শ্মশানঘাটের ভূতের কথা জমশেদপুর গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলেই জানে এবং বেশীরভাগ লোকেই মানে! শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা এই যে সেখানে প্রেতাত্মা বা অশরীরীদের আনাগোনা রয়েছে। প্রায়ই নাকি গ্রামের অনেকেই গায়েব হয়ে যায় এবং তার সাথে সেই শ্মশানঘাটের ভূতদের সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান।
অনেকে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করলেও গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলী এসবে একেবারেই পাত্তা দেন না। তিনি নিজে যেমন যাবতীয় কুসংস্কারের বিপক্ষে, তার সন্তানদেরও এমনভাবে মানুষ করেছেন যেন যেখানেই কুসংস্কারের গন্ধ পাবে, সেখানেই যেন তারা বজ্রের মতন প্রতিবাদী হয়ে উঠে।
একদিন কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে মঞ্জুর সাহেবকে ঢাকা যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। তখন প্রায় দুইটা বাজে। এমনিতেই গ্রামে রাত ৮টা মানেই অনেক রাত। ঘরবাড়ির আলো নিভে যায়, ঝিঁঝিঁ পোকারা চারিদিকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে থাকে, খেঁকশিয়ালরাও চোরের মতন তাদের কর্মকাণ্ডে মেতে উঠে।
মঞ্জুর সাহেব হাটের কাছে এসে রিকশাওয়ালাকে বিদায় করে দিয়ে পায়ে হাঁটতে থাকেন। তিনি পদব্রজে যাচ্ছেন তার কারণ হচ্ছে এই যে হাট থেকে বাসা পর্যন্ত যে রাস্তা সেটি এতোটাই ভাঙা দেখে মনে হয় যেন কেউ পারমাণবিক বোমা মেরেছে বলেই এই দশা!
যাইহোক, সেই শ্মশানের কাছে আসতে না আসতেই পেছন থেকে কেউ একজন মঞ্জুর সাহেবের কাঁধে হাত রাখেন। সেই স্পর্শ এতোটাই শীতল যেন ফ্রিজের বরফ! ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে যেখানে নিজের হাত পাই ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না, সেখানে সেই মানুষটির চেহারা দেখার কথাতো ভাবাই যায় না! মঞ্জুর সাহেব দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
- কে?
- মঞ্জুর সাহেব, আমি।
- দয়া করে আপনার নামটা একটু বলবেন? অন্ধকারে আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।
- আমার নাম মফিজ, রিকশা চালাই।
- ও মফিজ! হ্যাঁ, চিনেছি চিনেছি। তা তুমি এতো রাতে এখানে কেন? কোনও দরকার?
- হ স্যার, আমার কিছু টেকার খুব দরকার। আমার মাইয়াডার ব্যারাম। তারে ভালা হাসপাতালে না নিলে বাঁচান যাইবো না! আফনে যদি আমারে একটু সাহাইয্য করতেন তাইলে মেলা উপকার অইতো।
- বুঝেছি, তোমার মেয়ের কথা শুনে আমারও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু এতো রাতে আমার সাথে তো তেমন টাকাপয়সা নেই। এক কাজ করো, তুমি আমার সাথে বাসায় চলো, সেখানে গিয়ে না হয় দেয়া যাবে।
- কিছু মনে কইরেন না স্যার, আফনের সাথে কম বেশী যা আছে তা দিলেই অইবো। আফনের বাসায় অহন আর যামু না।
- আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি আমার পকেটে কত টাকা আছে।
- জে।
- এই নাও, সর্বসাকুল্যে চারশো টাকা আছে, কাল সকালে এসো, তখন আরও কিছু দেবার চেষ্টা করবো, ঠিক আছে?
- স্যার, আফনে আমার কি যে উপকার করলেন হেইডা মুখে কইতে পারুম না! অহন যাই তাইলে। সালাম স্যার।
- ঠিক আছে।
সেই রাতে দ্রুত কিছু খাবার খেয়েই মঞ্জুর সাহেব ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন সকালে তিনি তার স্ত্রী রাহেলাকে গত রাতে রিকশাওয়ালা মফিজের ঘটনাটি বললে রাহেলা এমন ভাব করেন যেন তিনি এইমাত্র আকাশ থেকে পড়েছেন! তার মুখটি দেখতে বরফের মতন ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়। মুখে কোনও প্রশ্ন নেই, দুচোখে আতংকের ছাপ। মঞ্জুর সাহেব প্রশ্ন করেন,
- কি ব্যাপার, মফিজের কথা শুনে চোখমুখ এমন করেছো কেন? দেখে মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখেছো!
- তুমি কি সত্যিই ঐ রিকশাওয়ালা মফিজকে দেখেছো?
- হ্যাঁ! তাইতো বলছি। তাকে কিছু টাকাও দিলাম।
- কিন্তু তুমি যেদিন ঢাকা গেলে সেদিনইতো রাস্তায় ট্রাকের নীচে চাপা পড়ে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হলো?
- বলো কি?
- হ্যাঁ, সত্যি বলছি!
- তাহলে শ্মশানের ওখানে আমি কাকে দেখলাম?
ভয়ে রাহেলার শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায়। মঞ্জুর সাহেবের চেহারায়ও এক অজানা আতংকের ছায়া নেমে এসেছে যেন। তারপর কেউ কোনও কথা বলে না। যেন নিস্তব্ধতা তাদের মুখ থেকে সকল কথা কেড়ে নিয়েছে!