বিড়ালনামা! [Story]

শিকদার আহমেদ একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। পরিবার নিয়ে থাকেন সিলেটের বড়বাজার নামক এলাকায়। পরিবারের সদস্য বলতে মাত্র তিনজন- তিনি, ওনার স্ত্রী ফারহানা খন্দকার আর ওনাদের বড়ই আদরের কন্যা অর্পিতা খন্দকার। সে এলাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে।  

 

যে বাড়িতে থাকেন সেটা শিকদারের নিজস্ব নয়; ভাড়া বাসা। এখানে আছেন প্রায় তিন বছর ধরে। এলাকার মানুষ ওনাকে বেশ সমীহ করে। এই পরিবারটির ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন একজন ডাক্তার। ওনার নাম আজগর আলী। ওনার বিয়ে হয়েছে মাত্র এক বছর হল।

 

শিকদার এবং আজগরের মধ্যে বেশ ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দুই পরিবার যেন দুটি শরীরে গড়া কিন্তু আত্মা একই। একদিন শিকদারের মেয়ে অর্পিতা স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার ধারে একটি বিড়ালছানা পড়ে থাকতে দেখে। বিড়ালটি যেন এতক্ষণ তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

 

বিড়ালটি দেখতে এতই আদরের যে অর্পিতার মনে এটার জন্য মায়া জেগে ওঠে। সে আলতো করে বিড়ালটিকে দুই হাতের তালু দিয়ে তুলতেই বিড়ালটি মেয়াওবলে ডেকে ওঠে। তখন অর্পিতার চোখে মুখে কি যে আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়েছে তা বলে বুঝানো প্রায় অসম্ভব!

 

বিড়ালটিকে নিয়ে ফেরার পথে সেটা সুবোধ শিশুর মত চুপচাপ বসে ছিল। কোনও ধরণের নড়াচড়া বা উপদ্রপ করেনি। অর্পিতা বেশ খুশী এই ভেবে যে তার একজন খেলার সঙ্গী জুটেছে। কিন্তু পাশাপাশি এক ধরণের আশঙ্কা এবং ভয় তাকে গ্রাস করছে কারণ আম্মু এবং আব্বু যদি বিড়ালটিকে অপছন্দ করেন; যদি এটাকে বাইরে রেখে আসতে বলেন।

 

কলিং বেল বাজতেই মা দরজা খুলে দিলেন। পূর্ণ প্রস্ফুটিত শাপলা ফুলের মত অর্পিতার মুখে প্রশস্ত হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েছে। মায়ের চোখ বিড়ালটির উপর পড়েছে।

 

- অর্পিতা, তুই এটা কোথায় পেলি?

 

- আমি রাস্তার ধারে এটাকে পড়ে থাকতে দেখলাম। এটার জন্য খুব খারাপ লাগল, তাই সাথে করে নিয়ে এলাম। খুব cute না দেখতে?

 

- Cute না ছাই! তুই কাজটা একদমই ঠিক করিস নি।

 

- একটা বিড়াল ছানাই তো এনেছি। চুরি ডাকাতি তো আর করিনি।

 

- আমি এসব একদম পছন্দ করি না। তাছাড়া তোর বাবারও পছন্দ নয়।

 

- তুমি আমায় এটা রাখতে দাও না মা, প্লিজ! বাবাকে আমি রাজি করাব। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।

 

- আমি কিচ্ছু জানিনা। তোর যা ইচ্ছে হয় কর।

 

        সেদিন রাতে শিকদার বাসায় ফিরে কলিং বেল চাপতেই অর্পিতা তাড়া খাওয়া কোনও প্রেতাত্মার মত তার রুম থেকে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিয়েই বাবা বলে ওনাকে জড়িয়ে ধরে। শিকদার এমন অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনায় একটু অবাকই হয়।

 

- বাবা, তোমার সাথে একটা খুব জরুরী কথা আছে।

 

- তোমার সব কথা আমি শুনব। কিন্তু তার আগে আমি একটু ফ্রেশ হই, ঠিক আছে?

 

- ঠিক আছে বাবা।

 

        কিছুক্ষণ পরে শিকদার ড্রইং রুমে এসে টিভিটা চালু করতে না করতেই অর্পিতা এসে পাশে বসে।

 

- কি ব্যাপার আম্মু! পড়া শেষ নাকি?

 

- হ্যাঁ বাবা।

 

- কি যেন বলতে চাইছিলে?

 

- বাবা, আজ আমি একটা বিড়ালছানা কুড়িয়ে পেয়েছি।

 

- তাই নাকি? কোথায়, কিভাবে?

 

- স্কুল থেকে আসার সময়।

 

- তো এখন আমি কি করতে পারি?

 

- আমি কি সেটা পুষতে পারি?

 

- পুষবে? বিড়ালছানা?

 

- হ্যাঁ।

 

- ঘরদোর নোংরা করবে, খাবার দাবার নষ্ট করবে যে।

 

- করবে না। আমি ঠিক করে দেখে রাখব।

 

- তোমার মার কি মত?

 

- মা তো বলল তোমাকে রাজি করতে।   

 

- আচ্ছা কিছুদিন দেখা যাক। পরে যদি কোনও সমস্যা হয় তাহলে কিন্তু বাইরে ছেড়ে আসব, ঠিক আছে?

 

- ঠিক আছে বাবা। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আই লাভ ইউ বাবা।

 

- লাভ ইউ টু।

 

        দেখতে দেখতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। সেই ছোট্ট বিড়ালছানা আজ শিকদার পরিবারের স্থায়ী সদস্য হয়ে গেছে। বিড়ালটি উপদ্রপ যে একেবারে করে না তা নয়, তবে এটার উপদ্রপও এখন মধুর লাগে। দুধ দেয়া গাভীর লাথি যেমন গা সওয়া হয়ে যায় অনেকটা সেই রকম।

 

        কিন্তু জীবন তো আর রুপকথার কোনও গল্প নয় যেখানে সবকিছু নিজের মন মত হবে। জীবন পাথরের মত কঠিন, আগুনের মত তীব্র এর উত্তাপ; নিজে পোড়ে না সে অন্যকে পোড়ায় অনবরত।

       

        পাখীর বাচ্চার নতুন পাখা গজালে যেমন একটু পর পর লাফিয়ে বেড়ায়, উড়তে চায়, ঠিক তেমনি বিড়াল ছানাটি বড় হবার পর থেকে যেন অনেকটা বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেটা আর চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকতে চায় না। সেটা বাইরে যেতে চায়। পৃথিবীটাকে দেখতে চায়। একজন মানুষকে জেলখানায় বন্দী করে রাখা যায় ঠিকই, কিন্তু তার চিন্তাকে, তার কল্পনাকে বন্দী করা অসম্ভব। একটি পাখীকে দিনের পর দিন খাঁচায় বন্দী করে রাখা যায় ঠিকই, কিন্তু এতে করে পাখীটির আকাশে নিজের রাজত্ব কায়েম করার সাধ থেকে বিরত রাখা অসম্ভব, তার উড়তে পারার সক্ষমতাও নষ্ট করা যায় না। ঠিক তেমনই বিড়ালটির বাইরে যাবার প্রবণতা দোষের কিছু নয়। এটা তার সহজাত প্রবৃত্তি।

 

ইদানীং বিড়ালটি শিকদারের ঘরে কমই থাকে। সারাদিন কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার পাশের ঘরের আজগরের কাজের বুয়া রহিমা বিড়ালটিকে ঘরের ভিতর থেকে ধরে এনে অর্পিতার মার কাছে দিয়েছে। রহিমা ওনাকে আকারে ইঙ্গিতে সাবধান করে দিয়েছে। ফারহানা বুঝতে পেরেছে যে পাশের বাসার দরজা খোলা থাকলেই বিড়ালটি ঢুকে যায় ভিতরে এবং ওনাদের বিরক্তির কারণ হয়।

 

অর্পিতার বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি তিনি। অর্পিতাকে বুঝিয়ে বলেছে বিষয়টা। বিড়ালটির যখন তখন পাশের বাসায় চলে যাওয়াটা মোটেই কাম্য নয়, অর্পিতাও বিষয়টা অনুভব করেছে। কিন্তু সমাধান কি? কেউ তা জানে না। বিড়ালটিকে এভাবে ছেড়ে দিলে এমনটি চলতেই থাকবে; আবার এটাকে বেঁধেও রাখা যাবে না। এটাকে বাইরে ফেলে আসার কথা অর্পিতা কল্পনাও করতে পারে না।

 

কয়েকদিন পর এক আজব কাণ্ড ঘটেছে। দিনটি হচ্ছে শুক্রবার। আজগর সাহেবের বাসায় ওনার শ্বশুর বাড়ি থেকে মেহমান এসেছেন। জুমার নামাজ পড়ে সবাই ড্রয়িং রুমে বসে খোশগল্প করছিলেন। ওনার স্ত্রী আশা রহমান টেবিলে খাবার দাবার সাজিয়ে মেহমানদেরকে ডাকতে যান এসে খাওয়া শুরু করার জন্য। সবাই যখন টেবিলের কাছে আসেন তখন দেখতে পান যে বিড়ালটি টেবিলের ঠিক মাঝখানে রাখা মুরগীর মাংসের একটা রান খুব আরাম করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে! যেন এত সব খাবারের পসরা শুধুমাত্র বিড়ালটির জন্যই।    

 

        এই দৃশ্য দেখার পর মেহমানদের মধ্যে সবাই একে অন্যের দিকে তাকাতে থাকেন। আজগর তখন অজগর সাপের মত রাগে ফুঁসতে থাকেন। তিনি রহিমাকে বিড়ালটি ধরার জন্য নির্দেশ দেন। ঘুমন্ত কোনও শিশুর কানের কাছে যদি কেউ একটা বড় ধরণের আওয়াজ করে তখন শিশুটি যেমন ভয়ে কেঁপে ওঠে, বিড়ালটিও তেমনি ভয় পেয়ে ফুটন্ত পপকর্নের মত দিকবিদিক লাফাতে থাকে। টেবিলের উপরেই বেশীরভাগ লাফালাফির ফলে অন্যান্য বাটিতে রাখা তরকারির ঝোল ছিটকে এসে পড়ে মেহমানদের দামী কাপড়চোপড়ে।

 

        সবার মুখ গম্ভীর। ফুটন্ত তেলে মসলা লাগানো কই মাছ ছেড়ে দিলে যেভাবে তেলের তেজ বোঝা যায়, আজগরের রাগও তেমনি চোখ মুখ থেকে যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। কার্ফু মাছের গায়ের রক্তিম রঙের মত ওনার চোখ লাল হয়ে আছে।

 

        বিড়ালটি একপর্যায়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আজগর হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে রান্নাঘর থেকে একটি দা নিয়ে পাগলের মত বিড়ালটিকে তাড়া করতে করতে শিকদারের ঘরে গিয়ে ঢুকেন। আশাও তখন আতংকিত হয়ে স্বামীকে থামানোর জন্য পিছু নেন। আজগর বলেন,

 

- হারামজাদা বিলাই! আজ এই শয়তান বিলাইর একদিন কি আমার একদিন!

 

        আজগরের আকাশ পাতাল কাঁপানো চিৎকারে হতভম্ব হয়ে শিকদার বেডরুম থেকে রীতিমত দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান। তিনি কিছু বলার আগেই আজগর বলেন,

 

- আপনার বিলাইটাকে আজ আমি দুই টুকরা করব।

 

- মুখ সামলে কথা বলুন। বিলাই কি? বিড়াল বলুন, বিড়াল

 

- বিলাই বলেছি তো কি হয়েছে? একশ বার বলব বিলাই!

 

- আপনি একটা গরু!

 

- আপনি একটা ভেড়া!

 

- আপনি একটা ইঁদুর!

 

- আপনি একটা বাদুড়!

 

- ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!

 

- কি করবেন আপনি?

 

- আমি আপনার নামে মামলা করব।

 

- আরে, আপনি কি মামলা করবেন? আমিই আপনার নামে মামলা করব?

 

- আপনি ভদ্রলোকের মত আচরণ করুন।  

 

- আপনি কি বলতে চান? আমি অভদ্র?

 

- অভদ্র না তো কি?

 

- আপনি অভদ্র! আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী অভদ্র!

 

- I say shut up!

 

- আরে রাখেন আপনার ছাতার ইংরেজি!

 

- আপনি একটা হাতুড়ে ডাক্তার!

 

- আপনি একটা হাতুড়ে শিক্ষক!

 

- হাতুড়ে শিক্ষক আবার হয় নাকি?

 

- হয়, হয়! হাতুড়ে ডাক্তার হলে হাতুড়ে শিক্ষক হতে সমস্যা কোথায়?

 

- দিনে দুপুরে আপনি একটা দা হাতে এভাবে আরেকজনের বাসায় ঢুকে হুমকি ধামকি দিবেন! পেয়েছেন কি আপনি? আমরা কি ভেসে এসেছি নাকি?

 

- আপনি নিজের বিলাই সামলে রাখতে পারেন না আবার ইংরেজি মারেন!

 

- আপনি বস্তির মানুষের মত কথা বলছেন কেন?

 

- কি? আমি বস্তির মানুষ?

 

- হ্যাঁ, আপনি বস্তির মানুষ! আপনার আচার ব্যবহারে তো মনে হচ্ছে আপনার ডাক্তারি সনদও ভুয়া!

 

- আপনি ভুয়া! আপনার পিএইচডি ভুয়া!

 

- ভুয়া ডাক্তার!

 

- ভুয়া মাস্টার!

 

        নিচতলার মানুষদের কানেও কথাটা পৌঁছে গেছে দ্রুত গতিতে। লোকে বলে যে খারাপ খবর নাকি বিদ্যুতের গতিতে ছড়ায়। যাইহোক, যার কানেই এই বিড়াল বিষয়ক ঝগড়ার ব্যপারটা গিয়েছে, সেই চোখের সামনে বাঁদর নাচন দেখার মত আনন্দ লাভ করেছে। বাড়িওয়ালা দুই পরিবারকেই পৃথকভাবে সাবধানবানী পাঠিয়েছে। তিনি মোটেও চান না ওনার বাড়ির সর্বোপরি এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হোক।       

 

        পরদিন সকালে শিকদার পুলিশসহ উপস্থিত। তিনি থানায় মামলা করেছেন এই বলে যে তিনি এবং ওনার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কারণ পার্শ্ববর্তী পরিবারের কর্তা গতকাল দা নিয়ে এসে ওনাকে হুমকি দিয়ে গেছেন।

 

        আজগর গতকালের ব্যবহারে মনে মনে কিছুটা অনুতপ্ত ছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করে রেখেছিলেন যে শিকদারের সাথে দেখা করে ‘sorry’ বলবেন। কিন্তু শিকদারের এই অবিবেচক কাণ্ড দেখে ওনার মেজাজ যেন এভারেস্টের চূড়ায় উঠে গেছে।

 

        ওনার বাসায় পুলিশ! এটা আজগর কোনও  মতেই মেনে নিতে পারছেন না। এটা যে কত বড় অপমানের বিষয়! এলাকায় ওনার নাক কাটা যাবে। ওনার শ্বশুরবাড়ির মেহমানদের সামনেই ঘটছে এসব। পুলিশদের মধ্যে পেটমোটা গম্ভীর দেখতে একজন আছেন। ওনার গোঁফ দাকাত সর্দারের মতন। তিনি সামনে এসে আজগরকে বললেন,

 

- আপনি আজগর?

 

- জী, বলুন।

 

- আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে।

 

- অভিযোগ? কিসের অভিযোগ? আমিতো কোনও অপরাধ করিনি!

 

- আপনার প্রতিবেশী শিকদার আপনার নামে মামলা করেছেন।

 

- মামলা? কেন?

 

- আপনি নাকি দা নিয়ে দৌড়ে গেছেন ওনাকে মারার জন্য।

 

- রাগের মাথায় দা নিয়ে গেছি ঠিকই, তবে ওনাকে মারার জন্য না, ঐ বিলাইটাকে শায়েস্তা করার জন্য।

 

- আপনার যা বক্তব্য আছে আপনি তা থানায় গিয়েই বলুন। আপনাকে এখনই আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।

 

 

        সেই মামলা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় অবশেষে। পরবর্তীতে আজগরও শিকদারের নামে একটা মামলা ঠুকে দেন। বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে এলাকাবাসীরা দুজনকেই অনেক বুঝানোর পরও কেউই মামলা তুলে নিতে নারাজ। দুজনেরই এক অভিযোগ- আত্মসম্মানে আঘাত এসেছে। সূর্যের কাজে যেমন বিরতি নেই, ঠিক তেমনি এই আজব মামলা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড চলতেই থাকে, দিনের পর দিন...       

View kingofwords's Full Portfolio