রাত ঠিক তিনটা বাজে। সোহেলের বড্ড প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে। প্রকৃতির ডাক এবং পাওনাদার সময়ে অসময়ে চলে আসে! যাইহোক, বাসা থেকে পায়খানা খানিকটা দূরে হওয়াতে সোহেল বাসার পাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তুলা গাছের কাছেই যথারীতি কর্মটি সারে।
বাসায় এসে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দেবার সাথে সাথে সোহেলের ঘুম চলে আসে। প্রায় দশ মিনিট পর তার নাভির চারপাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হলে সে বিছানায় উঠে বসে। ব্যথার মাত্রা এতো বেশী যে মুখ ফুটে মা মদিনাকে ডাকার শক্তিটুকুও যেন শরীরে অবশিষ্ট নেই। অনেক কষ্টে দুই তিনবার “মা” বলে চেঁচাতেই মদিনা বাতাসের মত ছুটে আসে।
কক্ষের বাতি জ্বালিয়ে মদিনা দেখে যে তার একমাত্র ছেলে সোহেল বিছানায় উপুড় হয়ে কুকুরের মতন কোকাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখে যে তার দুই হাত পেটের উপর চেপে ধরা এবং মুখ দিয়ে অনবরত সাবানের মত ফেনা বের হচ্ছে!
মদিনার পুরো শরীর বরফের মতন হিম হয়ে আসে। এতো রাতে ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাবে, কিভাবে চিকিৎসা করাবে এই দুশ্চিন্তায় তার মাথা একটুও কাজ করছে না। মদিনা প্রতিবেশী রিকশাচালক আখলুসের বাসায় গিয়ে দরজায় ধপাধপ আঘাত করলে আখলুসের স্ত্রী ফাতেমা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
- কি গো, সোহেলের মা, এতো রাইতে দরজা বাইরাও কেন?
- আমি বড় বিপদে পইড়াই দরজা বাইড়াইছি গো বইন!
- কি অইছে একটু খুইলা কও দেহি?
- আমার সোহেল কেমন জানি করতাছে! খালি মুখ দিয়া ফেনা বাইর অইতাছে!
- আইচ্ছা, তুমি এতো অস্থির অইও না; তুমি ঘরে যাও, আমি তাইনরে লইয়া অহনি আইতাছি।
- আইচ্ছা বইন।
সোহেল সেই আগের মতই কোকাচ্ছে; মুখ থেকে নির্গত হওয়া ফেনার পরিমাণ ক্রমে বেড়েই চলেছে। আখলুস এবং মদিনা এসে উপস্থিত; আর একটুও কালক্ষেপণ না করে আখলুস সোহেলকে কোলে নিয়ে রিকশায় তুলে। সোহেলের মা রিকশায় পরম যতনে তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে ঠিক যেমন করে কেউ যত্ন করে গুপ্তধন আগলে রাখে তেমনি।
ঘর থেকে সরকারি হাসপাতাল খুব একটা দূরে নয়। যাত্রা পথে হঠাৎ কেন জানি মদিনার মনে হয় যে তার ছেলের শরীরে কোনও দুষ্টু আত্মা ভর করেনিতো? মদিনা ভূত, প্রেত এসবে খুব বেশী বিশ্বাস করে। এলাকায় ভূতের আসর থেকে মুক্তিদানের জন্য রস মোল্লার অনেক খ্যাতি। কিন্তু এতো রাতে রস মোল্লাকে কিভাবে খবরটা দেয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে মদিনা আখলুসকে বলে,
- আখলুস, তোমারে একখান অনুরোধ করি।
- কও সোহেলের মা, কি কইবা?
- তুমি সোহেলরে হাসপাতালে পৌঁছাইয়া দিয়া বাসায় ফিরার পথে রস মোল্লারে একটু কইতে পারবা?
- কি কমু?
- কইবা যে আমি তাইনরে অনুরোধ করছি যাতে তাইন একটু কষ্ট কইরা হাসপাতালে আহেন।
- আইচ্ছা, কইমু নে। এইডা লইয়া কুনো চিন্তা কইরো না বইন।
- লগে আরেকখান কথা কইও।
- কি কথা?
- কইও যে আমি নিজে আইয়া তাইনরে কওয়ার সুযোগ পাইছি না। আশা করি তাইন বিষয়ডা বুঝবাইন।
- আইচ্ছা, ঠিক আছে।
হাসপাতালে ঠিকঠাক মত পৌঁছে দিয়ে আখলুস ফিরতি পথে রস মোল্লাকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে মদিনার বলা কথাগুলো তার কানে পৌঁছে দেয়। রস মোল্লা পরোপোকারী ব্যক্তি। অপরের বিন্দুমাত্র উপকারে আসতে পারলে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন। এর বিনিময়ে অবশ্য তিনি কখনোই কোনও উপরি পাওনার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন না। তবুও মানুষ খুশী হয়ে তাকে কিছু না কিছু দিয়ে যায়- সেটা হতে পারে নিজের গাছের পাকা কাঁঠাল অথবা সদ্য কেটে আনা কচি লাউ ইত্যাদি।
রস মোল্লা দেরী না করে হাসপাতালে পৌঁছে যান। সোহেল যে কক্ষে আছে সেটি খুঁজে পেতে তাকে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। রস মোল্লা উপস্থিত হতেই মদিনার চোখে মুখে প্রশান্তির আবেশ ছড়িয়ে পড়ে; গ্রীষ্মের দাবদাহে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া জমি যেমন বৃষ্টির নাচনে আবারও বেঁচে উঠে ঠিক তেমন।
রস মোল্লা দেখতে পান যে ডাক্তার এবং নার্সরা সোহেলের অপারেশনের জন্য প্রায় প্রস্তুত। এমন সময় তিনি ডাক্তারকে বিনীত কণ্ঠে বলেন,
- ডাক্তার সাহেব, আমার একটা অনুরোধ আছে।
- তার আগে অনুগ্রহ করে আপনার পরিচয়টি দিন।
- আমি এই রোগীকে চিনি, আমার এলাকায় থাকে। তার মা আমাকে খবর পাঠিয়েছে বলেই আমি ছুটে এসেছি।
- বুঝতে পেরেছি। তাহলে বলুনতো আপনি কি বলতে চান?
- আমার বিনীত অনুরোধ এই যে আপনি দয়া করে আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন।
- সময়? কেন?
- এই বিশ মিনিটে আমি আমার নিজস্ব উপায়ে রোগীকে সারিয়ে তুলতে সাধ্যমত চেষ্টা করবো; যদি আমি এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সফল হতে না পারি তাহলে আপনি তার অপারেশনের কাজটি শুরু করতে পারেন।
- কিন্তু রোগীর অবস্থা এতোটাই মারাত্মক যে আর এক মিনিট সময় নষ্ট করলেও তার জীবন চলে যেতে পারে। এখনই অপারেশন করাটা অত্যন্ত জরুরী।
- আমিতো বলেছি আপনাকে আমার উপর একটু আস্থা রাখুন।
- দেখুন, রোগীর মাও এখানে উপস্থিত আছেন; তিনি যদি সায় দেন তাহলে আমারও কোনও আপত্তি নেই। তাছাড়া আপনার প্রচেষ্টা যদি বিফল হয় এবং রোগী মৃত্যুবরণ করে তাহলে কিন্তু এর দায়ভার আমি বা হাসপাতাল নেবে না এই মর্মে আপনাকে কাগজে দস্তখতসহ লিখিত দিতে হবে।
- ঠিক আছে, আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করছি।
কাগজে দস্তখত দেবার কার্যপ্রণালী শেষে রস মোল্লা সোহেলের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে পবিত্র কোরআন শরীফের কিছু আয়াত আবৃত্তি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি সোহেলের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলেন,
- তোর নাম কি?
- আমার নাম রিতা রানী দেব।
- তুই এই ছেলের দেহে প্রবেশ করেছি কেন?
- সে আমার ছায়ার উপরে প্রস্রাব করেছে তাই।
- তুই এক্ষুনি তার দেহ ছেড়ে চলে যা।
- না, আমি কখনও তাকে ছেড়ে যাবো না।
- কেন যাবি না?
- তাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।
- তুই ভালোয় ভালোয় চলে যা, তা না হলে আমি তোকে উচিত শিক্ষা দেবো।
- তুই কি করবি কর! আমি যাবো না!
- আচ্ছা, দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি মজা!
রস মোল্লা সোহেলের এক কানে এক লিটার দুধ ঢালার পরে আরেক কানে ঢালতে ঢালতে বলেন,
- কি, যাবি না?
- ঠিক আছে, যাচ্ছি, যাচ্ছি!
- সত্যি যাবি তো?
- হ্যাঁ, সত্যি যাবো!
- তুই যখন যাবি তখন আমি বুঝবো কিভাবে যে তুই তার দেহ ছেড়ে যাচ্ছিস?
- তাহলে আমি কিভাবে প্রমাণ দেবো বল?
- তুই যাবার সময় হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কড়ই গাছের একটি বড় ডাল ভেঙে দিয়ে যাবি।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি তাই করছি।
- যা, আর কখনও এই ছেলের শরীরে প্রবেশ করবি না, ঠিক আছে!
- হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমি এখনি চলে যাচ্ছি।
- যা।
এক মিনিট পরে হাসপাতালের বাইরে কড়ই গাছ থেকে একটি বেশ বড় মাপের ডাল মটমট করে ভেঙে পড়ে। রস মোল্লা এবং মদিনার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে প্রেতাত্মাটি সত্যিই সোহেলের দেহ ছেড়ে চলে গেছে। এতক্ষণ ডাক্তার এবং অন্যান্য নার্সগণ রস মোল্লার এই অদ্ভুত কর্মযজ্ঞ স্টেডিয়ামে চলা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ খেলা দেখতে থাকা নির্বাক দর্শকের মতন হা করে তাকিয়ে দেখছিলেন।
সোহেল উঠে বসে; তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে সদ্য প্রস্ফুটিত কোনও ফুলের মতন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। সে অবাক চোখে তার মা, রস মোল্লা এবং অন্যান্যদের দিকে তাকায়। সে মনে মনে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে যে সবাই তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন।
মদিনার চোখে আনন্দ অশ্রু; “বাপধন গো” বলে সোহেলের দিকে ছুটে গিয়ে তার চোখে মুখে আদর এবং সোহাগের চিহ্ন একে দেয়। সোহেলের আচার আচরণে এবং কথাবার্তায় কোনও প্রকার ব্যাধির ছাপ না দেখতে পেয়ে ডাক্তার এবং নার্সগণ যথারীতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। যে বিজ্ঞানের প্রণিধিগণ সর্বপ্রকার কুসংস্কারের বিপক্ষে, তাদের সামনেই রস মোল্লা একটি প্রেতাত্মাকে তাড়িয়ে দিয়ে সোহেলকে সুস্থ করে তুলেছে- এই বিষয়টি যে হাসপাতালের বাঘা বাঘা শিক্ষিত ডাক্তার এবং নার্সগণের হজম হবার নয় তা সহজেই বোধগম্য হয়! হয়তো তারা মনে মনে বিজ্ঞান, কুসংস্কার, ভূত, প্রেত, যুক্তি ইত্যাদির হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছেন। এমনও হতে পারে যে তাদের মাঝে কারো কারো হিসেব মিলছে; কারো মিলছে না। কিন্তু মদিনা ঠিকই জানে যে “বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!”