মায়ের প্রতি ভালোবাসা [Story]

রফিক, আইমান, ইরফান এবং আসিফ চার ভাই। তারা সকলেই স্কুল পড়ুয়া। তাদের মধ্যে ইরফানের সাথে মা আয়শা জান্নাত-এর সম্পর্কটা একটু বেশীই গভীর। ইরফান মাকে এত বেশী ভালোবাসে যে মা ব্যতীত এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারে না সে।   

 

        আয়শাও ইরফানকে অন্য সন্তানদের চেয়ে যেন একটু বেশী স্নেহ করেন। এ বিষয়টা অন্যরাও বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে এবং মনেমনে ইরফানের প্রতি কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়।      

 

আয়শার স্বামী আশরাফুল হাসান একটা প্রাইভেট ব্যাংকে অফিসার পদে কাজ করেন। বেতন বেশ লোভনীয়। যদিও দিনের প্রায় পুরো সময়টাই ব্যাংকে কেটে যায়। শুক্র ও শনিবার বাদে প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ব্যাংকে কাজ করতে হয়। ব্যাংকে কাজের এত চাপ থাকে যে মাঝেমাঝে মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে যায়। প্রায়ই বাসায় ফিরে আয়শার উপর রাগ ঝাড়েন।

 

আজ পর্যন্ত অবশ্য আশরাফুল আয়শার গায়ে হাত তুলেননি তবে প্রচণ্ড রেগে গেলে ওনার কথাবার্তার কোনও স্টেশন থাকে না; মুখে যা আসে তাই বলতে থাকেন। বস্তির মানুষদের মত গালির বৃষ্টি ঝরে মুখ থেকে।

 

আশরাফুল একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও এই চিন্তাটুকু ওনার মস্তিষ্কে আসে না যে বাড়িতে ছেলেরা এসব ঝগড়া শুনতে পাচ্ছে। তাদের মানসিক অবস্থাটা একবারের জন্য হলেও ওনার চিন্তা করা উচিত। তাছাড়া ছেলেরা এসব দ্বন্দ্বের জন্য তাদের বাবাকেই দায়ী করে। তারা দিনদিন তাদের বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

 

একটি গর্তের ভিতর যেমন আগাছা জন্ম নেয়, তেমনি বাবার প্রতি সম্মানের যে স্থান ছিল সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ঘৃণা। ইরফান তার বাবাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেন সে খুব কুৎসিত কোনও কিছু দেখেছে।

 

বাবার সাথে অন্য ছেলেদের কথা একেবারেই হয় না বললেই চলে। আশরাফুল বাসায় প্রবেশের সাথে সাথে মাসহ ছেলেরা ভয়ে কাঁপতে থাকে। তিনি থাকা মানে আর ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়া একই কথা। ডি. এইচ. লরেন্সের সন্স অ্যান্ড লাভারস উপন্যাসে পল এবং তার অন্যান্য ভাইবোনরা তাদের বাবা ওয়াল্টার মরেলের কারণে যেমন ভয়ে তটস্থ থাকত ঠিক তেমন।   

 

যতক্ষণ বাবা বাইরে থাকেন, ততক্ষণ ঘরের সবাই একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারেন। সবার মনে হয় যেন বেহেশতে আছে। বাবার বাজে আচার আচরণের ফলে সন্তানরা মায়ের আরও বেশী কাছাকাছি চলে এসেছে। মায়ের এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দুও তাদের সহ্য হয় না।

 

ইরফানের প্রায়ই মনে হয় যে সে তার বাবাকে গিয়ে বলবে মায়ের সাথে এমন দুর্ব্যবহার না করতে। সে তার মাকেও এ ব্যাপারে জানিয়েছে কিন্তু তিনি নিষেধ করে দিয়েছেন।

 

মানুষের চেহারা হচ্ছে মানুষের মনের আয়না। মনের অনুভূতি চেহারায় খুব সহজেই প্রকাশ হয়ে যায়। আয়শা যে মোটেও সুখী নেই তা ওনার চেহারা দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে। প্রায় রাতে না ঘুমানোর ফলে চোখের নিচে কালি জমে গেছে।

 

অন্য ভাইদের চোখে না পড়লেও ইরফান ঠিকই খেয়াল করেছে সেটা। মায়ের দিকে তাকালেই তার দু চোখ পানিতে ভরে ওঠে। সে নিজেকে আর সামলাতে পারে না। একদিন সে মাকে বলে,

 

- মা, তুমি এতো সহ্য করো কিভাবে?


- চুপ কর, কি বলছিস এসব?


- আমি ঠিকই বলছি। তোমার কষ্ট আমার সহ্য হয় না।


- এসব কথা রাখ, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। তোর অর্থহীন কথা শুনার সময় আমার নেই।


- তুমি জানো যে আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। তুমি দেখে নিও, কোনও একদিন বাবাকে আমি নিজ হাতে খুন করবো। 


- হায় আল্লাহ! এতটুকু ছেলে বলে কি? খবরদার! এরকম কথা যেন তোর মুখ থেকে আর কোনোদিন না শুনি।

       

        একদিন স্কুল থেকে ফিরে চার ভাই মিলে পাশের মাঠে খেলতে গিয়েছে। খেলতে খেলতে কখন যে মাগরিবের আজান পড়েছে তার খেয়াল কারোই নেই। তড়িঘড়ি করে সবাই এক দৌড়ে বাসায় ফিরে আসে।

 

        বাসায় এসে যে দৃশ্য ওরা দেখে সেটার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। তাদের বাবা আশরাফুল মা আয়শাকে চুলে ধরে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসছে। মায়ের বাম গাল রক্তাক্ত। দু হাতে স্বামীর পা আঁকড়ে ধরে আছে এবং বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিচ্ছে।

 

        আশরাফুল মেরেই ফেলব বলতে বলতে আহত সিংহের মত গর্জে উঠছেন। যখনই ছেলেদেরকে দেখতে পেয়েছেন ঠিক তখনই আয়শার চুল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে যান।

 

        চার ভাই একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কি করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজের অশ্রুজল মুছতে থাকেন। তিনি যে হেঁটে ওয়াশরুমে যাবেন সেই শক্তিও নেই শরীরে। 

 

        যুদ্ধাহত প্রধান সেনাপতিকে বাঁচাতে অন্যান্য সৈন্যরা যেমন ঘিরে ধরে, তেমনই ছেলেরাও সিক্ত নয়নে মাকে এসে ঘিরে ধরেছে। ইরফানের মনে তখন ঘৃণার জোয়ার বইছে। রাগে তার দাঁত কটমট করছে।

 

        রাতে খাবার দাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত দুইটা অথবা তিনটার দিকে আয়শার প্রচণ্ড কান্নার শব্দে ইরফানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। অন্য ভাইরা বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা মানুষের মত ঘুমাচ্ছেই। কেউই একটুও নড়ছে না।

 

        ইরফান সাহস করে রুম থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে; সাথে বৃষ্টির মিছিলও শুরু হয়েছে। যেন প্রকৃতিও কোনোভাবেই এই অন্যায় মেনে নিতে পারছে না। তাই ঝড়ের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইরফানের মনে হয় যে বাইরের ঝড়ের চেয়ে তার মায়ের রুমে বয়ে চলা ঝড় অনেক বেশী তীব্র এবং ভয়ানক।  

 

তার মায়ের রুমের দরজায় শরীরের সকল শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারতে থাকে। বাবার অনবরত প্রহারের ফলে মায়ের কান্না মেশানো চিৎকার বেড়েই চলেছে। আশরাফুল একপর্যায়ে গণ্ডারের মত প্রচণ্ড রাগ করে দরজায় সজোরে লাথি মারে। দরজার আঘাতে ইরফান ফুটবলের মত প্রায় পাঁচ হাত দূরে গিয়ে পড়ে।

 

        ইরফানের কপাল বেয়ে রক্ত পড়তে থাকে। রক্তের বন্যায় তার জামা লাল হয়ে গেছে। অগ্নিগিরির উত্তপ্ত লাভা একেবারে মুখে এসে যেমন প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে পড়ে, তেমনই ইরফানের ক্রোধ ন্যায় অন্যায়ের সকল বাধ ভেঙ্গে দিয়ে বোমার মত বিস্ফোরিত হয়। সে তার হাতের কাছে পড়ে থাকা লাঠি নিয়ে শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করে তার বাবার মাথায় আঘাত করে।

 

 আশরাফুল সেই আঘাতের তীব্রতায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেয়ার সাথে সাথেই ওনার মৃত্যু হয়। পুলিশ এসে ইরফানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ওদিকে বাসার অবস্থা এমন যেন কয়েকদিনের টানা ঝড়ের পরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।

View kingofwords's Full Portfolio
tags: