ছেলেটির নাম কামরুল হাসান। সে রাতের বেলা প্রায়ই স্বপ্ন দেখে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে তার প্রতিটা স্বপ্নই সত্যি হয়ে যায়! এটা তার দোষ না গুণ সে জানে না। কিন্তু এই দশ বছর বয়সী ছেলেটার মনের মধ্যে এই আজব বিষয়টা প্রায় সবসময় ঘুরতে থাকে।
প্রথমত কামরুল জানে না এই স্বপ্ন তার মনে কেন উঁকি দেয়? দ্বিতীয়ত তার স্বপ্নের হুবহু বাস্তবায়ন সে দেখতে পায় স্বপ্ন দেখার দু এক দিনের মধ্যেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে একদিন রাতে সে স্বপ্নে দেখেছে যে তার পাশের বাড়ির কাজের মেয়ে সখিনা গলায় দড়ি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরদিন দুপুরবেলা কামরুল সেই বাড়ির পাশ দিয়েই হেঁটে যাওয়ার সময় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করার পর সে জানতে পারে যে একজন মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
এ হৃদয় বিদারক কথাটা কামরুলের কানে পৌঁছামাত্রই সে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর মত হঠাৎ দু চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে। যেন আজরাইল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার জান কবজ করতে।
কামরুলের আর বুঝতে বাকী থাকে না যে গতরাতে দেখা সেই স্বপ্নটাই দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়েছে। তার মনে হতে থাকে কেউ বা কোনও রহস্যময় এবং শক্তিশালী কিছু একটা হয়তো বা তার স্বপ্নে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে; একজন নাট্য নির্দেশক যেমন করে বইয়ের চরিত্রগুলোকে সুন্দর এবং সাবলীলভাবে মঞ্চে উপস্থাপনে ভূমিকা রাখেন, ঠিক তেমনি হয়তোবা কেউ আড়ালে থেকে অদ্ভুত উপায়ে এ কাজটি করছে। কিন্তু কেন? এ কেন-এর কোনও উত্তর তার কাছে নেই।
মাঝে মাঝে কামরুলের মনে হয় যে সে তার মা লায়লা আফরিনকে বিষয়টা জানাবে। অনেকদিন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও কোনও এক অজানা সংকোচে সে ছুঁয়ে দেয়া শামুকের মত গুটিয়ে গেছে। সে বলতে চায় কিন্তু কেন জানি বলতে পারে না।
কামরুল এ অদ্ভুত ব্যাপারটা কারো সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে না পারার পেছনেও হয়তো কোনও রহস্যজনক এবং লুকায়িত শক্তির প্রভাব কাজ করছে। যাইহোক, একের পর এক স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং কোথাও না কোথাও সেই স্বপ্নটি সত্যি হয়ে যায়। এমন নয় যে শুধুমাত্র কামরুলের পরিচিতজনদের সাথেই স্বপ্নের সত্যতা মিশে থাকে। একবার সে স্বপ্নে দেখে যে একটি যাত্রীবাহী বিমান আচমকা আকাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
দুই দিন পর কামরুল সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় দেখতে পায় যে মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরগামী একটি যাত্রীবাহী বিমানের কোনও খোঁজ মিলছে না। বিভিন্ন স্থানীয় এবং বিদেশি তদন্ত সংস্থার অতি দক্ষ সদস্যগণ দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও সেই হারিয়ে যাওয়া বিমানের কোনও হদিস পাননি।
কামরুলের দু চোখ যেন আঠার মত পত্রিকার প্রথম পাতায় লেগে আছে। স্বপ্ন নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে তার পড়ালেখাও ঠিকমত হচ্ছে না। ইতোমধ্যে সে ইন্টারনেটে স্বপ্ন সংক্রান্ত কিছু গবেষণা প্রবন্ধ পড়েছে এবং জানতে পেরেছে যে যাদের এ ধরণের অস্বাভাবিক প্রবণতা আছে তারা আসলে এক ধরণের রোগে আক্রান্ত।
কিন্তু কামরুলের মন মানে না। সে ভাবতেই পারে না যে এটা একটা রোগ হতে পারে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, এ কেমন রোগ যেখানে স্বপ্ন পুরোপুরি সত্যি হয়ে যায়? তার মনে হয় যে এটা ঈশ্বর প্রদত্ত কোনও এক আশীর্বাদ।
সেই ঘটনার পর অনেক দিন কেটে যায়। কামরুল এখন আর স্বপ্ন দেখে না। তার মনে হয় সে যেন স্বর্গে আছে। কারণ তাকে এখন আর দুশ্চিন্তা করতে হয় না। সে তার বন্ধুদের সাথে নিয়মিত আড্ডা দেয়, পড়াশুনাও চলছে পুরোদমে, খেলাধুলায়ও অংশ নেয়।
কামরুল ভাবে যে সৃষ্টিকর্তা যেন তার উপর করুণা করেছে। “দ্যা রাইম অব দি এন্সিএণ্ট মেরিনার” গল্পে নাবিকের ঘাড় থেকে যেমন করে এ্যালবাট্রস পাখীটি পড়ে গিয়েছিল ঠিক তেমনি কামরুলের মাথা থেকে যেন একটি বড় পাথর কেউ নামিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু ভাগ্য কামরুলের সাথে আরেকটি নির্মম খেলা খেলে। একরাতে সে স্বপ্নে দেখে যে তার মা সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। কামরুল ওনার পাশেই বসা; তার দু চোখে যেন অশ্রুর হ্রদ বয়ে যাচ্ছে। তার মা তাকে কি যেন একটা কথা বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না।
পরদিন সকালে কামরুল ঘুম থেকে উঠে মাকে ঘরে না পেয়ে কাজের মেয়ে জরিনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে তিনি সবজি কিনতে বাজারে গিয়েছেন। বাজারটি খুব বেশী দূরে নয়। দশ মিনিটের পথ। কামরুল পাগলের মত ওনাকে খুঁজতে বের হয়েছে।
কিন্তু সে সেখানে পৌঁছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে কিছু মানুষের জটলা দেখতে পায়। ভিড় ঠেলে সামনে পৌঁছতেই দেখে যে লায়লা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ওনার দেহ একেবারেই নিস্তেজ।
হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তাররা বলেছেন যে রোগীর অবস্থা খুব আশংকাজনক। ইতোমধ্যে নিকটাত্মীয়রা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তীরের গতিতে ছুটে এসেছেন। কামরুল তার মায়ের হাত চেপে ধরে আছে। সে কাঁদছে তো কাঁদছেই। তার মা তাকে কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু অদৃশ্য কোনও শক্তি যেন ওনার কণ্ঠ রোধ করে আছে!