গত কয়েকমাস ধরে সাবিনা সূর্যের আলো দেখেনি। তার পায়ে শৃঙ্খল বেঁধে একটি গুদামঘরের মত জানালাহীন কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তার স্বামী আজগর আলী এই কাজটি করেছে।
সাবিনা কোনও দোষ না করেও দোষী। বিয়ের সময় সাবিনার বাবা জিহাদ হায়দার যৌতুক হিসেবে একটি মোটরসাইকেল এবং নগদ দুই লাখ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। তবে তিনি আজগরকে কথা দিয়েছিলেন যে খুব দ্রুতই ওনার পাওনা বুঝিয়ে দেবেন।
কিন্তু কোনোভাবেই জিহাদ পেরে উঠছেন না। দিনের আলোকে যেমন রাতের আঁধার কালো চাদরে ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলে ঠিক তেমনই জিহাদের জীবন যেন কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে। ওনার আরও দুই মেয়ে লতিফা এবং সাদিয়ার বিয়ের চিন্তা ওনার মাথায় চব্বিশ ঘণ্টা লাটিমের মত ঘুরপাক খায়।
জিহাদের এমন চরম হতাশাজনক মুহূর্তে ওনার স্ত্রী লিপি আক্তারও সাহায্য করতে অপারগ কারণ তিনি নিজে একজন গৃহিণী মাত্র। তাছাড়া ওনার বাবার কাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে কোনও সহায়তা পাবার আশা করাও নিরর্থক।
জিহাদ কয়েকবার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবার কথা ভেবেছে কিন্তু ইতোমধ্যে ওনার বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে তিনি অনেক টাকা ধার করেছেন। সেই ঋণের টাকা প্রতি মাসে একটু একটু করে শোধ করছেন। কোনও মাসে পারেন তো কোনও মাসে পারেন না।
এমন করুণ পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে বড় টিউমার হয়ে দাঁড়িয়েছে আজগরের যৌতুকের টাকা এবং মোটরসাইকেল দেবার ব্যপারটা। ইতোমধ্যে কয়েকবার জিহাদ ওনার মেয়েকে দেখতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরে এসেছেন। কারণ আজগর রীতিমত দুর্ব্যবহার করে ওনাকে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিয়েছেন।
যতবারই জিহাদ সাবিনাকে দেখতে গিয়েছেন ততবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন। একবারের জন্যও ওনার মেয়েকে দেখতে দেয়া হয়নি। এমন পাথর হৃদয় মানুষও হয়!
তবে জিহাদ যখন বাসায় ফিরেছেন তখন হাসিমুখে পরিবারের সবাইকে মিথ্যা কথা বলেছেন যে ওনার সাথে সাবিনার দেখা হয়েছে। সে খুব সুখে আছে; কয়েকদিনের মধ্যেই বাসায় আসবে ইত্যাদি। বাড়ির সকলেই জিহাদের কথা শুনে আনন্দিত হয় এবং আশ্বস্ত বোধ করে।
ওদিকে সাবিনার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলতে থাকে। আজগর এক একদিন এক এক উপায়ে তার উপর নৃশংস নির্যাতন চালায়। একদিন তার লম্বা চুল কেটে দেয়, আরেকদিন রান্নাঘরের ভাজা কাঠি গরম করে এনে সাবিনার পিঠে সেঁকা দেয়। সাবিনার চিৎকার বাইরের কারো কানেই পৌঁছায় না।
সাবিনা আজগরের পায়ে ধরে ভিক্ষুকের মত অনুরোধ করতে থাকে যাতে তার উপর একটু দয়া করে, যাতে তাকে তার বাবার বাড়ি যেতে দেয়া হয়। কিন্তু আজগর নামক শয়তানের ইস্পাত কঠিন হৃদয়ে দয়া কিংবা মায়ার কোনও স্থান নেই। সে হৃদয় চেনে শুধু স্বার্থপরতা, লোভ এবং নিষ্ঠুরতা।
আজগরের অমানুষিক নির্যাতনের কাছে যুদ্ধের ক্যাম্পে সৈনিকদের উপরে যে নির্যাতন হয় সেটাও হার মানবে। প্রতিদিন সাবিনার হাতে, পায়ে, গালে জ্বলন্ত সিগারেটের সেঁকা দেয়া চলতে থাকে। দিনে শুধুমাত্র একবেলা তাকে খাবার দেয়া হয় তাও চিড়িয়াখানায় যেমন পশুর সামনে খাবার ছুঁড়ে দেয়া হয় ঠিক সেভাবে।
দিনের পর দিন অমানবিক নির্যাতনের ফলে সাবিনা মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে। এখন সে কখনও পাগলের মত হাসে কখনও কাঁদে, কখনও নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে ইত্যাদি। তারপরও আজগরের মনের ভেতরে দয়ার আলো উঁকি দেয় না। ওনার কাছে জীবন বা সম্পর্কের মূল্য নেই। টাকাই সব।
একদিন যথারীতি আজগর সাবিনার উপর ওনার নির্যাতন চালাতে থাকেন। সাবিনা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। একটি আহত পশু যেমন তীব্র হুংকারে তার ব্যাথার তীব্রতা প্রকাশ করে ঠিক সেই রকম। সাবিনা যেন চিৎকার দিতে দিতে পৃথিবী থেকে সকল নিষ্ঠুরতা, লোভ, অন্যায়, অবিচার, স্বার্থপরতা ইত্যাদি নেতিবাচক এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে নরক পর্যন্ত নিয়ে যাবেন।
সৌভাগ্যবশত সাবিনার চিৎকার আজগরের বাসায় পত্রিকা দিতে আসা জলিলের কানে পৌঁছে যায়। অন্যদিন সে পত্রিকা দিয়েই চলে যায় কিন্তু আজ কেন যেন সে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। তার কাছে সবকিছু একটু অস্বাভাবিক ঠেকে।
বনের হরিণ যেমন সামান্য আওয়াজ পেলেই সতর্ক হয়ে কান খাড়া করে রাখে, তেমনই জলিল সাবধানতাবশত এক কোণায় দাঁড়িয়ে থেকে বাসার ভেতরে কি হচ্ছে সেটা আঁচ করতে চায়। একসময় চিৎকারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
আজগরও ক্রোধান্বিত হয়ে “আজ মেরেই ফেলব তোকে হারামজাদী!” বলে চিৎকার দিতে থাকে। এ কথা শুনে জলিলের বুকে যেন ঝড় শুরু হয়। সে আর দেরী না করে সরাসরি থানায় গিয়ে পুলিশকে বিষয়টা জানায়।
ঐদিন বিকেলেই পুলিশ আজগরের বাসায় এসে হাজির। পুলিশকে দেখে আজগর কিছুটা অবাক হয়। তার চোখে মুখে বিরক্তির ভাবও স্পষ্ট। দুশ্চিন্তায় ওনার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। পুলিশ যখন জানতে চায় যে বাসায় আর কে কে থাকেন তখন তিনি বলেন যে ওনার স্ত্রী থাকেন।
স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে পুলিশ ওনার বর্তমান অবস্থান জানতে চাইলে আজগর বলেন যে তিনি বাজারে গিয়েছেন। পুলিশ সবগুলো কক্ষই ভালোভাবে তল্লাশি করে দেখেন কিন্তু সন্দেহজনক কোনও কিছু পায় না। যখন ওনারা চলে যাবেন এমন সময় একটি নারী কণ্ঠের গোঙানি কানে আসে।
আজগর সেটা চাপা দিতে গিয়ে বলেন পাশের ঘরে হয়তো কোনও বাচ্চা কাঁদছে। কিন্তু গোঙানির শব্দ বাড়তেই থাকে এবং পুলিশরা লক্ষ করেন যে শব্দটা আজগরের বাসার ভেতর থেকেই ভেসে আসছে।
পুলিশ আবারও তল্লাশি চালাতে থাকেন এবং দোতলায় অবস্থিত তালাবদ্ধ গুদামঘরের ভেতর থেকে রক্তাক্ত, জীর্ণ বস্ত্রে শায়িত সাবিনাকে উদ্ধার করেন। আজগরকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করা হয়। সাবিনাকে দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় এবং ওনার পরিবারকে খবর পাঠানো হয়।
ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন যে অতি মাত্রায় শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের ফলে সাবিনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এমতাবস্থায় তিনি আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন এ আশা ক্ষীণ। ওদিকে কোর্টে আজগরের বিচার চলতে থাকে। সাবিনার পরিবার আশা করে যে আজগর যাতে শাস্তি পান। তিনি যেন আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বের হতে না পারেন।