আমার বাংলা ভাষা! [বাংলা নাটিকা; Bangla Playlet]

১৯ মার্চ ১৯৪৮-এ পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় এসে পৌঁছান২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে [বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান] এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দেনতাঁর ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয় এ ঘোষণার পর হতে বাঙালিদের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কেউই তাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে এভাবে গলা টিপে হত্যা করা অবস্থায় দেখতে পারে না; এ যে অসম্ভব! মনের আকাশে ধীরে ধীরে ঘৃণার মেঘ জমতে শুরু করে। বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর জন্য সকল বাধাকে পেছনে ফেলে ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি সাহসী বাঙালিরা নির্ভয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! স্লোগানে চারপাশ মুখরিত করে রাজপথে নামেন। 

 

[মঞ্চে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার প্রবেশ করেন] 

 

সালামঃ [রেগে গিয়ে বরকতের দিকে তাকিয়ে বলেন] প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এর দুঃসাহস দেখেছিস! ২১ মার্চ ১৯৪৮-এ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে ঘোষণা দিয়েছিল- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়, চার বছর পর ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় নাজিমুদ্দিন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার কথাটি আবারো উচ্চারণ করে বলে যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এটা কি কোনওভাবে মেনে নেওয়া যায় বল?

 

বরকতঃ অসম্ভব! সে বললেই হলো নাকি? তবে আনন্দের খবর এই যে নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।  

 

রফিকঃ [রেগে গিয়ে] বাহ! বীর বাঙালি আগ্নেয়গিরির মতন জেগে উঠছে! আমরা এর বিরুদ্ধে আরও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবোই!  

 

জব্বারঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, এর প্রতিবাদ করতেই হবে! কেননা এটা আমার মায়ের ভাষার প্রশ্ন। যে কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসে বললেই হলো নাকি যে এখন থেকে আমরা বাংলায় নয়, বরং উর্দুতে কথা বলবো? সালামঃ এটা কি মামার বাড়ির আবদার নাকি?      

 

বরকতঃ [সবার দিকে তাকিয়ে] তোরা নিশ্চয়ই জানিস যে ৩০ জানুয়ারি ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হন। ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 

 

[সালাম, বরকত ও রফিক একসাথে বলেন- হ্যাঁ, সেটা আমার শুনেছি।] 

 

সালামঃ শুনেছি পাকিস্তানিরা নাকি আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাব দিয়েছে, কথাটি কি সত্যি?

 

রফিকঃ ১০০ ভাগ সত্যি! ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানী দেন। সেখানে তিনি ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ  গঠন করেন।  

 

বরকতঃ শুধু তাই নয়, ঐ সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তের প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করা হয়

 

রফিকঃ এছাড়াও সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ আয়োজিত ঐ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।  

 

সালামঃ পাকিস্তানিরা ভেবেছে যে এসব আজগুবি প্রস্তাব দিয়ে হয়তো  আন্দোলন থামানো যাবে! আসলে তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে!

 

জব্বারঃ [মুচকি হেসে সালামের দিকে তাকিয়ে] তুমি একদম আমার মনের কথাটাই বললে ভাই!

 

বরকতঃ [ওদের দিকে তাকিয়ে] আজতো ২০ ফেব্রুয়ারি তাই না?

 

রফিকঃ [বরকতের দিকে তাকিয়ে] হ্যাঁ। কেন?

 

বরকতঃ সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে

 

সালামঃ [ব্যাঙ্গ করে] ধুর! ১৪৪ ধারা! এসব ফালতু ধারা-টারা দিয়ে অসীম সাহসী বাঙ্গালির বিজয় যাত্রা থামানো যাবে না!

 

জব্বারঃ আমিও সালামের সাথে একমত। আজ সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে শাহাবুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়

 

রফিকঃ এবার পাকিস্তানিরা বুঝবে- কত ধানে কত চাল!

 

বরকতঃ [সবাইকে উদ্দেশ্য করে] রাত অনেক হয়েছে। এবার তাহলে যার যার ঘরে যাওয়া যাক। মনে আছে তো, আগামীকাল সকাল ৯টায় কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে যেতে হবে। 

 

[সালাম, রফিক ও জব্বার একসাথে বলেন- হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে। সবাই করমর্দন করে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেন।]

 

[পরদিন ২১ এ ফেব্রুয়ারি। সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার মঞ্চে প্রবেশ করেন। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আছেন। তাদের আশেপাশে আরও অনেক সাহসী মানুষ সমবেত হয়েছেন। তারা সকলেই পুলিশের সামনে সমস্বরে স্লোগান দিচ্ছেন- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!] 

 

সালামঃ [প্রথমে সালাম বজ্রকন্ঠে স্লোগান দেন, তারপর বরকত, রফিক, জব্বারসহ অন্যরাও সেটি তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ করেন] রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! 

 

বরকতঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!

 

রফিকঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!

 

জব্বারঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! 

রফিকঃ [সালাম, বরকত, ও জব্বারের দিকে তাকিয়ে] আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি। 

 

[সালাম, বরকত, ও জব্বারকে মঞ্চে রেখে রফিক মঞ্চ হতে প্রস্থান করেন।]

 

[বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নেন। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কিছু ছাত্র ঐসময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে যান। বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হবার পর বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।]

 

[পুলিশরা মঞ্চে প্রবেশ করে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন মঞ্চে প্রবেশ করেন।]

 

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইনঃ [পুলিশকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলেন] দয়া করে আপনারা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা বন্ধ করুন, বন্ধ করুন...

 

[আতংকিত কণ্ঠে এ কথা বলতে বলতে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন মঞ্চ হতে প্রস্থান করেন।] 

 

 [পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে করতে মঞ্চ হতে প্রস্থান করে।]

 

সালামঃ [রেগে গিয়ে বরকতকে বলেন] পুলিশ আমাদের অনেক নিরীহ আন্দোলনকারীদেরকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে!

 

বরকতঃ এটা ঐ ধূর্ত পাকিস্তানিদের চালাকি ছাড়া কিছুই না! তারা ভেবেছে যে এমন করলে হয়তো আমাদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। আসলে আন্দোলন যে তীব্র থেকে তিব্রতর হচ্ছে সেই হিসেব তাদের নেই!

 

[রফিক মঞ্চে প্রবেশ করেন। তার সাথে একটি তরুণী।]

 

সালামঃ তোমার সঙ্গে এই মেয়েটি কে?

 

রফিকঃ আমি রাস্তার ঐদিকটায় যেতেই তার সাথে দেখা। সে আমার চাচাতো বোন। সেও আন্দোলনে যোগ দিতে এসেছে।

 

বরকতঃ কি নাম তোমার?

 

ঈশিতাঃ জি আমার নাম ঈশিতা।

 

রফিকঃ [সালাম, বরকত ও জব্বারকে উদ্দেশ্য করে বলেন] ঈশিতার কাছে একটা ভাল খবর আছে!

 

সালামঃ কি খবর ঈশিতা? তাড়াতাড়ি বলোতো!  

 

ঈশিতাঃ শুনেছি আইন পরিষদের সদস্যরা নাকি এইমাত্র আইনসভায় যোগ দিতে এসেছেন।

 

জব্বারঃ তো?

 

ঈশিতাঃ এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ! আমরা আইনসভায় গিয়ে আমাদের দাবি উত্থাপন করতে পারি, তাই না?  

 

সালামঃ হ্যাঁ, ঈশিতার কথায় যুক্তি আছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে!  

 

ঈশিতাঃ [সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের দিকে তাকিয়ে বলেন] আচ্ছা, আমি একটু ঐ দিকটায় গিয়ে দেখি কি হচ্ছে।   

 

[ঈশিতা মঞ্চ হতে প্রস্থান করেন। অনেক আন্দোলনকারীরা আইনসভার দিকে এগিয়ে যান। মঞ্চে কয়েকজন পুলিশ প্রবেশ করে। পুলিশ দৌঁড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ করে। চারদিকে কানফাটানো গুলির আওয়াজ! সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ আরও অনেকে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মঞ্চে তাদের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পর শোকার্ত জনগণ কাঁদতে কাঁদতে সেইসব নিথর দেহ মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। উল্লসিত জনতা করতালির মাধ্যমে হাসতে হাসতে মঞ্চে প্রবেশ করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন হাসতে হাসতে আনন্দের সাথে জোরালো কণ্ঠে বলেন- ঐ পাকিস্তানিরা মেনেছে হার, রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয় আর! সবার মুখে একই স্লোগান- তোমার ভাষা, আমার ভাষা! বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষা! তোমার আমার মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা, ভাষা! এসব স্লোগান দিতে দিতেই সকলে উল্লসিত অবস্থায় মঞ্চ হতে প্রস্থান করেন]




[সমাপ্ত]


View kingofwords's Full Portfolio