গ্রামের মানুষ সুখী বেগমকে অলক্ষ্মী বলে ডাকে কারণ বিয়ের প্রায় ৭ বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনও তার কোল আলোকিত করে কোনও ফুটফুটে বাচ্চা আসেনি। সবাই এর জন্য তাকেই দোষারোপ করে।
সুখীর স্বামী কেরামত খাঁ গ্রামের পাশ দিয়ে দীর্ঘ সাপের মত বয়ে চলা নদীতে মাছ ধরে। সেই মাছ বিক্রি করে যে কয়টা পয়সা পকেটে আসে সেগুলো দিয়ে আর যাই হোক সংসার নামক কারখানা চলা অসম্ভব।
অভাব অনটন যেন এই পরিবারের নিত্যসঙ্গী। সুখীর নামটা যদিও সুখী কিন্তু সে যে তার মনের গভীরে কত কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তা একমাত্র আল্লাহ্ পাকই জানেন। স্বামীর ভালোবাসা নামক পরশপাথরের দেখা সে আজ পর্যন্ত পায়নি।
কোনও কোনও দিন যদি স্বামী স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হয়, কেরামত সেই সুযোগে সুখীকে বাচ্চার মা না হতে পারার জন্য একতরফাভাবে দায়ী করে। প্রায়ই এই বিষয় নিয়ে তাকে আলপিনের মত খোঁচা সহ্য করতে হয়।
একদিন সুখীর শাশুড়ি মিষ্টি আক্তার তো তার সামনেই কেরামতকে বলে বসেছে আর একটা বিয়ে করতে। সুখী নাকি অভিশপ্ত! তিনি যখনই সুযোগ পান, পাড়ার মানুষদেরকে ডেকে বৌমার বদনাম করেন। কোনও কোনও মানুষ যেমন খাঁচায় বন্দী পাখীকে খুঁচিয়ে মজা পায়, ঠিক তেমনি সুখীর শাশুড়ি স্বর্গীয় সুখ লাভ করেন সুখীকে কষ্ট দিয়ে।
ইতোমধ্যে সুখী বেশ কয়েকবার চিন্তা করেছে যে ঐ নদীতে ঝাপ দিয়ে নিজের এই ছুড়ে ফেলা টিস্যুর মত মূল্যহীন জীবন শেষ করে ফেলবে। কত রাত যে সে নির্ঘুম কাটিয়েছে তার খোঁজ কি কেউ রেখেছে। রাতের পর রাত নিদ্রাহীন থাকতে থাকতে তার হলুদ বরণ যেন কয়লায় পরিণত হয়েছে। চোখ দুটো যেন ছোটখাটো দুই কুয়া। খাবার দাবার সম্পর্কে উদাসীন। জীবনের মায়া যেন আর নেই।
সুখী জন্মের আগেই তার বাবাকে হারানোর পর থেকে তার মা-ই তার বাবার দায়িত্ব পালন করেছে। কখনও বাবার অনুপস্থিতি বুঝতে দেয় নি তাকে। মা-ও হয়তো বাবার টানে কয়েকমাস আগে পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন। সুখীর এমন করুণ অবস্থা দেখলে তার মা হয়তো সাথে সাথে হার্টফেল করতেন।
মাকে খুব বেশী মিস করে সুখী। তার মা তার বন্ধুর মত ছিল। কোনও কিছুই লুকাত না সে মায়ের কাছে। এখন তার দুঃখের কথা কাউকে বলার মানুষ আর নেই। টিকটিকির লেজ কাটা পড়লে সেই লেজ যেমন কিছুক্ষণ ছটফট করে, সুখীর প্রাণটাও যেন তেমনই ছটফট করছে। সে যেন মহাসমুদ্রে একটা বৈঠাহীন নৌকার মাঝি। জীবন নামক মহাসমুদ্রের সহস্র কণ্টকাকীর্ণ স্রোতের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আজ সে মৃতপ্রায়।
মানুষ স্বপ্নে বাঁচে, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। সুখীর স্বপ্ন নেই তাই বাঁচার সাধও নেই। বিয়ের পরবর্তী কয়েকমাস খুব ভালোই কেটেছিল। কিন্তু সংসারে অভাব অনটন নামক ভুত প্রবেশ করার সাথে সাথেই ভালোবাসা বা ভালো লাগা দরজা, জানালা এমনকি ঘরের বেড়া দিয়ে পালিয়েছে।
এমনিতেই হাজারো অপমান সহ্য করতে হয় সুখীকে। তার উপর তার শাশুড়ি মিষ্টি আক্তারের সেবা করতে করতে তার জীবন পাখী খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড়। বছরের প্রায় ছয় মাসেই তিনি শয্যাশায়ী থাকেন। এমনিতেই সংসারের চাকা কাঁদায় আটকে থাকা গরুর গাড়ির মত হয়েছে। তার উপর শাশুড়ির জন্য এই ওষুধ সেই ওষুধ কেনার যন্ত্রণা।
বিয়ের কয়েকদিন পরে তার মায়ের সাথে কোনও বিষয়ে ঝগড়া বিবাদ হলে কেরামত তার বউয়ের পক্ষ নিতে পিছপা হতো না। কিন্তু যখন থেকে সুখী বাচ্চা প্রসবে ব্যর্থ হলো তখন থেকে তার জীবন এক জলন্ত চুল্লীতে পরিণত হলো। স্বামী আর শাশুড়ির দ্বিমুখী আক্রমণে সুখীর অবস্থা হলো ঢেঁকিতে গুড়ো করা চালের মতন।
এক রাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সুখী বলে,
- তুমি আরেকটা বিয়ে করো।
- বিয়ে করো বললেই হয়ে যায়? এমনিতেই সংসার চলে না, তার উপর আবার বিয়ে?
- আমরা না হয় আরেকটু কষ্ট করে দিন কাটিয়ে দিবো। কিন্তু তুমি তখন বাবা হতে পারবে, তোমার মুখে হাসি ফুটবে, মায়ের মন শান্তিতে ভরে উঠবে।
- এইসব কথা বাদ দাও। ঘুমাও, সকালে অনেক কাজ আছে।
আরেকটা বিয়ের সাধ যে কেরামতের মনে জাগেনি তা নয়। কিন্তু সে নিরুপায়। একদিন তার মা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। প্রায় তিন দিন ধরে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে থাকেন। কেরামত তার সব কাজ বাদ দিয়ে তার এই বৃদ্ধ মায়ের কাছে অতন্দ্র প্রহরীর মত বসে থাকে। যেন একটু চোখের আড়াল হলেই মা সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রজাপতির মত উড়ে যাবে। অবস্থা এতই গুরুতর যে ডাক্তাররা ধরেই নিয়েছেন যে তিনি আর বাঁচবেন না। আল্লাহ্র অশেষ কৃপায় তিনি সে যাত্রায় বেঁচে যান। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় মিষ্টি আক্তার তার ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
- তুই আমার একটা কথা রাখবি?
- কি কথা মা?
- আগে বল রাখবি কি না?
- আচ্ছা রাখবো, বলো।
- তুই আরেকটা বিয়ে কর।
- এসব তুমি কি বলো মা?
- আমি ঠিকই বলছি। আমার সময় আর বেশী দিন নেই রে কেরামত। যাবার আগে আমি তোর সন্তানের মুখ দেখে যেতে চাই।
- এসব আজেবাজে কথা বন্ধ করো তো মা।
- তুই কি চাস যে মরার পরে আমার আত্মা অশান্তিতে থাকুক।
- তা কেন চাইবো?
- তাহলে তুই আমার কথার অবাধ্য হবি না বল।
- আচ্ছা হবো না। খুশী এখন?
লাল টুকটুকে শাড়ি পরে, সাদা মেঘের মত পায়ে রক্তজবার মত আলতা মেখে, ঘোমটার আড়ালে পুরো মুখ ঢেকে নতুন বউয়ের প্রবেশ হয় ঘরে। নাম তার চন্দ্র সুলতানা। সুখী তার আচার আচরণে কখনও হিংসা বা ঘৃণা প্রকাশ করে না। সে এটাকেও নিয়তির একটা জটিল খেলা হিসেবেই দেখছে। জীবনের আর যে কয়েকটা দিন দেখার বাকি আছে, সেগুলো সে রাত্রির নিরবতার মত পার করে দিতে চায়।
চন্দ্র একটু দাম্ভিক প্রকৃতির মেয়ে। যদিও সে বাড়ির দ্বিতীয় বউ, কিন্তু স্বামীর ঘরে প্রবেশের এক সপ্তাহের মধ্যে তার আসল তেজ সবাই অনুভব করতে শুরু করে। সে যেন এক সরিষায় গড়া মানুষ! যাইহোক, সকলেই তার কর্তৃত্বপরায়ণতা সানন্দে মেনে নিয়েছে। এবং এর পেছনে কারণ শুধু একটাই- ভবিষ্যৎ সন্তানের আগমন ঘটবে যে তার মাধ্যমেই।
কিন্তু আল্লাহ্র লীলা খেলা কি বোঝা এতো সহজ? মরুভূমিতে বালিরাশি যেমন একটু একটু করে বাতাসের ছোঁয়ায় এক স্থান হতে আরেক স্থানে যায়, তেমনি করে সময় ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। কিন্তু চন্দ্রের মা হবার সাধ মিটে না। ইতোমধ্যে কেরামতের মা মারা গিয়েছেন। মায়ের অনুপস্থিতি ছেলে কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তার উপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত যোগ হয়েছে এলাকাবাসীর খোটা আর ঠাট্টা।
পাড়া প্রতিবেশীর মানুষ বাচ্চা না হবার কারণ হিসেবে একতরফাভাবে সুখীর দিকেই আঙ্গুল নির্দেশ করেছে এতোদিন। হাত থেকে কাঁচের তৈরি গ্লাস পড়ে গেলে যে অবস্থা হয়, তেমনই অবস্থা হয়েছে সবার চিন্তার জগতে। সবাই এখন নড়েচড়ে বসেছে কেরামতকে দায়ী করতে। হাটে-বাজারে এ বিষয়টা নিয়ে মানুষের বিকৃত আনন্দের আর সীমা নেই। যেন পৃথিবীতে আর কোনও ঘটনা ঘটছে না বা ঘটবে না। যেন কেরামতের ঘরে শিশুর জন্ম হওয়া বা না হওয়াটাই পৃথিবীতে একমাত্র আলোচ্য বিষয়।
কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বাজি ধরেছে যে কেরামত নাকি আরেকটা বিয়ে করবে। যাইহোক কয়েকদিন পরে চন্দ্র কয়েকমাসের জন্য তার মায়ের বাড়ি যেতে চাইলে কেরামত তাকে পৌঁছে দিয়ে আসে। সুখী মনে মনে ভাবে যে তার স্বামী তার হাতের নাগালেই আছে কিন্তু তবুও যেন কত দূরের একজন মানুষ সে। দৈহিক দূরত্বের চেয়ে মানসিক দূরত্বই মানুষকে বেশী কষ্ট দেয়।
চন্দ্র ঘরে থাকা অবস্থায় সুখীর সাথে কেরামতের খুব একটা কথাবার্তা হতো না। এখন চন্দ্র না থাকাতে সুখী মনে মনে বেশ আনন্দিত। তার মনে হয় যে সে তার হারানো রাজত্ব এবং রাজকুমার দুটোই ফিরে পেয়েছে যেন! অনেকদিন পর সুখী বিছানায় তার স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলছে,
- অনেকদিন তো হয়ে গেল, চন্দ্রকেতো বাসায় ফিরিয়ে আনা দরকার।
- তুমি ঠিকই বলেছো। আমিও দুই একদিন ধরে ভাবছিলাম যে তাকে নিয়ে আসবো।
- আর দেরী করা ঠিক হবে না। পরে মানুষ এটা নিয়ে হাসি তামাশা করবে।
চন্দ্রকে নিয়ে ফেরার পথে গ্রামের সাধারণ জনগণ তাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসেছে। কেরামত এটা দেখেও না দেখার ভান করেছে। কিন্তু মানব মনেরও সহ্য করার একটা সীমা আছে। একটা পালিত গরুকেও যদি কোণঠাসা করে বিরক্ত করা হয়, সেটাও একসময় তেড়ে আসতে চায় গুঁতো দেবার জন্য। কেরামত একটা ছেলেকে প্রায় চড় মেরেই বসেছিল, চন্দ্রের হস্তক্ষেপে পরে সে ক্ষান্ত হয়।
চন্দ্রের শরীরের অনেক পরিবর্তন সুখীর চোখ এড়ায় না। সে প্রায়ই বমি করে, মাথা ঘুরায়। অল্প একটু কাজ করেই ক্লান্ত বোধ করে ইত্যাদি। সুখী কেরামতকে বলেছে চন্দ্রকে একজন ভালো ডাক্তার দেখানোর জন্য।
ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে দেখা যায় যে চন্দ্র গর্ভবতী। এ কথা শোনার পরে কেরামতের আনন্দের আর সীমা রইলো না। সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তার পাগলের মত চিৎকার দিয়ে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে যে সে বাবা হবে। আনন্দের পরে যেমন দুঃখ আসে, কেরামতের জন্যও দুঃখ চোরের মত ঘাপটি মেরে বসে আছে।
এলাকার মানুষের এখন আলাপ আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হয়েছে কেরামতের বাবা হতে যাবার ব্যাপারটা। কেউ বলছে এ বাচ্চার বাবা কেরামত হতেই পারে না। কেউ বলছে যে দেরীতেও কেউ কেউ পিতা হবার সুখ লাভ করে; এ রকম হাজারো উদাহরণ আছে। কিন্তু প্রথম মন্তব্যের দিকে বেশীরভাগ মানুষের সমর্থন রয়েছে।
কিভাবে কিভাবে যেন মানুষের কানাঘুষার খবরটা কেরামতের কানে এসে পৌঁছেছে। সে শুনামাত্রই আহত বাঘের মত হুংকার দিয়ে উঠেছে। পরে যখন রাগ কমে এসেছে, তার মনেও একটু একটু করে সন্দেহ উঁকি দিতে শুরু করেছে। সে ভেবেছে যে চন্দ্র কয়েকমাস তার মায়ের বাড়ি ছিল। এ সময়টায় কি সে কোনও পাপকার্যে লিপ্ত হলো?
এখন কেরামত চন্দ্রের সাথে খুব একটা কথা বলে না। সুখীর সাথেও কথা বলে না বললেই চলে। একটা মৃত পশুকে যেমন নানা ধরণের পোকা ধীরে ধীরে খেয়ে সাবাড় করে ফেলে, তেমনি সারাক্ষণ কি একটা চিন্তা যেন কেরামতকে ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে নিঃশেষ করে ফেলছে।
অনেক ভাবনা চিন্তার পর তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলো ইসলামের পরামর্শে কেরামত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে পরীক্ষা করে দেখবে চন্দ্রের পেটে বেড়ে ওঠা বাচ্চাটির পিতা সে নাকি অন্য কেউ? এ কথা নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় খুব নীরবে সুখীর সাথে আলাপ করা অবস্থায় চন্দ্র কান পেতে সব শুনে ফেলে।
আজ কেরামত তার মা যে ঘরে ঘুমাতো, সেখানে একা শুয়ে আছে। নদীর পারে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছ থেকে পাকা তাল পড়লে যেমন শব্দ হয়, গভীর রাতে ঠিক সেইরকম একটা শব্দে কেরামতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। এরপর আর ঘুম আসে না তার। সারারাত এপাশ ওপাশ করেই কাটে তার। বাইরে অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকারা যেন কোনও উৎসবে মেতেছে। মাঝে মাঝে দু একটা খেঁকশিয়াল ডেকে উঠছে দূরে কোথাও। কেরামতের একবার মনে হয় যে চন্দ্রের ঘরে গিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়বে। পরে বেচারিকে এত রাতে ঘুম থেকে জাগানোটা ঠিক হবে না বলে সে তার ইচ্ছাকে গলা টিপে হত্যা করে।
সকালে মোরগের ডাকে সুখীর ঘুম ভাঙ্গে। কেরামতও তার ঘর থেকে বের হয়ে আসে। অনেকক্ষণ পরে চন্দ্রের কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে সুখী তাকে ঘুম থেকে জাগাতে যায়। কিন্তু ঘরের দরজায় আলতো করে টোকা দিতেই সেটা খুলে যায়। ভিতরে চন্দ্র নেই! সুখী চিৎকার দিয়ে কেরামতকে ডাকে। সে দৌড়ে এসে ঘরের ভিতর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দুই স্বামী স্ত্রীর কান্নার ধ্বনিতে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে!