বিপ্লব তার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তুখোড় ছাত্র। সে কিন্তু একজন উদীয়মান নেতাও বটে। এখানে নেতা বলতে নীতিহীন, পথভ্রষ্ট কিংবা উপরি কিছু পয়সা পকেটে পুরার মত লোভী নেতা সে নয়। সে চায় তার সাধ্যমত চেষ্টা করে মানুষের সেবা করতে। সমাজের কোনও উপকারে আসতে। যে কারণে সে খুব দ্রুত সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছে। তার শিক্ষকরাও তাকে বেশ স্নেহ করে।
বিপ্লব কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট দলের অন্তর্ভুক্ত কর্মী নয়। যেখানেই অন্যায় নামক কালসাপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সেখানেই বিপ্লব ক্রোধান্বিত সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বন্ধুরা বলে যে তার নামের সাথে তার বিপ্লবী মনোভাব একেবারে মিলে মিশে একাকার।
একদিন তার সহপাঠী জুমা নাসরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পথে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু বখাটে ছাত্রদের দ্বারা ইভ টিজিং-এর শিকার হয়। পরের দিন বিষয়টা বিপ্লবের কানে যেতেই রাগে তার মুখমণ্ডল পাকা নাগা মরিচের মত লাল হয়ে ওঠে।
বিপ্লব জুমাকে জিজ্ঞেস করে কারা এই ঘৃণিত কাজটি করেছে। কিন্তু জুমা তাকে নাম বলতে অসম্মতি জানায় কারণ সে চায় না যে এটা নিয়ে পরে আর কোনও সমস্যা হোক। মেয়েটি ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে বিপ্লব সেই বখাটেগুলোকে সহজে ছেড়ে দেবে না। সে গিয়ে সরাসরি তাদের সাথে কথা বলবে। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হবে এবং পরে সেই বখাটেরা প্রতিশোধ নিতে পারে মেয়েটিকে আরও লাঞ্চিত করার মাধ্যমে।
জুমার কাছ থেকে কোনোভাবেই বিপ্লব উত্তক্তকারীদের নাম আদায় করতে পারেনি। তবুও কোনও না কোনও ভাবে দু একদিন পর তার হাতে নামগুলো চলে আসে। সে সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন সকালে ক্যাম্পাসে গিয়ে তাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে।
এই পৃথিবীতে যেখানে মানবতা নামক গুনটি দিনদিন মরীচিকায় পরিণত হচ্ছে, হাত থেকে বেলুন ছুটে গিয়ে যেমন সুদূর আকাশে মিলিয়ে যায়, তেমনি মানুষের মন থেকে একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই বিপ্লব নামক ছেলেটি যেন মানবতার এক জলজ্যান্ত মশাল।
জুমা মেয়েটি তার কোনও আত্মীয় নয়, নয় প্রেমিকাও। তবুও নিপীড়িতের তরে বিপ্লবের মন সদা কাঁদে। যেন পৃথিবীর সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে চীনের মহাপ্রাচীরের মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্ভীক সৈনিক সে।
লোকে বলে যে শূকরেরা নাকি দল বেধে ঘুরে আর বাঘ নাকি একাই চলাফেরা করে। যারা ইভটিজিং নামক এই ঘৃণ্য কাজটি করেছে তারা দল বেধেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় আর মানুষের সুখ-শান্তি বিনাশে লিপ্ত হয়।
যাইহোক, বিপ্লব সেই দলের যে নেতা, যার নাম দুলাল, তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসে,
- আপনার নাম কি দুলাল?
- হ্যাঁ, আমিই দুলাল।
- আপনি কয়েকদিন আগে জুমা নামক একটি মেয়েকে রাস্তায় উত্যক্ত করেছেন কেন?
- কোন জুমা? কি সব আবোলতাবোল কথা বলছেন?
- দেখুন, আমি যা বলছি সত্যি বলছি। আমি প্রমাণ ছাড়া এখানে আসিনি। আমি শিশু নই যে আমাকে যা ইচ্ছা বলে বুঝিয়ে ফেলবেন।
- আমিও শিশু নই।
- আপনি কাজটি করেননি আপনার বন্ধুদেরকে নিয়ে?
- হ্যাঁ, করেছি! তো কি হয়েছে? আরও একশবার করব!
- দেখি আপনি কি করেন। আর আপনিও দেখবেন আমি কি করতে পারি।
- দেখান আপনার ক্ষমতা। আমিও দেখতে চাই পানি কতদূর গড়ায়।
বিপ্লবের মগজে যেন কেউ কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! তার সাথে থাকা বন্ধুরা তাকে শান্ত করার জন্য অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু তার রাগ কোনোভাবেই কমছে না। সে ঐ বখাটেদেরকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ার জন্য সংকল্প করে আছে।
ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীদের কানেই কথাটা পৌঁছে গেছে। বিপ্লব জুমাকে অনুরোধ করেছে সে যাতে তার সাথে থানায় গিয়ে মামলা করে; বাকিটা সে দেখবে। কিন্তু জুমা কোনোভাবেই রাজি হয় না কারণ সে এটাকে বাড়াবাড়ি বলেই ভাবছে। জুমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে উত্ত্যক্তকারীরা যদি জেলে যায়ও, পরে ঘুষ খাইয়ে বের হয়ে এসে তার আরও বড় ক্ষতি সাধন করবে। তাছাড়া বিপ্লবের পড়ালেখা এবং জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
অবশেষে অনেক বুঝানোর পরে জুমা মামলা করতে সম্মত হয়। বিপ্লবের যুক্তি হচ্ছে এই যে সাপের বিষদাঁত সময়মত না ভাঙ্গলে পরবর্তীতে সেই সাপকে কাবু করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মামলা করা শেষ। বলাই বাহুল্য যে এতে সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছে বিপ্লব। কেউ নতুন প্রেমে পড়লে যেমন কারণে অকারণে হেসে ওঠে, তেমনই অবস্থা হয়েছে তার। তার মনে হচ্ছে সে যেন কোনও ছোটখাটো যুদ্ধ জয় করেছে। এখন পুলিশ প্রশাসন ওনাদের কাজ ঠিকঠাক মত করলেই হয়।
দুলালসহ তার চ্যালারা জেলের চার দেয়ালের ভিতর এমনভাবে বন্দী যেন খাঁচার ভিতরে পাখী। যাইহোক, কয়েকদিন পরেই খাঁচার পাখী আকাশে উড়ে বেড়াতে শুরু করে। মানে বখাটের দল জামিনে বের হয়ে মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে।
এ খবর বুলেটের গতিতে পৌঁছে যায় বিপ্লব এবং জুমাসহ অন্যান্যদের কানে। সবার মুখ ঝরা পাতার মত শুকিয়ে মলিন হয়ে গেছে। অন্যদিকে দুলাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে যে কোনও প্রকারে এ অপমানের প্রতিশোধ নেবেই।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা বিপ্লব তার কয়েকজন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হলে অপরিচিত কিছু যুবক ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদেরকে অতর্কিতে হামলা করে। সবচেয়ে ভয়ানক হামলার শিকার হয় বিপ্লব নিজে।
প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের সহায়তায় তারা নিকটবর্তী হাসপাতালে যেতে সক্ষম হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আখলাক নামে একজন মারা যায়। ইতোমধ্যে বিপ্লবের সহপাঠীরা জানতে এ ঘৃণ্য হামলার ব্যাপারে জানতে পেরেছে। তারা হাসপাতালে রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। হাসপাতালের ভিতরে এবং বাইরে মানুষ আর মানুষ; সবাই মৌমাছির মত গিজগিজ করছে।
অগ্নিগিরির জ্বালামুখে পরিণত হয়েছে হাসপাতালটি। একেকজন শুভাকাঙ্ক্ষী যেন একেকটা জলজ্যান্ত বোমা। যেন মুহূর্তেই ফেটে পড়বে। সৌভাগ্যজনকভাবে বিপ্লবসহ বাকী সবাইকে ডাক্তার আসঙ্কামুক্ত বলেছেন।
পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি একটি ছোটখাটো রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। সবার মুখে গতকালের সেই নিন্দনীয় হামলার কথা। কে বা কারা করেছে তা দিনের আলোর মতই পরিস্কার সবার কাছে।
কিছুক্ষণ পরপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বেশ বড়সড় মিছিল বের হতে থাকে। তারা চায় আগামী সাত দিনের মধ্যে হামলাকারীদেরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদেরকে চিরতরে বহিস্কার করতে হবে।
যদি তা না করা হয়, সেই ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বর্জন করবে। এককথায় বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেয়া হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা যেটা বলে সেটা করে দেখায়। তাদের ভিতরে ছাই চাপা আগুন থেকে ভয়াবহ দাবানলের সূত্রপাত হতে চোখের পলক পড়তে যতক্ষণ লাগে ঠিক ততক্ষণ লাগবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের কানে ছাত্র ছাত্রীদের শর্তগুলো পৌঁছে যায় ঝড়ের গতিতে। একের পর এক রুদ্ধদ্বার মিটিং চলতে থাকে। যে কক্ষটিতে সভা চলছে সেটার ঠিক বাইরে ছাত্র ছাত্রীরা মৌমাছির মত জড়ো হয়ে স্লোগানের পর স্লোগান দিতে থাকে।
যেন পৃথিবীর সকল ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, হতাশা এবং ঘৃণা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিশ্রামরত পাখীর মত ডানা গুটিয়ে বসে আছে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার টানা মিটিং-এর পর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন যে ঐ বখাটে ছাত্রদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে বহিস্কার করা হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কথাটা অপেক্ষারত ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে পৌঁছানোর সাথে সাথে তা স্ফুলিঙ্গের মত অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। সহপাঠী হারানোর ব্যথা যেন মুহূর্তেই আনন্দের বন্যায় পরিণত হয়েছে। কারণ মৃত সহপাঠীর আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে এই সুবিচারের ফলে।
কিন্তু ঐসব বখাটেরা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার ফলে বিষয়টা নিয়ে অন্যরকম নোংরা রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। তাদেরকে বাঁচানোর জন্য ঐ দলের নেতারা রীতিমত উঠেপড়ে লেগেছে।
বখাটেরা অনেকদিন ধরে গ্রেপ্তার না হওয়াতে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা আবার রাগে ক্ষুধার্ত বাঘের মত গর্জে ওঠে। প্রায় প্রতিদিন মিছিল বের হতে থাকে। ইতোমধ্যে বিপ্লব সুস্থ হয়ে ফিরে জাহাজের ক্যাপ্টেনের মত মিছিলের হাল ধরে।
তাদের মিছিলের বিরুদ্ধে বহিষ্কৃত ছাত্রদের পক্ষে আরেকটি মিছিল বের হয়ে যায়। অন্য এলাকার সিংহকে দেখলে যেমন নিজ এলাকার সিংহ তার উপর ক্ষুধার্ত হায়েনার মত হামলে পড়ে, ঠিক তেমনি মুখোমুখি হওয়া দুটি মিছিলে অংশ নেয়া ছাত্র ছাত্রীদের মনের অবস্থা সহজেই বুঝা যায়।
ন্যায়ের পতাকা হাতে যারা লড়ছে তাদের উপর শকুনের মত অতর্কিতে হামলে পড়ে অন্যায়কারীদের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে যারা। একপর্যায়ে বৃষ্টির মত বুলেট বর্ষিত হতে থাকে। কান্না আর গোঙ্গানোর শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে।
যে যার মত এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কয়েকটা নিস্তেজ দেহ রাস্তার উপর মরে থাকা কাকের মত পড়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘটনার পর অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। বিচার নামক গুপ্তধনের দেখা আজও মেলে নি!