রাজন, একজন প্রিয়জন [Bangla Story]

রহমতপুর গ্রামে এত বৃষ্টিপাত আর কবে হয়েছে তা হয়তো ইতিহাস ঘেঁটে বের করতে হবে। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। তার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে অবিরত বজ্রপাত। আজ যেন বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের মধ্যে এক অনন্য প্রতিযোগিতা চলছে! ছোট ছোট বাচ্চা শিশুদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা হলে যেমন কেউ কোনও প্রকারেই হারতে চায় না, ঠিক সেরকমই অবস্থা চলছে আজ বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের মধ্যে।

  

প্রকৃতি যেন আজ দেবী দুর্গার মত ক্রোধান্বিত হয়ে সকল কিছু ধ্বংস করে দেবে! যুদ্ধের ময়দানে আকাশ হতে ধাবমান ধারালো তীরের মত বৃষ্টির ভারী ভারী ফোঁটার আঘাতকে তুচ্ছজ্ঞান করে একটি ছেলে দৌড়ে এসে রহমতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের এক পাশে জড়সড় হয়ে বসে থাকে। তার সমস্ত চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। দেখে মনে হয় যেন কোনও এক ভয়ংকর ভূত দেখে সে পালিয়ে এসেছে!

  

ছেলেটির নাম রাজন। গোলগাল মুখ। বয়স খুব বেশী নয়- পাঁচ কিংবা ছয় হবে। গায়ের রঙ বাদামের মত। মাথাভর্তি চুল যেন এক ফুটন্ত কদম ফুল। তার চোখদুটো এত কালো যে দেখতে কালো মার্বেলের মত লাগে। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাবার পরও রাজনের মুখ হতে আতংকের রেশটুকু এখনও কেটে যায়নি। এখনও সে থেকে থেকে হাঁপাচ্ছে এবং ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বাঘের ভয়ে পলায়নরত হরিণ যেমন আতংকে এদিক ওদিক তাকায় ঠিক তেমনি।

  

প্রায় দশ মিনিট পর কয়েকটি রিক্সা এসে স্কুলের সামনে থামে। প্রতিটি রিক্সাতেই দুজন করে যুবক বসা। তাদেরকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যে তারা কাউকে খুঁজতে এসেছে। রিক্সায় থাকা মানুষগুলোকে দেখে রাজনের ভয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সে পালাতে যাবে এমন সময় ঐ যুবকদের মধ্যে একজন  দৌড়ে এসে তার সিল্কের মত নরম কোমল হাত সজোরে চেপে ধরে!

  

বেচারা রাজন ক্ষুধার্ত শিশুর মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আশ্চর্যজনকভাবে রাজনের চোখের বৃষ্টি শুরু হবার সাথে সাথেই আকাশের কান্না মানে বৃষ্টি থেমে যায়। রিক্সা বিদায় করে দেবার পর প্রায় দশজনের মত যুবক এসে রাজনকে ঘিরে দাঁড়ায়। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয় যেন রাজন একজন দুর্ধর্ষ আসামী যে কিছুক্ষণ আগে জেল থেকে পালিয়েছে!

  

রাজনের গগনবিদারী চিৎকারে আরও অনেক অনেক মানুষ জড়ো হতে থাকে। এমতাবস্থায় ঐ যুবকদের মধ্যে একজন রাজনকে ‘চোর’ বলে সম্বোধন করে এবং অন্য আরেকজনকে নির্দেশ দেয় তাকে স্কুলের পিলারের সাথে বেধে ফেলার জন্য।

  

যেমন কথা তেমন কাজ। অসহায় এবং নিস্পাপ রাজনকে এমনভাবে বাধা হয়েছে যেন সে চিড়িয়াখানা ছেড়ে পালানো কোনও হিংস্র বাঘ। ইতোমধ্যে আরও অনেক মানুষ আসতে শুরু করেছে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল বয়সী লোকজনের সমাগম হয়েছে।

  

অগুনতি কৌতূহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে সেই শৃঙ্খলিত রাজনের উপর। কেউ জানতে চায় না কি হয়েছে? শিশুটি কে? কেনই বা তাকে এমন পশুর মত বেধে রাখা হয়েছে? সবাই যেন সার্কাস দেখছে!

  

যুবকদের মধ্যে প্রায় সবাই রাজনের ক্ষুদ্র এবং ভঙ্গুর শরীরে এলোপাথাড়ি চড়, ঘুষি এবং লাথি মারতে থাকে যেন সে একটা ফুটবল! কয়েকজন আবার ছোট ছোট লাথি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। রাজন কাঁদছে তো কাঁদছেই। সে শুধুই বলছে, ‘আমি চোর না, আমারে ছাইড়া দেও! কেউ আমারে বাঁচাও’।

  

এসবের মধ্যে সেই যুবকদের মাঝখান থেকে একজন সামনে এসে তার মোবাইল ফোনে এই পাশবিক ঘটনা রেকর্ড করতে থাকে। সে শুধু নির্যাতনের পুরো বিষয়টি রেকর্ড করেই ক্ষান্ত হয়নি, পাশাপাশি ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দিতে থাকে। হায় ঈশ্বর! অসভ্যতা কাকে বলে!

  

আঘাতে আঘাতে রাজনের হাতে ও পায়ে রক্ত জমাট বেধে নীল রং ধারণ করেছে। তখনও দর্শকদের মাঝখান থেকে কোনও মুরব্বী বা কোনও বিবেকবান মানুষ সামনে এসে বলে না যে এমন পাশবিক কাণ্ড এখনই থামাতে হবে। রাজনের ক্রন্দনধ্বনি সেইসব দর্শকদের বিবেককে সিক্ত করতে পারেনি।

  

ফুলের মত কোমল রাজনের পক্ষে এমন আঘাতের উপর আঘাত সহ্য করা অসম্ভব। তাই দিনের শেষে ঝরে পড়া কোনও ফুলের মত রাজন এক নতুন কিন্তু আরও বড় এবং সীমাহীন দুনিয়ার অংশ হয়ে যায়। ঢলে পড়া সূর্যের শেষ আলোক বিন্দুটির মত রাজন এ পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যায়।

  

কষ্টের তীব্রতায় রাজন যখন কেঁদেছে, তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষ হেসেছে! শেক্সপিয়ারের নাটক “The Merchant of Venice” এর নিষ্ঠুর এবং নির্দয় শাইলকও হয়তোবা রাজনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলত- রাজনের রক্ত কি লাল নয়? তার কান্নার রং কি আলাদা? তার কি হৃদয় নেই? 

  

যে গ্রামের নাম রহমতপুর, সেই গ্রামের মানুষের মনে রহমতের কোনও ছিটে ফোটাও নেই। রাজনের মত একটি শিশুকে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে এভাবে মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় কিছু মানুষ নামধারী হায়েনার দল পদতলে ফেলে পিঁপড়ার মত পিষ্ট করে মেরে ফেলার পরেও মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় না। কি অদ্ভুত! মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের বিবেক বলে কিছু নেই! থাকলে সেটি জাগ্রত হবার প্রশ্ন আসে!

  

           রাজন তুমি যেখানে আছো, অনেক অনেক ভালো আছো। তোমার হারানোর কিছু নেই, তোমার লজ্জার কিছু নেই। আমরা যারা নিজেদেরকে ‘মানুষ’ বলি, যারা নিজেদের ‘সভ্য’ ও ‘বিবেকবান’ বলি, আমরাই আজ পরাজিত নিজেদের কাছে, নিজেদের চোখে। রাজন, যেখানেই আছো তুমি, ভালো থেকো।

View kingofwords's Full Portfolio
tags: