যে বয়সে মেয়েটির সুপারি গাছের ডালের সরু খোপের মধ্যে বসে থাকার কথা এবং আরেকজন গাড়ির মত করে সেটাকে সজোরে টেনে নিয়ে যাবার কথা; যে বয়সে এক্কা দোক্কা আর গোল্লাছুট খেলার কথা; গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটা ফলবতী গাছের ফল চুরি করে খাবার কথা- ঠিক সে বয়সে রতনপুর গ্রামের আক্কাস মিয়ার একমাত্র কন্যা লক্ষ্মীকে জরাজীর্ণ গাড়ির মত পরিবারটির হাল ধরতে সুদূর ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি।
লক্ষ্মী জানে না সে কোথায় যাচ্ছে, তাকে কি কাজ করতে হবে সেখানে গিয়ে। সে স্বজনহারা মানুষের মত শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। তার মা ফুল বানুরও মোটেও ইচ্ছা নেই মেয়েকে এভাবে একা এত দূরে পাঠানোর। দিনের পর দিন বৃষ্টি হবার পরেও পাথর যেমন একই রকম থাকে, আক্কাস মিয়াকে শতবার বুঝানোর পরেও সে দণ্ডায়মান খুঁটির মত অনড়।
বেচারি লক্ষ্মীর কষ্ট তার মায়ের আর সহ্য হয় না। ফুল বানু এর আগে দু একবার বাসা ছেড়ে চলে যাবার কথাও বলেছে কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয় নি। আক্কাস গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলেছে,
- আমি যেই সিদ্ধান্ত নিছি এইডাই ফাইনাল।
- তুমি আমার মাইয়াডারে বেইচা দিতে চাও? আমি বাইচা থাকতে হেই কাজ তুমি করতে পারবা না।
- ঐ মাগী! হারামজাদী! চুপ কর!
- কি করবা? চুপ না করলে কি করবা, হুনি?
- কি করুম? জানতে চাস কি করুম?
- হ জানতে চাই কি করবা?
- এই দাডা দিয়া এক কোপে তোর সব তেজ আইজ মাডিত পুইতা ফালামু, কুত্তার বাইচ্চা!
- এইডাইতো ফারো, খালি গাইল আর গাইল। আমার জাগাত অন্য মাইয়া থাকলে তোমার লগে একদিনও সংসার করত না।
- তুই তোর আজেবাজে কতা থামাবি?
- আমার কতা তো বাজে অইবই! আমার কোন কতার দাম তুমি দিছ আইজ পর্যন্ত?
- মাইয়া মানুষের বুদ্ধি কম- এই কথাডা মাইনসে এমনে এমনে কয় না!
- তুমি আমার চাঁন্দের মত লক্ষ্মীরে কোন জাগায় একলা পাডাইতাছ আর আমি চুপ কইরা বইয়া বইয়া তালি বাজামু নাকি?
- যেইখানে যাইতাছে হেইখানে তোর মাইয়া রানীর মত থাকব। তোর এইসব লইয়া এত চিন্তা করতে অইবনা। ক্ষীদা লাগছে খুব; যা ভাত বাইড়া দে।
- পারুম না। নিজে লইয়া খাও গিয়া। এত সোহাগ দেখাইতে পারুম না।
- কি রানছস আইজ?
- নিজে গিয়া দেখো!
- কসনা বেটি।
- প্রত্যেকদিন যা খাও।
- ডাইল, কলমি শাক আর ভাত?
- নিজে মরদ মানুষ হইয়া দুইডা টেহা কামাই করতে পারে না। আমার মাইয়াডারে দিয়া কামাই করাইতে চায়।
- চুপ কর মাগী! ভালা অইব না কিন্তু। তুই আমার মেজাজটা গরম করিস না কইলাম!
- ঠিকই তো কইছি।
- তোরে আইজকেই লাইত্থাইয়া আমার ঘর থেইকা বাইর করুম।
- তোমার মত আইলসা বেটার লগে থাকার খায়েশ আমার নাই।
- তাইলে যাস না কেন আমারে ছাইড়া? তালাক দে।
- দরকার অইলে তাই দিমু। তোমারে আমি তালাক দিয়া লক্ষ্মীরে আমি আমার বাপের বাড়ি লইয়া যামু।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কলহ যেমন থাকবে, ভালোবাসাও থাকবে। দাম্পত্য সম্পর্কটা যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ! কিন্তু আক্কাস-ফুল বানুর সম্পর্কের মাঝখানে ভুত হয়ে বসে আছে দারিদ্র্যের ভয়াল ছায়া।
যানবাহনের খোরাক হচ্ছে তেল; এই তেল যদি না থাকে, গাড়ি যেমন সামনে যায় না ঠিক তেমনি অর্থের অভাবে এই ছোট সংসারের চাকা বিশাল পৃথিবীর মাঝে যেন মূর্তির মত স্থির এবং নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। যেন পরপারে গেলেই শান্তির দেখা মিলবে। এ জনমে ‘শান্তি’ বা ‘সুখ’ নামক পরশপাথরের দেখা পাওয়া যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতন।
আক্কাসের মন মেজাজ এতটা খিটখিটে ছিল না আগে। হয়তো এটাই প্রকৃতির নিয়ম। একজন চিত্রকর যেমন একই ছবিকে দক্ষতার সাথে বিভিন্ন আঙ্গিকে আঁকতে পারেন, ঠিক তেমনই সৃষ্টিকর্তা যেন মানুষের মন মেজাজ একেই চলেছেন অবিরত।
ফুল বানু বিয়ের পরে শেষ কবে প্রাণখুলে হেসেছে সে জানে না। যেন সে জানে না কিভাবে হাসতে হয়। কোরান শরীফে বর্ণিত আছে যে আল্লাহ্ পাক দুনিয়ায় মানুষের সামনে নানা রকম বিপদ আপদ দিয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করেন; যাতে তারা আল্লাহ্র উপর আরও বেশী করে আস্থা রাখেন; যাতে তারা আরও ধৈর্যশীল হয়।
আক্কাস আর ফুল বানু এত দিন ধরে সেই পরীক্ষার অংশ হয়ে ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আক্কাস হাল ছেড়ে দিয়েছে। যে কারণে সে লক্ষ্মীকে ঢাকায় কাজের মেয়ে হিসেবে পাঠানোর মত একটা বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে ফুল বানুর ঠিকই বিশ্বাস আছে যে আল্লাহ্র রহমতে একদিন তার ঘরে পূর্ণিমা রাতের জোছনার মত সুখ উঁকি দিবে।
ফুল বানু এত দিন ধরে বেত দিয়ে মোড়া তৈরি করে আশেপাশের বাজারে গিয়ে বিক্রি করে কিছু পয়সা পেত। তবে ধীরে ধীরে এসবের চাহিদা কমে যাচ্ছে। মানুষ আর এসব কিনতে চায় না। প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন নকশার বাহারি সব মোড়া এখন হাতের নাগালে।
কিছু মোড়া এখনও বাসায় রয়ে গেছে। যদিও বিক্রি হয় না তবুও সেগুলো মা আর মেয়ে মিলে পাঁচ মাইল দূরের হাটে যায় প্রায় প্রতিদিন। যদি একটাও বিক্রি হয় এই আশায়!
আশা, আশার চেয়ে বড় শক্তি মনে হয় মানবদেহে অনুপস্থিত। এটা মানুষকে মানুষ হতে শেখায়, সামনে এগুতে শেখায়, আত্মবিশ্বাসী হবার সাহস যোগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, বাঁচতে শেখায়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ যথার্থই বলে গিয়েছেন, “সংসার সাগরে দুঃখ-তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা”।
ফুল বানুর ‘আশা’ নামক বীজে লুকিয়ে আছে লক্ষ্মীর ভবিষ্যৎ। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে এক অদ্ভুত আশ্চর্যময় দ্যুতির দেখা পায়। তখন তার মনে হয় পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। যেন স্বপ্নকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ছোঁয়া পর্যন্ত যে সময়টুকু সেটুকু ধৈর্য নামক অদৃশ্য ধারণার হাতেই ন্যস্ত।
অতঃপর ফুল বানুর সকল বাধার দেয়াল গুড়িয়ে দিয়ে; লক্ষ্মীর চোখের অশ্রুর সাগরকে পায়ে ঠেলে আক্কাস তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। মায়ের বুকে যেন কেউ কিছুক্ষণ পরপর শেল বিদ্ধ করছে। কষ্টের পাহাড়ে যেন সে চাপা পড়ে আছে। যেন আজরাইল এসে উপস্থিত। যেন মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশেপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা ইত্যাদি যেন ফুল বানুর কষ্টে ব্যথিত, মর্মাহত।
পরদিন সন্ধ্যায় আক্কাস মিয়া বাসায় ফিরেছে। তার ঠোঁটের কোনে হাসি যেন আকাশের গায়ে রংধনুর মত লেগে আছে। সাথে বিস্কুট, ফলমূল, তরিতরকারি ইত্যাদিও আছে। তার হাবভাবে মনে হচ্ছে যেন সে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ পেয়েছে!
ফুল বানুর চেহারায় বিষণ্ণতার কালো মেঘ আগে থেকেই ছিল। লক্ষ্মীর বাবাকে দেখামাত্রই সে রাগে এবং ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। মেয়েকে নিয়ে যাবার পর থেকে সে কিছুই মুখে দেয় নি। এমন কি এক ফোঁটা পানিও না। দাবানলে যেমন গাছ পুড়ে ছাই হয় তেমনি লক্ষ্মীর জন্যে মায়ের মন যেন পুড়েই যাচ্ছে। এ আগুন নিভবে না কভু।
- কি গো লক্ষ্মীর মা, কি অইসে? থোবড়াডারে এমুন বাংলার পাঁচের মত কইরা রাখছ কেন?
- হেইডা কি তুমি জানো না? আমার লগে তামসা কইর না? সরো এইখান থেইকা?
- তোমার মাইয়া খুব আরামে থাকব; দেইখো আমি যেইডা কইছি হেইডা ঠিক হয় কি না।
- আমার আর দেখাদেখির কাম নাই। তুমি দেখো!
- অত রাগ কর কেন?
- রাগ করুম না তো কি করুম? তোমারে জড়াইয়া ধইরা চুমা দিমু?
- মাইয়া মাইনসের অত রাগ ভালা না। তোমার মাইয়ারে যেই বাসায় দিয়া আইছি হেই বাসার মালিক বিরাট ধনী। তোমার লক্ষ্মীর কোনও সমস্যা অইবনা।
- আল্লাহ্র দোহাই লাগে তুমি আমার মাসুম মাইয়াডারে আইনা দাও। আমি হেরে ছাড়া কোনওমতে থাকতে পারুম, কিন্তু হেয় আমারে ছাড়া এক দিনও থাকতে পারত না।
- ধুর! আবার শুরু অইসে তোমার ক্যাচাল!
- আমার মাইয়াডা মইরা যাইব। তুমি তারে বাঁচাও। আমি তোমার পায়ে পড়ি লক্ষ্মীর বাপ। এত নিষ্ঠুর অইয়না।
- কি যন্ত্রণা! আমি কতবার কইছি তোমারে যে কোনও অসুবিধা অইবনা। তাছাড়া তুমি তো তার লগে চাইলে ফোনেও কতা কইতে পারবা। বড়সাবের লম্বরও আনছি। খাড়া এক মিলিট, তোরে দেহাইতাছি।
- আমি তোমার বড়সাবের লম্বর ধুইয়া কি পানি খামু নাকি। আমারে আমার মাইয়া আইনা দেও।
আক্কাস রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। পাশের ঘরের জামিলা পুকুর থেকে কলসিতে করে পানি নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ফুল বানুর কান্নার শব্দ শুনে থামল।
- কি অইসে ফুল? কান্দস কেন?
- দুঃখের কতা আর কি কইমু বইন।
- কও বইন, কি অইসে?
- আমার লক্ষ্মীরে শহরে গিয়া বেইচা আইছে তার বাপে।
- হ্যাঁ! কি আবোলতাবোল বকতাছ গো বইন।
আক্কাসের কানে ‘বেইচা আইছে’ শব্দ দুটি প্রবেশ করা মাত্রই গোখরা সাপের মত তেড়ে আসল ফুল বানুর দিকে।
- দেখ লক্ষ্মীর মা, তুই আমারে অনেক কতা শুনাইছস। আমি কিন্তু কিচ্ছু কই নাই। এখন তুই আমার নামে পাড়ার মাইনসের কাছে বদনাম করতাছস; কামডা কিন্তু মোডেও ঠিক অইতাসে না।
জামিলা আক্কাসকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সে এমনভাব করছে যেন জামিলার সামনেই ফুল বানুর চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে। আক্কাস গণ্ডারের মত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাজারের দিকে হেঁটে গেল। জামিলা ফুল বানুকে বাচ্চা শিশুর মত বুকে আগলে রেখেছে যেন। ফুল বানুর কান্না থামছেই না। একটু পরপর ‘লক্ষ্মী, আমার লক্ষ্মী’ বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জামিলা তার মুখ থেকে সব কথা শুনার পর সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় নিল।
দিন যায়, মাস যায়, যায় বছর। মায়ের মন পড়ে আছে লক্ষ্মীর কাছে। কতদিন মেয়েটাকে দেখেনি ফুল বানু। ইতোমধ্যে দু একবার ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু মায়ের মন কি আর দু এক কথায় ভরে? যতক্ষণ না সন্তানকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরছে, ততক্ষণ কি ষোলকলা পূর্ণ হয়?
- তোমারে কত কইরা কইলাম আমার লক্ষ্মীরে একবার দেখতে মন চায়। তুমি তো আমার কতার কুনু পাত্তাই দেও না।
- সামনের ঈদে আনুম নে যা।
- জিগাইলেই কও ‘সামনের ঈদ’ ‘সামনের ঈদ’! কত ঈদ আইল গেল! তোমার এক কতা আর কতবার হুনতে অইব।
- বড়সাবের ঘরে কত মানুষ! কত কাম থাকে হেইখানে। চাইলেই কি আওয়া যায় নি?
- কি কও তুমি এইগুলা? আমি আমার মাইয়াডার লগে দেহা করতে পারুম না? যদি হের আইতে সমইস্যা অয় তাইলে আমারে লইয়া চল ঢাকা।
- আইচ্ছা, ঠিক আছে, একদিন তোরে লইয়াই যামু। খুশি অইসত নি অহন?
অনেকদিন পর এলাকার কলেজের অধ্যক্ষ রহিম ইসলাম আক্কাসের বাড়িতে এসে উপস্থিত।
- রহিম কি আছো নাকি ঘরে?
- আসসালামুয়ালাইকুম মাস্টার সাব।
- অয়ালাইকুমআসসালাম।
- লক্ষ্মীর বাপ তো ঘরে নাই। তয় পাঁচ দশ মিলিটের মইধ্যে আইয়া পড়ব। আফনে এই মোড়াডাত বসেন মাস্টার সাব।
অধ্যক্ষ সাহেব ‘মিনিট’ শব্দটির উচ্চারণ ‘মিলিট’ শুনে প্রথমে একটু অবাক হন, পরে বুঝতে পারেন যে গ্রামের মানুষেরা যখন ইংরেজি কোনও শব্দের উচ্চারণ করে তখন উচ্চারণটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিকৃত হয়। যেমন ‘ব্লু’ হয়ে যায় ‘বুলু’; ‘সিগারেট’ হয়ে যায় ‘সিক্রেট’ ইত্যাদি।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে কি এক গ্লাস পানি দেয়া যাবে?
- জে, আমি আনতাছি।
রহিম ওনার হাতে থাকা সংবাদপত্রটি পড়তে লাগলেন। ইতোমধ্যে পানি নিয়ে লক্ষ্মীর মা উপস্থিত। পানিটা এক নিমিষে শেষ করে তিনি আবারও সংবাদপত্রে চোখ বুলাতে লাগলেন। ওনার দুই ভ্রুর ঠিক মাঝখানে একটা দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ভাঁজ। যেন দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটা জলহীন ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। সেটা ফুল বানুও খেয়াল করেছে। সে মনে মনে চিন্তা করতে থাকে যে এই ভর দুপুরে মাস্টার সাহেবের তাদের বাসায় আসার কারণ কি হতে পারে?
আক্কাস খুব ঘরমাক্ত শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই রহিম সাহেবকে দেখে বেশ অবাক হয়। পাশাপাশি সে খানিকটা গর্বিতও বোধ করে কারণ গরীবের ঘরে হাতির পা পড়েছে যে!
- আসসালামুয়ালাইকুম মাস্টার সাব।
- আসসালামুয়ালাইকুম।
- কেমন আছেন স্যার?
- ভালো আছি। তোমার দিনকাল কেমন চলছে?
- জে, কোনওমতে বাইচা আছি আরকি। এই অবেলায় আমার মত গরীবের ঘরে? আমি কেমনে আফনার খেদমত করতে পারি?
- আক্কাস, আমি তোমাকে একটা খুব জরুরী বিষয় জানানোর জন্য এখানে এসেছি।
- বলেন স্যার, কি বিষয়?
- তোমার মেয়ে লক্ষ্মীর অবস্থা খুব খারাপ।
- কি কন মাস্টার সাব? কি অইসে তার?
- এই জে দেখো, সংবাদপত্রে তার ছবি এসেছে। সে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে।
আক্কাস রহিম সাহেবের হাত থেকে সংবাদপত্রটা পাগলের মত টেনে নিয়ে তার লক্ষ্মী এবং আদরের মেয়ে লক্ষ্মীর রক্তাক্ত ছবিটা দেখামাত্রই বাচ্চার মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ঘরের ভিতর থেকে ফুল বানু ঝড়ের গতিতে এসে উপস্থিত হয় উঠানে। সে তার মেয়ের ছবি দেখার সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ঘরের পাশের আম গাছটিতে একটি কাক বসে কা কা করছে। সে কাকটি কখনও জানতেও পারবে না যে তার চোখের সামনে একটি পরিবারের উপর দুর্ভাগ্যের অমানিশা কিভাবে স্থায়ীরূপে জেঁকে বসেছে। জামিলা এসে ফুল বানুর মাথায় অনবরত পানি ঢালছে। মাস্টার সাহেব কিছুক্ষণ আক্কাসকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রস্থান করেন। যাবার আগে আক্কাসের হাতে কয়েকশ টাকা গুঁজে দেন।
আকাশে এক ফালি দুধের মত সাদা মেঘ কোনও রাজকুমারের মত ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। যেন মেঘও বিশাল পৃথিবীর মাঝে এই ছোট দরিদ্র পরিবারটির করুণ দশা দেখে আফসোস করছে। যেন এখনই মানব কান্নার মত বৃষ্টি হয়ে ঝরবে!