বাচ্চার মত কেঁদেই ফেলতো। শহরে কিন ব্রিজের নিকটেই তোপখানা নামক স্থানে তার এক আত্মীয় আছে, আপাতত সেখানেই কয়েকটা দিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা ভালো মানের মেস যোগাড় করে সেখানে চলে যাবে- এই হচ্ছে তার পরিকল্পনা।
যদিও সম্পর্কে আত্মীয়, তবুও ফাহিমের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে অন্যের বাসায় এভাবে থাকতে। সে আর কালক্ষেপণ না করে মেস খুঁজতে থাকে। অবশেষে একটা ভালো মেস সে খুঁজে পায় যেটা তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব বেশী দূরে নয়।
মালামাল মেসে স্থানান্তর করার পালা শেষ হবার পরে ফাহিমের পরবর্তী কাজ হচ্ছে ভর্তি সংক্রান্ত কাজকর্ম সুন্দরভাবে শেষ করা যা সে ধীরে ধীরে করতে থাকে। এক সময় তার ইংরেজি বিভাগে ক্লাস শুরু হয়ে যায়। সে ক্লাসে যায় ঠিকই কিন্তু তার মন পড়ে থাকে চট্টগ্রামের বাসার আঙ্গিনায়, ছাদে, সমুদ্রের মাতাল করা হাওয়ায়, মায়ের বকুনিতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ইত্যাদি।
ফাহিমের কাছে সবকিছু এলোমেলো লাগে। ফোনে সে তার মাকে অনেকবার বলেছে যে সিলেটে তার ভালো লাগছে না; সে চট্টগ্রাম কলেজে পরীক্ষা দিয়ে সেখানেই কোনও বিষয়ে সম্মান কোর্স করবে। তার বাবা মা অনবরত তাকে আশ্বস্ত করতে থাকে, উৎসাহিত করতে থাকে। ওনারা বলেন যে কয়েকদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথাটা আসলেই সত্যি। কয়েকটা দিন কাটানোর পর ফাহিমের বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন আর তার একা লাগে না। মেসের যারা থাকে তাদের সাথেও তার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রায়ই একসাথে গানের আসর বসে। কেউ একজন গীটারে সুর তুললেই হয়, সাথে সাথে সবাই একসাথে মেসের ভিতর গলা ফাটিয়ে গাইতে থাকে। কখনও কখনও তাস খেলাও চলতে থাকে। এতে যে ফাহিমের পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে তা বলাই বাহুল্য।
ছুটি খুব একটা পাওয়া যায় না। সরকারি ছুটিগুলো সংখ্যায় হাতেগোনা। ফাহিম ঈদে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন তার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আর যখন ঈদের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসতে থাকে, তখন তার চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় যেন এইমাত্র তার কোনও নিকটাত্মীয় মারা গেছে।
যাইহোক, জীবন নামক গাড়ি চলতে থাকে। সবার জীবনেই এমন একটা মুহূর্ত আসে যেখানে তার ভবিষ্যতের দিক নির্ধারিত হয়ে যায়। ফাহিমের জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়।
ক্লাসে ফাহিম বসে একেবারে শেষের বেঞ্চে। ইতোমধ্যে দু একজন মেয়ে বন্ধুও হয়েছে তার। কিন্তু প্রেম নিয়ে কখনও ভাবেনি। আসলে প্রেম তো আর মেহমানের মত বলে আসে না, এটা হয়ে যায়। তিন্নি নামের একটা মেয়েকে তার খুব পছন্দ হয়। মেয়েটি যে খুব ফর্সা তা নয়,কিন্তু তাকে দেখলে খুব মায়া লাগে; চোখগুলো হরিণের চোখের মত টানাটানা।
ফাহিম বিশ্বাস করে যে একজন মানুষের সৌন্দর্য নির্ভর করে তার মনের সরলতায়, তার আচার-ব্যবহারে; গায়ের রং মুখ্য নয় এবং কখনও হওয়া উচিতও নয়। যাইহোক, সে প্রতিদিন মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটিও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে ফাহিম তার প্রতি দুর্বল। আসলে মেয়েরা ছেলেদের ভাবভঙ্গী বইয়ের মত খুব দ্রুত পড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ছেলেরা মেয়েদের মন এত সহজে পড়তে পারে না। তাদের মন যেন ঝিনুকের শক্ত খোলসের ভিতরে মুক্তো।
ফাহিম প্রতি রাতে ঘুমোতে যাবার আগে সিদ্ধান্ত নেয় যে পরের দিন যে কোনও প্রকারেই হোক না কেন সে তিন্নিকে তার ভালোবাসার কথা জানাবে। কিন্তু যখনই মেয়েটিকে দেখে, সে বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে; সামনে গিয়ে কিছু বলার সাহস আর সে পায় না।
এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা ফাহিম তিন্নিকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে। সিনেমার নায়কেরা যেমন নায়িকাদেরকে নিয়ে স্বপ্নের রাজ্যে, গানের রাজ্যে হারিয়ে যায়, ঠিক সেই রকম।
ইতোমধ্যে ফাহিম অনেকবার ভেবেছে যে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু টিপুকে এ বিষয়ে জানাবে যাতে তার কাছ থেকে কোনও সুপরামর্শ পাওয়া যায়। টিপু আর সে একই মেসে থাকে। কিন্তু পরে কোনও এক রহস্যময়, অজানা সংকোচে সে তার বন্ধুকে কিছুই বলে না।
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এই যে যখন কোনও ছেলে বা মেয়ে প্রেমে পড়ে তখন সে ভাবে যে অন্য কেউ কখনও জানবে না এ ব্যাপারে, কিন্তু আশেপাশের ঘনিষ্ঠ যারা তারা ঠিকই বুঝে যায়; মানুষের চোখকে ফাঁকি দেয়া এত সহজ নয়। টিপুও ফাহিমের আচার আচরণে পরিবর্তন দেখে আঁচ করতে পেরেছে যে সে নিশ্চিত প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডাক্তার কোনও রোগীকে দেখে যেমন তার রোগ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করতে পারে, টিপুও ফাহিমকে দেখে একটা ধারণা পোষণ করেছে যেটা একশত ভাগ সঠিক। একদিন টিপু জিজ্ঞেস করে,
- কিরে ফাহিম, তুই কি কারো প্রেমেটেমে পড়েছিস নাকি?
- আরে না দোস্ত, কি যে বলিস না? আমি পড়বো প্রেমে?
- দেখ বন্ধু, আমার কাছে কিন্তু কিছু লুকাতে পারবি না; আমি সব বুঝি।
- তোর কাছে কি আমি কখনও কিছু লুকাই নাকি?
- তাহলে সত্যি কথাটা বল শুনি।
- দোস্ত, আমাদের ক্লাসের তিন্নি নামের মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ, আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি; আমার তার সাথে টাইম পাস করা বা তাকে ধোঁকা দেবার কোনও ইচ্ছা নেই।
- খুব ভালো কথা। প্রেমে যখন জড়াবি তখন সেখানে সততা থাকা খুব প্রয়োজন।
- হ্যাঁ বন্ধু, আমি তোর সাথে একমত।
- তাহলে তোর প্ল্যান কি?
- আমি তাকে আমার ভালোবাসার কথা জানাবো এবং যদি সে রাজি হয় তবে তাকে আমি বিয়ে করবো।
- বিয়ে করবি! এখন! এই সেকেন্ড ইয়ারে!
- আরে না গর্দভ! মানে বলছিলাম যে আমরা অনার্স এবং মাস্টার্স পাশ করার পর বিয়ে করবো।
- জীবন কি আর মায়ের হাতে বানানো মোয়া নাকি যে যেভাবে চাইবি সেভাবেই হবে?
- আমি জানি এতে অনেক ঝামেলা এবং ঝুঁকি আছে কিন্তু আমি এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নই।
- তিন্নির মা বাবা যদি না মানে? তখন কি করবি?
- কি আর করবো? পালিয়ে বিয়ে করবো!
- পালিয়ে বিয়ে করে তোরা তোদের সংসার শুরু করবি কিভাবে?
- দু জনে চাকরি করবো। আলাদা বাসা নেবো। আর কোনওমতে যদি চট্টগ্রামে আমার চাকরি হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা, আমাদের বাসায় গিয়ে উঠবো।
- তোর মা বাবা এ ধরণের বিয়ে এত সহজে মেনে নেবেন?
- অবশ্যই মেনে নেবেন। আমি ওনাদের রাজি করিয়েই ছাড়বো, তুই দেখিস।
- দেখ বাবা, তুই জা ভালো মনে করিস। তবে আমার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।
একদিন ফাহিম বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে তিন্নির সামনে গিয়ে তাকে বলে যে আজ সে তার বাসায় গিয়ে ভাত খাবে। সে মনেমনে ঠিক করে রেখেছিল যে তিন্নি তার গালে জোরে চড় বসাক আর যাই করুক, সে ভালোবাসি বলে আসবে, কিন্তু তার সামনে যেতেই ফাহিমের হাত পা গাছের পাতার মত কাঁপতে থাকে, ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় এবং সে তিন্নিকে কেন জানি তার বাসায় গিয়ে ভাত খাবার কথা বলে।
তিন্নিও ফাহিমের এমন আবদার শুনে না হেসে পারে না। সে কথা খুঁজে পায় না। সে মনেমনে ভাবে যে এমন আজব কথা কেউ এত সহজে কিভাবে বলতে পারে? তিন্নি বলে যে ঠিক আছে তার কোনও সমস্যা নেই, ফাহিম তার সাথে যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিজস্ব বাস সার্ভিস থাকায় ছাত্র ছাত্রীদের বেশ সুবিধাই হয়েছে। ক্লাস শেষে তাই বাসে নির্দিষ্ট সিটের ব্যবস্থা করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় কারণ ছাত্র ছাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা কম। যাইহোক, ক্লাস শেষে ফাহিম তিন্নির সাথে হেঁটে গিয়ে একই বাসে উঠে। সৌভাগ্যবশত তাদের সিট পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
জীবনে অন্য কোনও মেয়ের এতোটা কাছে ফাহিম বসেছে বলে তার মনে পড়ে না। সাধারণত মেয়েরা লজ্জায় লাল অথবা গোলাপি হয়ে যায়, কিন্তু এখন লজ্জায় ফাহিমের গালদুটো রক্তজবার মত লাল হয়ে গেছে। সে তিন্নিকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতোমধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।ফাহিম তিন্নির দিকে তাকায়। মিষ্টি বাতাস এসে তিন্নির চুলগুলো বাতাসে উড়িয়ে খেলছে যেন।তার বাম হাত বাসের জানালায় ঠেস দিয়ে রাখা এবং দাঁতের মাঝখানে দুই আঙুল রাখা।
তিন্নিও খুব লজ্জাবোধ করছে সেটা ফাহিম বুঝতে পারে। একসময় সাহসিকতার সাথে ফাহিম জিজ্ঞেস করে,
- তোমার বাসা কোথায়?
- পায়রায়।
- পায়রা মানে?
- এটা দরগার ঠিক পাশেই একটা জায়গা। কখনও সেদিকে তোমার যাওয়া হয়নি মনে হয়।
- না, না, কখনও যাই নি। আসলে সিলেট আমার দাদার বাড়ি হলেও আমি এখনও অনেক জায়গা চিনি না।
- মানে? তোমার বাড়ি সিলেটে?
- হ্যাঁ, কেন? বিশ্বাস হয় না?
- কিন্তু তোমার কথা শুনলে তো বুঝা যায় না! কথায় তো সিলেটী টানও নেই!
- আমি বড় হয়েছি চট্টগ্রামে, তাই।
- তোমার বাবা কি সরকারি চাকরিজীবী?
- হ্যাঁ।
- আমাকে এখনই বাস থেকে নামতে হবে।
- ঠিক আছে, যাও। কাল দেখা হবে। বাই।
- বাই মানে? তুমি না আজ আমার বাসায় ভাত খেতে যাবা বললে?
- আরে দুষ্টুমি করেছি! তুমি কি সিরিয়াসলি নিয়েছো নাকি বিষয়টা?
- হ্যাঁ, চাইলে আসতে পারো।
ফাহিমের এতো ভালো লাগছে এই মুহূর্তগুলো যে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তার মনে হয় যদি সময় এখানেই থেমে যেত! যদি তিন্নির বাস থেকে নামার কোনও তাড়া না থাকত! যদি এভাবেই তার পাশে বসে অনন্তকাল পার করে দেয়া যেতো!
ফাহিমের চোখের সামনে দিয়ে তিন্নি হেঁটে যায় বাসের দরজার দিকে। ঠিক সেই সময় ফাহিমের মনে হয় যেন তার বুকের ভিতর থেকে কেউ তার হৃদয়টা বের করে নিচ্ছে। সে আর কোনও চিন্তা না করে মন্ত্রমুগ্ধের মত তিন্নিকে অনুসরণ করে বাস থেকে নামে।
- আরে! কি ব্যাপার? তুমি নামলে যে!
- ইচ্ছে হলো তাই নামলাম। কেন, নামা নিষেধ নাকি?
- না মানে ঠিক বুঝতে পারছি না।
- কি বুঝতে পারছ না?
- তুমি বললে যে আজ আমার বাসায় যাবে না, কিন্তু বাস থেকে নামলে, এই ব্যাপারটা।
- আমার বাসা এখানেই।
- কোথায়?
- পায়রায়।
- তুমি আমার সাথে মজা করছো না তো!
- কি যে বলো তুমি? মজা করবো কেন? সত্যি বলছি।
- পায়রায় কত নম্বর বাসা তোমার?
- চল হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। আমার বাসা এই সামনেই, যাবার সময় তোমাকে দেখাবো।
- ঠিক আছে চলো।
ফাহিম আর তিন্নি পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। তাদের মাঝে টুকটাক কথা হয়। তিন্নি যখন ফাহিমকে তার বাসা দেখাতে বলে তখন সে এইতো একটু সামনেই বলতে থাকে। আসলে ফাহিমের বাসা পায়রায় না সেটা আমরা জানি। সে বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে তিন্নির সাথে এত দূর এসেছে কারণ সে তাকে খুব বেশী ভালোবেসে ফেলেছে। তার সাথে যতক্ষণ থাকা যাবে ততক্ষণ যেন সে স্বর্গীয় সুখ পাবে।
তিন্নি তার বাসার গলিতে এসে ফাহিমকে তার বাসায় যেতে বলে কিন্তু সে অন্যদিন যাবে বলে বিদায় নেয়। বিদায় নেবার আগে সে তার দুষ্টুমির জন্য তিন্নির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়।
এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন। বাসে ফাহিম তিন্নির পাশে বসে যাবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে প্রতিদিন। তার খাওয়া দাওয়ায় কোনও মনোযোগ নেই। সে যেন প্রেমে পড়ে বাতাসে পাখীর হালকা পালকের মত উড়ে বেড়াচ্ছে। তিন্নিও ধীরে ধীরে ফাহিমের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। যদিও এখন পর্যন্ত কেউ মুখ ফুটে ‘ভালোবাসি’ বলেনি।
দেখতে দেখতে তারা থার্ড ইয়ারে উঠে যায়। অন্যদিনের মত একদিন ফাহিম তিন্নির বাসার গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তিন্নি চলে যাবার আগে তাকে বলে যে সে যদি বাসায় প্রবেশের আগে একবার তার দিকে ঘুরে তাকায় তবে এটা প্রমাণ হবে যে তিন্নি তাকে ভালোবাসে। এ কথা শুনে তিন্নি বাচ্চার মত হেসে উঠে।
তিন্নি তার বাসার দিকে রওনা হয়। ফাহিম অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে তিন্নি অবশ্যই ফিরে তাকাবে তার দিকে। তার হৃদয় যেন তবলার মত বেজে উঠছে। তিন্নি যখন তার বাসায় প্রবেশ করতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে ফাহিমের দিকে ফিরে তাকায়, তার ঠোঁটের কোণে ভিঞ্চির কালজয়ী সৃষ্টি মোনালিসার মত মুচকি হাসির ছটা লেগে থাকে।
ঠিক এ দৃশ্য দেখার আশায় তালগাছের মত দাঁড়িয়ে ছিল ফাহিম। সে যেন এ পৃথিবীর কেউ নয়। তার মনের অনুভূতিগুলো যেন এ্যালবাট্রস পাখীর মত বিশাল ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। সে এতই খুশী যে তার মনে হয় সে এক লাফ দিয়ে আকাশ ছোঁবে। যেন পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। সবই অর্জন করা যায় যদি দৃঢ় সঙ্কল্প এবং ধৈর্য থাকে মনে।
সেই রাতে খুশীর জোয়ারে ফাহিমের এক ফোটাও ঘুম হয়নি। এখন প্রতিদিন তিন্নির সাথে বাসে করে যাওয়াটা তার কাছে পানি পান করার মত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অতঃপর দুজন দুজনার প্রেমে এতই আচ্ছন্ন হল যে কেউ কাউকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
যখন দুজন আলাদা থাকে তখন ফোনে অনবরত কথা চলতেই থাকে। ফোনের বিল যাতে কম আসে সেই জন্যে ফাহিম দুটো একই অপারেটরের সিম কিনে একটা তিন্নিকে উপহার দিয়েছে। যে কোনও বিশেষ দিনে একে অন্যকে উপহার কিনে দেয়া, রিক্সায় করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানো, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া এসব চলতেই থাকে।
জ্ঞানী গুণীরা বলেন যে সুখের পরে দুঃখ আসে, কথাটার মাঝে শক্ত যুক্তির ছোঁয়া আছে।একসময় তিন্নির মা বাবা তার সাথে ফাহিমের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারে। ওনারা কোনোমতেই এটা মেনে নিতে পারেন না। তিন্নির অনেক বুঝানোর পরও কোনও ফল হয়নি।
তিন্নির বাবা মার কথাতেও যুক্তি আছে। প্রথমত ওনারা প্রেম জিনিসটাকে একটু বাঁকা চোখে দেখেন; দ্বিতীয়ত ফাহিম আর তিন্নি একই ক্লাসে পড়ে। ফাহিম তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে এখনও অনেক দুর্গম পাহাড় পর্বত অতিক্রম করতে হবে।
তিন্নি শেষ চেষ্টা হিসেবে তার ভাই এবং বোনদেরকে তার পক্ষে নিতে চেয়েছে কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয়নি। পরিস্থিতি হঠাৎ করে এতো খারাপ হয়ে গেছে। যেন ঝলমল হাসিতে পরিপূর্ণ সূর্য মুহূর্তেই এক প্রকাণ্ড মেঘের আড়ালে পরার ফলে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেছে।
আর কোনও কুল কিনারা না দেখে ফাহিম সিদ্ধান্ত নেয় যে সে তিন্নিকে নিয়ে পালাবে। এ ব্যাপারে তিন্নির মত জানতে চাইলে সেও রাজি হয়। কবে, কোথায়, কিভাবে দেখা করবে এবং চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হবে সবকিছু ফাহিম আগে থেকে তিন্নিকে বুঝিয়ে দেয়।
অতঃপর সেই দিনটি বাতাসে উড়ে আসা ঝরা পাতার মত এসে উপস্থিত হয়। দুজনে রাতের ট্রেনে করে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছে। ওদিকে তিন্নির পরিবারে রীতিমত ঘূর্ণিঝড় বইতে থাকে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না যে তিন্নি গেছে কোথায়?
ফাহিমের মা তিন্নির মাকে ফোনে আশ্বস্ত করেন যে তিন্নি ওনার বাসায় আছে। তিনি ওনাকে কোনও প্রকার দুশ্চিন্তা না করতে বলেন। একদিন পরেই ফাহিমের বড় ভাই কাজী ডেকে তিন্নি এবং ফাহিমের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বিয়েটা এভাবে একটু দ্রুততার সাথে করানোর কারণ হচ্ছে যে ফাহিমের মনে সংশয় ছিল তিন্নির পরিবার চট্টগ্রামে এসে যদি তিন্নিকে জোর করে নিয়ে যায় তাই।
পরের দিন তিন্নির বাবা, মা এবং ভাই এসে উপস্থিত হয় ফাহিমের বাসায়। স্বাভাবিকভাবেই তিন্নির মা খুব কষ্ট পেয়েছে এবং মেয়েকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। যাইহোক, বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন আর কিছুই করার নেই।
ফাহিমের মা বাবা তিন্নির মা বাবাকে খুব আন্তরিকতার সাথে বিদায় দিয়েছে। যাবার আগে তিন্নির মা ফাহিমকে বলেছে যে সে এবং তিন্নি যাতে সিলেটে ফিরে পড়াশুনাটা চালিয়ে যায়। ফাহিম ওনাকে কথা দিয়েছে যে খুব শীঘ্রই দুজন সিলেটে ফিরে যাবে।
সিলেটে ফিরে ফাহিম তার মেসে আর তিন্নি তার মায়ের বাসায় উঠে। আপাতত আলাদা বাসা নেয়ার মত সাধ থাকলেও সাধ্য তাদের নেই। কি আর করা? তবে প্রায়ই ফাহিম শ্বশুরবাড়ি যায়। দু একদিন থাকেও সেখানে। এভাবে দেখতে দেখতে ফাহিম এবং তিন্নি অনার্স ফোর্থ ইয়ারে উঠে যায়। ইতোমধ্যে তিন্নি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। যেই মুহূর্তে দুজনের পড়াশুনা এবং পরীক্ষা দিয়ে ভালো চাকরি জোগাড় করা এবং একটা ভালো বাসা নেয়ার চিন্তা, ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের জীবনে নতুন অতিথির আগমনী বার্তা বেজে উঠেছে।
এ এক অদ্ভুত অনুভুতি! ফাহিম এবং তিন্নি একদিকে আনন্দিত, অন্যদিকে গভীরভাবে চিন্তিত এবং দুঃখী বললেও অত্যুক্তি হবে না কারণ বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে তাকে ঘিরে যেসব আনুষঙ্গিক খরচ হবে সেসব জোগানোর মত অবস্থানে ফাহিম এবং তিন্নি কেউই নেই। এমন অনুভূতি প্রকাশের জন্যই মনে হয় এমিলি হাবিবি ‘Pessoptimism’ [pessimism + optimism] শব্দটি আবিস্কার করেছেন; এর মানে হচ্ছে এই যে একজন মানুষ একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে আনন্দে হেসে উঠবেন নাকি দুঃখে কাঁদবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফাহিম এবং তিন্নির মা বাবা অবশ্যই সাহায্য করবেন কিন্তু ফাহিম ও তিন্নি কখনই অন্যের দয়ার উপর নির্ভর করতে চায় না।
যাইহোক, আল্লাহপাকের অসীম কৃপায় ফাহিম অনার্স পাস করার পরেই একটা কলেজে চাকরি পেয়ে যায়। বেতন আহামরি কিছু নয় তারপরও তা মন্দের ভালো। সে তিন্নিকে নিয়ে একটা আলাদা বাসায় উঠে। তাদের সেই ছোট্ট এবং মিষ্টি সংসার স্বর্গীয় আলোয় ভরিয়ে দিয়ে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় তারিন ফারিয়া।
পরবর্তীতে তিন্নিও একটা কলেজে চাকরি পায়। তাদের দুজনের মাস্টার্স শেষ হবার পরে আরও ভালো চাকরির আশায় বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে থাকে। ফাহিম একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ পায়।
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে একটি মেঘমালা যেমন আরেকটি মেঘমালা থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরতে থাকে, তেমনই ব্যস্ততাও যেন এই দুজন নর নারীকে একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে দূরে ঠেলে দিতে থাকে। বিয়ের আগে তাদের একে অপরের প্রতি যে মায়া, মমতা এবং ভালোবাসা ছিল, বিয়ের পরে সেসব যেন জাদুকরের কোনও ভেলকির মত হারিয়ে গেছে।
দূরত্ব বাড়তেই থাকে। ভালোবাসার স্থান দখল করে নেয় ঘৃণা, সন্দেহ এবং অবিশ্বাস। ফাহিম তার ফুটফুটে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এতদিন তালাকের সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু যখন তার কাছে মনে হয়েছে যে পানি মাথার উপর উঠে গেছে, তখন সে তালাকের মত ঘৃণ্য কিন্তু অপরিহার্য সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যায়।
তালাক হয়েছে আজ প্রায় চার মাস হয়। ফাহিমের আজও তিন্নির কথা মনে হলে বুকটা মুরুভূমিতে সূর্যের নিচে উত্তপ্ত বালির মত জ্বলে উঠে। প্রায়ই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিন্নির পাশে বসে বাসে করে যাবার কথা মনে পরে; সেই রোম্যান্টিক অনুভূতিগুলোর কথা মনে পড়ে।
তিন্নি আজ হয়তো তার পাশে সশরীরে নেই কিন্তু মনের মাঝে তাকে ঘিরে যে স্মৃতির হিমালয় জমে আছে তা কেউ কখনই নষ্ট বা ধ্বংস করতে পারবে না যতক্ষণ না মৃত্যু আসে।