ছড়াই জ্ঞানের আলো [বাংলা নাটিকা: Bangla Playlet]

আজ আলোকিত মালিটারী ফুটন্ত অভিযান গ্রন্থাগারের ৭ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এমন আনন্দঘন উপলক্ষে বাল্যকালের বন্ধু মামুনের সাথে লালমনিরহাটে ঘুরতে এসে কবি তার বন্ধুর নিজ হাতে গড়ে তোলা লাইব্রেরিতে গিয়ে বসেন। কবি এসেছেন শুনে এলাকার কৌতূহলী অনেক কিশোর ও যুবক তাঁকে একপলক দেখতে এবং ভাব বিনিময় করতে এসেছে।

 

[ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত কবি মঞ্চে প্রবেশ করেন। তাঁর গালভরা কালো কুচকুচে দাড়ি দেখতে ঠিক তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন! তাঁর পেছনে মামুনও ধীর গতিতে হেঁটে আসছেন। তিনি এই গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা।]

 

কবিঃ [লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে কক্ষের চারপাশে তাকিয়ে] বাহ! বেশ চমৎকার পাঠাগার! [মামুনের পীঠে হাত রেখে] বন্ধু! বেশ অসাধারণ একটি কাজ করেছো!

মামুনঃ [গর্বের সাথে হাসতে হাসতে] অনেক ধন্যবাদ বন্ধু! দোয়া করো যেন আমার স্বপ্ন সার্থক হয়!

কবিঃ [ভ্রূ কুঁচকে মুচকি হেসে] সার্থক হয় মানে? তুমিতো সফল হয়েই গেছো! লালমনিরহাটে এতো সুন্দর সাজানো গোছানো একটি পাঠাগার নির্মাণ করেছো, এটা কি সফলতা নয়?

মামুনঃ না, মানে, বলছিলাম কি- আমি এই লাইব্রেরিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে চাই! এটির খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যেন বিদেশেও যেতে পারে এটাই আমার প্রাণের বাসনা বন্ধু!

কবিঃ [চেয়ারে বসতে বসতে বলেন] হুম! অতি উত্তম ইচ্ছা! আমি জানি একদিন তোমার এই স্বপ্ন সার্থক হবেই!

মামুনঃ শুরুতে যখন এলাকায় একটি পাঠাগার করার কথা কয়েকজনের সাথে আলোচনা করি, তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ ইতিবাচক হয়ে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দিলেও অনেকে এটি নিয়ে সমালোচনা করতেও ছাড়েনি।

কবিঃ যে কোনও ভালো কাজ শুরু করলেতো সমালোচনা থাকবেই, তাই না? মিষ্টি গুঁড় থাকলে কিছু নচ্ছার মাছিও থাকবে! যারা হাল ছেড়ে না দিয়ে নিজের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে কাজে নেমে পড়ে, ভবিষ্যতে তারাই সফল হয়।

মামুনঃ একেবারে আমার মনের কথাটাই বললে বন্ধু! তবে শুরুটা অনেক কষ্টের ছিল। নিজের যেটুকু সম্বল ছিল তাই দিয়ে কোনোভাবেই সবকিছু সামলানো যাচ্ছিল না। পরে আমার কিছু বন্ধু এবং এলাকার গণ্যমান্যদের সহযোগিতায় তিল তিল করে পাঠাগারটিকে আজ এই অবস্থানে নিয়ে এসেছি।

কবিঃ [বইয়ের তাক থেকে একটি বই হাতে নিতে নিতে বলেন] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন- ছোট ছোট বালুকণা/বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ/সাগর অতল! দশের লাঠি একের বোঝা বন্ধু!

মামুনঃ বন্ধু, তোমার সাথে দেখা করার জন্য, একটু কথা বলার জন্য বাইরে বেশ কিছু মানুষ অপেক্ষা করছে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে আমি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসতাম! আসলে তারা তোমার কাছ থেকে একটু পরামর্শ, একটু অনুপ্রেরণা পেলেই কৃতজ্ঞ থাকবে।

কবিঃ [মুচকি হেসে] আরে না, না, আপত্তি থাকবে কেন? যাও তাদেরকে আসতে বলো।

মামুনঃ অনেক ধন্যবাদ বন্ধু! আসলেই তুমি মহান!

কবিঃ [লাজুক ভঙ্গীতে হেসে] মামুন, এসব বলে আমাকে লজ্জা দিও নাতো! যাও ওদেরকে নিয়ে এসো।

মামুনঃ ঠিক আছে।

 

[মামুন উঠে মঞ্চের বাইরে চলে যান। এদিকে কবি সেই বইটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকেন। মামুন বেশ কিছু মানুষ সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেন। তাদেরকে দেখে কবি মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ান।]

 

মামুনঃ এই যে, এরা সবাই তোমার এতোটাই ভক্ত যে তুমি কল্পনাই করতে পারবে না!

কবিঃ তাই নাকি?

মামুনঃ হ্যাঁ, তাই। তোমার প্রতিটি লেখা এদের পড়া। তোমার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে সব ধরণের লেখাই এরা মনোযোগ দিয়ে পড়ে।

কবিঃ [এক কিশোর ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন] কি নাম তোমার?

আলোঃ আমার নাম আলো।

কবিঃ আলো? বাহ বেশ সুন্দর নাম! শিক্ষার আরেক নাম আলো, জানোতো?

আলোঃ জানি! আপনার বই পড়ে আমরা অনেক নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারি। আপনাকে এখানে আমাদের সামনে দেখতে পারবো, কথা বলতে পারবো এমনটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি!

কবিঃ [সেখানে দাঁড়ানো সজলের হাতে ডায়রি দেখে সেটির দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে বলেন] তোমার হাতে ওটা কি? বই?

সজলঃ জি না, এটা একটি ডায়রি।

কবিঃ হাতে ডায়রি কেন?

সজলঃ এই ডায়রিতে আমার নিজের লেখা কিছু কবিতা আছে। আপনার অনুমতি পেলে সেখান থেকে একটি কবিতা পড়ে শোনাতে চাই। তাছাড়া ডায়রিতে আপনার একটি অটোগ্রাফও নিতে চাই!

কবিঃ [একটু অবাক হয়ে] বাহ! এইটুকুন বয়সে কবিতাও লিখো দেখছি! [আনন্দে মামুনের দিকে তাকিয়ে] মামুন, তোমাদের এলাকায় দেখছি অনেক মেধাবী তরুণ আছে!

মামুনঃ আছে, আসলে তাদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যই আমার আপ্রাণ চেষ্টা। অন্যরাও যদি এইসব মেধাবী তরুণ তরুণীদেরকে সামনে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়ে দেয়, তবে একটি সুন্দর সমাজ, জাতি তথা দেশ গঠন করা খুব কঠিন কিছু হবে না।

কবিঃ একদম খাঁটি কথা! [সজলের দিকে তাকিয়ে] কি নাম বললে যেন তোমার?

সজলঃ সজল।

কবিঃ ও হ্যাঁ, সজল! ঠিক আছে সজল। তুমি তোমার লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করো, আমরা সবাই শুনবো।

সজলঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার এই কবিতাটির নাম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী!। এটি আবৃত্তি করার চেষ্টা করছিঃ


দেখতে দেখতে আরও একটি বছর গড়ালো,


ঠিক যেন ঘড়ির কাটার চাকার মতন,


আবারো প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এলো!


আবারো হবে আনন্দের উন্মোচন!


 

হাসে মন শিশুর মতন,


অতি উল্লাসে মন আজ পায়রা!


উড়েই চলেছে দিগ্বিদিক বিলক্ষণ!


আনন্দের ভেলায় আজ ভাসছি মোরা!


 

নজরুলের মত বলি, “তোরা সব জয়ধ্বনি কর!”


উজাড় করে মন আলিঙ্গন কর এই আনন্দের প্রহর!


 

[সজল কবিতাটি আবৃত্তি করা শেষ করেছে।]

 

কবিঃ [হাত তালি দিলে উপস্থিত অন্যরাও হাত তালিয়ে দেন। তালি দিতে দিতে কবি বলেন] বাহ! দারুণ! এককথায় অসাধারণ! যেমন সুন্দর শব্দের গাঁথুনি, তেমনি সুন্দর আবৃত্তি!

সজলঃ [আনন্দে আত্মহারা হয়ে] আপনার এতো ভালো লেগেছে শুনে অনেক অনেক খুশী হয়েছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!

কবিঃ ধন্যবাদ আমাকে নয়, ধন্যবাদ তুমি পাবার যোগ্য! সত্যি বলছি, এতো সুন্দর আবৃত্তি আমি খুব কমই শুনেছি!

 

[উৎসুক লোকের ভিড় বাড়তে থাকে। তাদের মধ্যে সৃজন নামে একজন যুবক ভিড় ঠেলে সামনে এসে বিনীতভাবে কবিকে প্রশ্ন করেন।]

 

সৃজনঃ হে পরম শ্রদ্ধেয় কবি! আমার নাম সৃজন। আপনি যদি আমাদেরকে ভবিষ্যতে সফল হবার জন্য কিছু মূল্যবান পরামর্শ দেন, তাহলে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকবো!

কবিঃ তরুণদের কিছু করার এই যে অদম্য ইচ্ছা সেটা জানতে পেরে আমার খুবই ভালো লাগছে। এই ইচ্ছাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। একটি ছোট চারা গাছ যেমন সময়ের সাথে সাথে বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি তোমাদের এই ইচ্ছেগুলো স্বপ্ন হয়ে ভবিষ্যতে সফল মানুষে পরিণত করবে। আলো যেমন সূর্যের শক্তি, ঠিক তেমনি ইচ্ছেগুলো তোমাদের চালিকাশক্তি। জানোই তো- ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়!

সৃজনঃ আসলে আমি ব্যবসা করতে চাই কিন্তু আমার বাবা মা চান আমি পড়ালেখা শেষ করে ব্যবসা বা চাকরি যা ইচ্ছা করতে পারি। সত্যি কথা বলতে পড়ালেখা করতে আমার মোটেও ভালো লাগে না।

কবিঃ তোমার বাবা মার কথায় কোনও ত্রুটি নেই। আমি তাদের কথার সাথে একশো ভাগ একমত পোষণ করছি। দেখো, জীবনে যে পেশাই বেছে নাও না কেন, আগে নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তুমি যদি সত্যিকারের মানুষ হতে চাও, তাহলে পড়ালেখার কোনও বিকল্প নেই!

সৃজনঃ [কাচুমাচু করে] বেয়াদবি মাফ করবেন, এতো পড়ে কি হবে?

কবিঃ আমি আগেই বলেছি যে শিক্ষা মানে আলো। শুধুমাত্র একটি মোমবাতি যেমন অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করে দেয়, ঠিক তেমনি বই পাঠ করে তুমি যে জ্ঞানের আলো অর্জন করবে, সেই আলোয় তুমিতো আলোকিত হবেই, পাশাপাশি তোমার আশেপাশের মানুষও আলোকিত হবে।

সৃজনঃ [বিনীতভাবে বলে] যদি আরেকটু বিস্তারিত বলতেন!

কবিঃ আসলে আমি যেটা বোঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে এই যে তুমি জ্ঞানের মর্যাদা দিতে জানলে তোমার কাছ থেকে অন্যরাও অনেক কিছু শিখতে পারবে, জানতে পারবে। তোমার কাছ থেকে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে। তাছাড়া শিক্ষা তোমাকে সভ্য, মার্জিত ও মানবতাবাদী হতে শেখাবে। বর্তমানে সমাজে সত্যিকারের সভ্য এবং মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষের বড়ই অভাব!

সৃজনঃ [মুচকি হেসে বলে] জি জি, এখন বিষয়টি পানির মতন পরিস্কার। আপনার প্রতিটি কথাই মেনে চলবো। আমার জন্য দোয়া করবেন।

কবিঃ দোয়াতো সবসময় থাকবে। [সবার দিকে তাকিয়ে] আমার জন্যও তোমরা সবাই দোয়া করবে। তোমরা সবাই জীবনে ভালো মানুষ হও এবং কারো জীবনে যেন দুঃখের কালো ছায়া না আসে মন থেকে এই প্রার্থনাই করি। [মামুনের দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখে বলেন] মামুন, আমাকে এখন উঠতে হবে।      

মামুনঃ [সকল উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে বলেন] আপনারা এতো কষ্ট করে এসেছেন বলে সবাইকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি কবিকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও আজকের এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমাদের মাঝে এসেছেন বলে। এখন কবির যাবার সময় হয়েছে। তবে তিনি ভবিষ্যতে আবারো আমাদের মাঝে আসবেন ইনশাল্লাহ। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

 

[কবি এবং মামুন উঠে লাইব্রেরির অর্থাৎ মঞ্চের বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হন। যেতে যেতে ভক্তদেরকে কবি অটোগ্রাফ দেন এবং করমর্দন করেন। সবাই মঞ্চ হতে বিদায় নেন।] 

 

 

সমাপ্ত

View kingofwords's Full Portfolio
tags: