[হতাশাগ্রস্ত আশা আমিন মঞ্চে প্রবেশ করে। গ্রামের বুক চিড়ে সাপের মত ছুটে চলা সুন্দরী নদীর তীরে বটগাছের নীচে বসে সাত বছরের মিষ্টি শিশু আশা কাঁদছে। ঠিক ঐ সময় তারই সহপাঠী ও বন্ধু জয়নাল, রেহানা এবং ইরা সেই পথ ধরে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। আশাকে একা হতাশভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে তারা তার কাছে যায়।]
ইরাঃ [মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকা আশার পিঠে হাত দিয়ে বলে] কিরে আশা, এখানে একলা বসে কাঁদছিস কেন?
রেহানাঃ কি হয়েছে তোর বলতো?
[বন্ধু ও বান্ধবীদের উপস্থিতি এবং প্রশ্নগুলো আশাকে আরও বেশি আবেগতাড়িত করে দেয়। সে আরও জোরে কাঁদতে থাকে]
জয়নালঃ আরে বাবা, কান্না থামিয়ে বলবিতো ঠিক হয়েছে? তোর কষ্টের কারণ জানলে আমরা তোকে সাহায্য করতে পারবো, তাই না?
আশাঃ [চোখের জল মুছতে মুছতে বলে] তোরা যাতো এখান থেকে! কিছুই হয়নি আমার।
ইরাঃ [একটু রেগে গিয়ে বলে] কিছুই হয়নি তাই না? তুই কি আমাদেরকে বোকা পেয়েছিস? আমরা কি অন্ধ? কিছুই বুঝি না? তুই কোনও এক কারণে কষ্ট পেয়ে কাঁদছিস আর আমরা তোর বন্ধু বান্ধব হয়ে কি সেই কারণটি জানতে পারবো না?
আশাঃ তোদের কারোই সেই কারণ না জানলেও চলবে। এখন যাতো, আমাকে একটু একা থাকতে দে!
রেহানাঃ যাতো বললেই তো আর হবে না। তুই কি ভেবেছিস যে শুধু তোরই জেদ আছে আর আমাদের নেই? যতক্ষণ তুই তোর কষ্টের কারণ না বলিস, ততক্ষণ আমরাও এই জায়গা থেকে এক চুলও নড়বো না!
জয়নালঃ একদম ঠিক কথা! আমরা কারণ না জেনে তোকে একলা ছেড়ে যাচ্ছি না।
[আশা বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যেতে চাইলে ইরা ধমক দিয়ে তার হাত ধরে বসিয়ে দেয়।]
ইরাঃ কোথায় যাচ্ছিস? চুপচাপ বসে থাক এখানে।
আশাঃ উফ! কেন যে তোরা আমাকে এতো বিরক্ত করছিস? এমনিতেই আমার মন খুব খারাপ, তার উপর তোদের এসব টানাহেঁচড়া আমার একদম ভালো লাগছে না!
রেহানাঃ তুই কেন কাঁদছিস আমরা শুধু সেই কথাটাই জানতে চাই। তোকে বিরক্ত করার জন্য আমরা মোটেও এখানে আসিনি।
জয়নালঃ আশা, সত্যি করে বলতো, তুই কি আমাদেরকে তোর শত্রু মনে করিস নাকি?
আশাঃ কি পাগলের মত কথা বলছিস জয়নাল? তোদেরকে কেন আমার শত্রু মনে করবো?
জয়নালঃ তাহলে আর দেরি না করে চট করে বলতো!
আশাঃ তাহলে শোন, আমার মন খুব খারাপ কারণ আমার বাবা বলেছেন যে আমাকে আর স্কুলে না যেতে।
ইরাঃ [চোখ বড় করে, অবাক হয়ে বলে] কি?
রেহানাঃ তোর বাবা তোকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছে?
আশাঃ হুম! আমি সত্যি বলছি।
জয়নালঃ নিষেধ করার কারণটা কি?
আশাঃ কারণতো তোদের জানাই আছে। আমার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। পরিবারের সবার মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেবার মত অবস্থা নেই আমার বাবার। এই অবস্থায় আমার পড়ালেখার পেছনে খরচ করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। আজ সকালেই যখন বাবা আমাকে স্কুলে যেতে বারণ করেছেন, তারপর থেকেই আমার মনটা এতো খারাপ হয়েছে যে তোদেরকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
[কথাটি শেষ করতে না করতেই আশা আবারো আবেগে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তাকে কাঁদতে দেখে ইরা, রেহানা এবং জয়নালের চোখও সমবেদনার জলে ভিজে যায়।]
ইরাঃ [আশাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে] আশা, তুই আর কাদিস না! দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই গিয়ে তোর বাবাকে রাজি করাবো।
রেহানাঃ হ্যাঁ, আমরা সবাই যাবো। প্রয়োজনে স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব সোহরাব তালুকদারকেও সাথে নিয়ে যাবো।
জয়নালঃ প্রধান শিক্ষক সাহেব যদি তোর বাবাকে বোঝান, তাহলে আর কোনও সমস্যাই থাকবে না। তোর বাবা নিশ্চয়ই রাজি হবে দেখিস।
আশাঃ [কাঁদতে কাঁদতেই বলে] তোরাতো আমার বাবাকে চিনিস না! আমি খুব ভালো করেই চিনি। তিনি যা বলেন, তাই করেন। তাকে রাজি করা অসম্ভব।
ইরাঃ অসম্ভব নাকি সম্ভব এসব নিয়ে আর তোকে ভাবতে হবে না বুঝলি! সেই ভাবনা তুই আমাদের উপরই ছেড়ে দে।
রেহানাঃ [কাছে এসে আশার চোখের জল মুছতে মুছতে বলে] এখন কান্না থামাতো! চল আমাদের সঙ্গে।
আশাঃ কোথায় যাবো?
জয়নালঃ এখনো বুঝলি না রেহানা তোকে কোথায় যাবার কথা বলছে? তোকে নিয়ে এক্ষুনি আমরা প্রধান শিক্ষক সাহেবের কাছে যাবো।
আশাঃ এখনই?
ইরা, রেহানা ও জয়নালঃ [হেসে বলে] এখনই!!!
[সবাই একসাথে মঞ্চ ত্যাগ করে।]
[পঞ্চান্ন বছর বয়সী প্রধান শিক্ষক জনাব সোহরাব তালুকদার পান চিবুতে চিবুতে মঞ্চে প্রবেশ করেন এবং চেয়ারে বসেন। তার হাতে থাকা পত্রিকা পড়ছেন।]
[আশা, ইরা, রেহানা ও জয়নাল মঞ্চে প্রবেশ করে।]
আশা, ইরা, রেহানা ও জয়নালঃ [একসাথে বলে] আসসালামু আলাইকুম স্যার।
সোহরাবঃ [তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে] ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো আশা, ইরা, রেহানা ও জয়নাল? তোমরা সবাই এই সময় আমার কাছে? কি ব্যাপার বলোতো?
ইরাঃ স্যার, আমরা আপনার কাছে একটি বিশেষ অনুরোধ করতে এসেছি।
সোহরাবঃ অনুরোধ? কি অনুরোধ?
রেহানাঃ আসলে স্যার, আমার একটি বিষয়ে আপনার সাহায্য কামনা করছি।
জয়নালঃ আপনি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান আর কেউ করতে পারবে না স্যার।
সোহরাবঃ তা কি সমস্যা সেটা বলো শুনি?
ইরাঃ আসলে স্যার আমদের বান্ধবী আশা একটা বড় বিপদে পড়েছে।
সোহরাবঃ [আশার দিকে চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে বলেন] তাইতো আশাকে আজ দেখতে এতোটা দুঃখী মনে হচ্ছে। ঠিক কি হয়েছে একটু খুলে বলোতো?
ইরাঃ আশার বাবা আশাকে আর স্কুলে না যেতে বলেছেন।
সোহরাবঃ স্কুলে না যেতে বলেছেন? কেন?
রেহানাঃ কারণ তিনি নাকি আশার পড়ালেখার খরচ চালাতে পারবেন না তাই।
সোহরাবঃ [চোখের চশমা খুলে চিন্তিতভঙ্গীতে বলেন] না, না, না, এটা হতে দেয়া যাবে না! আশার মতন এতো মেধাবী ছাত্রী এভাবে অকালে ঝরে যাবে তা আমি কিছুতেই হতে দেবো না!
জয়নালঃ স্যার, আমরা জানি একমাত্র আপনিই এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারবেন। তাইতো আমরা সরাসরি আপনার কাছেই এসেছি। অনুগ্রহ করে আশাকে সাহায্য করুন স্যার!
সোহরাবঃ [একটু ভেবে বলেন] আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি দেখছি কি করা যায়। আমি নিজেই আশার বাবার সাথে কথা বলবো। তোমরা দুশ্চিন্তা করো না। নিশ্চয়ই একটা না একটা সমাধান বের হবেই। এখন তোমরা বাড়ি ফিরে যাও।
আশা, ইরা, রেহানা ও জয়নালঃ [একসাথে বলে] আসসালামু আলাইকুম স্যার।
সোহরাবঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম।
[আশা, ইরা, রেহানা ও জয়নাল মঞ্চ ত্যাগ করার পর জনাব সোহরাবও মঞ্চ ত্যাগ করেন।]
[পরদিন সকালে প্রধান শিক্ষক জনাব সোহরাব তালুকদার স্কুলের পথে হেঁটে যাবার সময় আশার বাবা আলাল মিয়াকে দেখতে পান।]
আলালঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?
সোহরাবঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইতো ভালোই আছি। তোমার কি খবর?
আলালঃ আমাদের আর থাকা? এইতো কোনও রকমে বেঁচে আছি স্যার।
সোহরাবঃ শুনলাম তুমি নাকি তোমার মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করতে চাও। কথাটা কি সত্যি?
আলালঃ জি স্যার, আপনি ঠিকই শুনেছেন। আসলে মন থেকে চাই না যে আশার পড়াশুনা বন্ধ হোক, কিন্তু আমি যে বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই কথা কেউ বুঝতেই চায় না। এতো বড় পরিবারের চাকা আমাকে একাই টানতে হয় স্যার, তার মধ্যে আশার পড়ালেখা চালানোর মতন সামর্থ আমার নেই। যদি আমার মেয়েটা কোনও টিউশন ফি ছাড়া পড়তে পারতো তাহলে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এই সুযোগতো আশাকে কেউ দিবে না, তাই না স্যার?
সোহরাবঃ [আলালের কাঁধে হাত রেখে বলেন] দেখো আলাল, তোমার মেয়েটা কিন্তু অনেক মেধাবী। আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। এখনই যদি তার পাখা কেটে দাও তাহলে সে উড়বে কিভাবে বলোতো? সে পড়ালেখা করে সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে তোমার, এই গ্রামের, এই দেশের নাম উজ্জ্বল করবে সেটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আলালঃ কিন্তু আমি যে নিরুপায় স্যার।
সোহরাবঃ [একটু ভেবে বলেন] আমি সবই বুঝি আলাল। ঠিক আছে, ভালো করে শোনো, আজ থেকে তোমার মেয়ের পড়ালেখার সমস্ত দায়দায়িত্ব আমার। তোমাকে এ নিয়ে কোনও চিন্তা করতে হবে না, ঠিক আছে?
আলালঃ [বিনয়ের সঙ্গে বলেন] আপনি কেন এসব করতে যাবেন স্যার? লোকে শুনলে আমার অসহায়ত্ব নিয়ে উপহাস করবে স্যার।
সোহরাবঃ শোনো, লোকের কথায় এই দুনিয়া চলে না, বুঝেছো! এতো কিছু ভাবার দরকার নেই। তুমি কাউকে বলার প্রয়োজনই নেই যে আমি আশার পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছি। তাহলেইতো হলো, কেউ কখনো জানতেই পারবে না!
আলালঃ [কাঁদতে কাঁদতে সোহরাবকে জড়িয়ে ধরে বলেন] স্যার, আপনি মানুষ না, আপনি একটা ফেরেশতা!
সোহরাবঃ আরে না, না, আমি তোমার মতই এক অতি সাধারণ মানুষ। ঠিক আছে, এখন তুমি তোমার কাজে যাও। পরে কথা হবে।
আলালঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার।
সোহরাবঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম।
[পরদিন আশা, ইরা, রেহানা ও জয়নাল আনন্দে হাসতে হাসতে মঞ্চের এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। তাদের সবার পিঠে স্কুলের ব্যাগ। তারা হাসতে হাসতে একে অপরের হাত ধরে মঞ্চের অন্য দরজা দিয়ে স্কুলের পথে বের হয়ে যায়।]
সমাপ্ত