কেউ যখন যা চায় তাই পায়, কেউ শুধুমাত্র একটি জিনিস চায়, তাও পায় না। জীবনের এমন প্রহেলিকার রহস্যভেদ করা সত্যিই বড় কঠিন! অনেক বছরের সাধনার পরে ময়না মিয়া এবং কইতরি বেগমের ঘরে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। পুত্র দেখতে রাজকুমারের মতন না হলেও এই মুহূর্তে তাদের জীবনে শিশুটি যেন স্বর্গ হয়ে এসেছে!
কত প্রার্থনা, কত সাধনা, কত দান খয়রাতের পর নিঃসন্তান দম্পতির ঘরে সূর্যের আলোর মতন এই শিশুর জন্ম হয়েছে। সূর্যের সাথে মিল রেখেই তার নাম রাখা হয়েছে সুরুয মিয়া। কিন্তু ময়না এবং কইতরির এখনও অনেক জটিল মোড়, অনেক জটিল বাঁক এখনও অশরীরীর মতন অপেক্ষা করছে।
অকস্মাৎ সুরুযের হৃদস্পন্দন থেমে গেলে ময়না পাগলের মতন ডাক্তারকে ডেকে আনে। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার মুখটা হঠাৎ করেই কেমন যেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে যায়; অনেকটা স্বচ্ছ মেঝেতে আলকাতরা পড়ে নোংরা হয়ে যাবার মতন! ডাক্তারকে মূর্তির মত নিশ্চুপ থাকতে দেখে ময়না চিৎকার করে বলে,
- আমার সুরুযের কি হইছে ডাক্তার সাব? কি হইছে কন?
- আমি দুঃখিত ময়না, তোমার ছেলে মারা গেছে। আমাদের আর কিছুই করার নেই!
- এইডা আফনে কি কন ডাক্তার সাব? এইমাত্র তারে কোলে লইলাম, আমার পোলায় হাত পা লাইড়া কানলো, অহন আফনে কইতাছেন পোলাডা মইরা গেছে? আবারও ভালো কইরা পরীক্ষা কইরা দেহেন ডাক্তার সাব!
- আর দেখে কোনও লাভ নেই ময়না। হায়াত মউত সব আল্লাহ্র হাতে। শান্ত হও; মনকে শক্ত করো।
ময়না এবং কইতরির কান্নার চাপে পুরো হাসপাতালের কলরব মুহূর্তে চাপা পড়ে যায়। পাথরের টুকরোর মতন মৃত সুরুযকে যক্ষের ধনের মতন বুকে চুপে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। যে বাড়িতে শিশু জন্মের ফলে সবার মুখে হাসি থাকার কথা সেখানে আজ কান্নার সাগর বয়ে যাচ্ছে। আত্মীয় স্বজনরাও বুক চাপড়ে মাতম করতে থাকে।
নিয়মকানুন মেনে বিকেলে প্রাণের ধনকে দাফনের জন্য বাড়ির পেছনের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। যেইমাত্র সুরুযের মৃতদেহ কবরে শায়িত করার জন্য নামানো হয়, ঠিক তখনই সুরুযের শরীর নড়ে উঠে! সে কেঁদে উঠে!
আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের চক্ষু চড়কগাছ! কেউ বুঝে উঠতে পারছে না যে কি ঘটছে! আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত ময়নাকে সেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার নিবিড় পরিচর্যা চলতে থাকে। এদিকে ময়না, তার স্ত্রী এবং আত্মীয়দের মুখে হাসি ফিরে এসেছে ঠিকই, তার পাশাপাশি এক ধরণের আশঙ্কাও তাদের মনে ভর করেছে। তাদের মনে এই ভয় যে আবারও যদি ময়না তাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যায়। ময়নার আত্মীয়দের মধ্যে দুয়েকজন উচ্চস্বরে বলতে থাকে- “এইডা কিরম হাসপাতাল? কি ছাতার ডাক্তার এই জায়গায়? জেতা মাইনষেরে কয় মইরা গেছে?” এই কথাগুলো পারমাণবিক বোমা হতে সৃষ্ট ধোঁয়ার মত জনে জনে ছড়িয়ে পড়ে। যেন অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা অগ্নিগিরি আচমকা জেগে উঠেছে!
ক্ষোভের বাধ ভেঙে যায়; উপস্থিত জনতা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে হাসপাতালের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। গেইটের দারোয়ান এবং একজন ডাক্তারকে ধরে চোরের মতন বেদম পেটানো হয়। ইতোমধ্যে গণ মাধ্যমের কর্মীরা এসে উপস্থিত হয়; কিছুক্ষণ পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
সুরুয এখন সুস্থ; পুলিশ ময়না এবং কইতরিকে কথা দিয়েছে যে এর বিষয়টি সতর্কতার সাথে অনুসন্ধান করে প্রকৃত দোষীদেরকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে।