প্রযুক্তি হচ্ছে ছুরির মতন; কেউ এটাকে ভালো কাজের জন্য ব্যবহার করে, কেউ করে মন্দ কাজের জন্য! বাবার কাছে অনেক আবদার, অনেক কাকুতি মিনতি করার পরেও কোনও ফল হয়নি! রাহাত হায়াত তার একমাত্র ছেলে নীলকে মোবাইল ফোন কিনে দেবেন না বলেই মিশরের পিরামিডের মতন স্বীয় অবস্থানে অটল থাকেন।
শেষমেষ আর কোনও উপায়ান্তর না দেখে নীল তার মা সিতারা হায়াতের শাড়ির আঁচল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিনীত অনুরোধ করে বলে,
- মা, দেখো না, বাবাকে এতো করে বলেছি একটি মোবাইল ফোন কিনে দেবার জন্য কিন্তু বাবা সেই প্রথম থেকেই ‘না’ ‘না’ করেই যাচ্ছেন!
- এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছিস কেন? যা ভাগ এখান থেকে! আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। তোর এসব ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান শোনার সময় আমার নেই!
- তুমি একটু বাবাকে বললে কি হয়?
- আমি বলেও কোনও লাভ হবে না। তুই তোর বাবাকে চিনিস না? তিনি যেটা বলেন সেটাই করেন।
- আমি জানি তুমি একবার বুঝিয়ে বললে তিনি কিছুতেই না বলবেন না; ঠিকই আমাকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেবেন।
- এতো ‘মোবাইল’ ‘মোবাইল’ করিস কেন বলতো? এতো অল্প বয়সে ফোন দিয়ে কি করবি? শুধু শুধু টাকার অপচয়!
- বাবা এতো কিপটুস কেন?
- তোর বাবা মোটেও কিপটে না! তিনি যা করছেন তোর ভালোর জন্যই করছেন।
- ফোন না কিনে দিয়ে কি ভালো করা হচ্ছে শুনি?
- ফোন হাতে আসার সাথে সাথেই তুই দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবি। মোবাইলে গান শোনা, ছবি দেখা, ফেইসবুকে পড়ে থাকা ইত্যাদি করে করে পড়ালেখার বারোটা বাজবে বলেই তোর বাবা তোকে ফোন কিনে দিচ্ছেন না।
- আমার সব বন্ধুদের ফোন আছে, শুধু আমারই নেই!
- তাতে কি? তোর কাউকে কল করার প্রয়োজন হলে আমাকে বলবি, আমার ফোন থেকে কথা বলবি।
- না, আমার নিজস্ব ফোন চাই! আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে টিটকারি করে; মুখ ভেংচি কেটে বলে, “নীলের ফোন নেই!”
- আচ্ছা, দেখি তোর বাবাকে বলবো। এখন যা তো!
- সত্যি বলবেতো, নাকি আমাকে বোঝানোর জন্যই বলছো?
- আরে বাবা, কি যে মুশকিলে পড়েছি! বললামতো বলবো, এখন আমাকে একটু শান্তিতে কাজ করতে দিবি?
- যাচ্ছি, যাচ্ছি! তুমি আমার লক্ষ্মী মা!
সিতারা ছেলের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাহাত সাহেবকে মোবাইল ফোন কিনে দেবার কথাটি বলেন। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন যে সমুদ্রের সব পানি শুকিয়ে ফেলা হয়তো সম্ভব হতে পারে, কিন্তু তার স্বামীর মুখ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া কথার নড়চড় করা সম্ভব নয়! রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তিনি স্বামীকে বলেন,
- এই শুনছো!
- কি!
- বলছিলাম কি নীল তো একটি মোবাইল ফোনের জন্য পাগল হয়ে আছে! সারাক্ষণ আমার পেছনে পেছনে “মোবাইল” “মোবাইল” বলে ছাগলের মতন ঘুরতে থাকে!
- আমিতো তাকে আগেই বারণ করেছি। এই বয়সে তার ফোন ব্যবহার করার কোনও প্রয়োজন নেই।
- আমিও তাকে সে কথাই বলেছি; কিন্তু নীল বলছিল যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারলে নাকি তার পড়ালেখায় অনেক সুবিধা হবে।
- সুবিধা? কিসের সুবিধা?
- মানে বলছিল যে ইন্টারনেট থেকে নাকি পড়ার জন্য দরকারি তথ্য, ভিডিও ইত্যাদি নিয়ে কাজে লাগাতে পারবে।
- এসবই তার ফন্দি! সে এসব কথা বলে তোমাকে রাজি করাতে চেষ্টা করেছে, অন্য কিছু না।
- তাহলে আবার যদি সে আমার কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করে তখন আমি কি বলবো?
- বলবে যে মোবাইল ফোন কিনে দেয়া হবে না।
পরদিন সকালে স্কুলে যাবার আগে নীল তার মায়ের কাছে এসে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
- মা, ও মা, বাবাকে মোবাইল ফোন কিনে দেবার কথা বলেছো?
- হ্যাঁ, বলেছি।
- সত্যি! বাবা কি বলেছেন?
- বলেছেন যে মোবাইল ফোন কিনে দেয়া সম্ভব নয়!
- কেন সম্ভব নয়?
- তোকে এতো কথা বলার সময় আমার নেই! স্কুলের দেরী হচ্ছে, তাড়াতাড়ি যা!
নীলের চোখে জল; সে হাঁটছে আর কাঁদছে। যদিও মোবাইল ফোন না পাবার বেদনায় তার হৃদয়ে রক্তের ঝরনা বইছে; আশেপাশের মানুষরা কান্নারত নীলকে দেখলে লজ্জায় তার কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু সে কোনোমতে নিজের তীব্র কান্নার স্রোত আটকাতে শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।
নীলের স্কুল তার বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু আজ এই সামান্য দূরত্বটাও যেন অনেক বেশী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সে অনন্তকাল ধরে হাঁটছে! বিমর্ষ মুখটা দেখতে বর্ষার আকাশের মত দেখাচ্ছে।
স্কুল শেষে বাসায় ফেরার পথে নীলের এক বন্ধু শাহিন তাকে বলে,
- কি রে, আজ তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
- কেমন দেখাচ্ছে?
- মনে হচ্ছে যেন তোর বউ মারা গেছে, হে হে হে!
- ফাজলামো রাখতো!
- সত্যি বলছি দোস্ত! একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখিস, তাহলেই বুঝতে পারবি, হে হে হে!
- আসলে মনটা বেশ খারাপ রে!
- কেন, কি হয়েছে?
- কিছু না।
- আমাকে বল কি হয়েছে?
- বলেছিতো কিছু হয়নি!
- আচ্ছা, থাক। বলার দরকার নেই। আমার সাথে এক জায়গায় চল, সেখানে গেলেই তোর মন ভালো হয়ে যাবে।
- কোথায়?
- তা বলা যাবে না। গেলেই দেখতে পাবি! যাবি নাকি?
- এখন গেলে যে বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে! মা বকবেন।
- দেরী হবে না। যাবো আর আসবো।
- সত্যি বলছিসতো?
- হে রে বাবা! সত্যি বলছি। চল।
- চল তাহলে।
শাহিন নীলকে অদূরের একটি স্যাঁতস্যাঁতে জলাভূমিতে নিয়ে যায়। সেই স্থানটি নীলের পূর্ব পরিচিত। জলাভূমি দেখে নীল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
- তুই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন?
- কেন, তোর মন ভালো হয়নি?
- মন ভালো হওয়া দূরে থাক, উল্টো মনটা আরও বেশী খারাপ হয়ে গেছে!
- দোস্ত, গতকাল আমি ঐ কোণায় কয়লার মতন মিশমিশে কালো একটি পানকৌড়িকে দেখেছি!
- পানকৌড়িতো আমিও বেশ কয়েকবার দেখেছি! এতে নতুন কি?
- আমি গাছের আড়াল থেকে অনেকক্ষণ ধরে জেমস বন্ডের মতন ঐ পানকৌড়ির চলাফেরা লক্ষ করে বুঝতে পেরেছি যে ঐ ঝোপের মধ্যেই তার বাসা আছে।
- তুই এতোটা নিশ্চিত হয়ে বলছিস কি করে?
- বললামতো, আমি একশো, থুক্কু, একশো বিশ ভাগ নিশ্চিত!
- তাহলে তোর প্ল্যানটা কি?
- এখন আমার প্ল্যান হচ্ছে আমরা দুজনে চোরের মতন অতি সাবধানে সেই ঝোপের কাছে যাবো।
- সেখানে গিয়ে কি হবে?
- গিয়ে ঐ পানকৌড়িটাকে ধড়ার চেষ্টা করবো।
- অ্যা, পানকৌড়ি তোমার জন্য বসে আছে! “শাহিন, আসো, আমাকে ধরো!” বেকুব কোথাকার! তুই থাক, আমি বাসায় যাচ্ছি।
- আরে বন্ধু, দাঁড়া! বিশ্বাস কর, যদি পানকৌড়ি সেখানে নাও থাকে, তার বাচ্চা কিংবা ডিম কোনও না কোনও কিছু নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
- তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস।
- তাহলে চল আর দেরী না করে এগিয়ে যাই!
- হ্যাঁ, তাই চল!
সন্তর্পণে নীল এবং শাহিন সেই ঝোপের দিকে অগ্রসর হয়। পা ফেলার আওয়াজ যাতে খুব কম হয় সেদিকেই দুজনের সতর্ক দৃষ্টি। ঝোপ থেকে সামান্য দূরে থাকতেই একটা অঘটন ঘটে যায়! একটা বিষাক্ত সাপের গায়ে বেখেয়ালে শাহিনের ডান পা গিয়ে পড়তে না পড়তেই সাপটি আলোর গতিতে তার পায়ে বিষদাঁত বসিয়ে মুহূর্তেই ভূতের মতন ঝোপের মাঝে মিলিয়ে যায়!
সাংঘাতিক আতংকে এবং তীব্র কষ্টে শাহিন মৃতপ্রায় ব্যক্তির মতন গোঙাতে থাকে। নীল নিজেও তার বন্ধুকে এভাবে চোখের সামনে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে বেহুঁশ হয়ে যাবার মতন অবস্থা! সে যে ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আশেপাশে কোনও মানুষকেই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তার মনে হয় যদি একটা মোবাইল ফোন থাকতো, তাহলে এখনি সে তার বাবাকে কিংবা শাহিনের আত্মীয় স্বজনদেরকে এই দুর্ঘটনার কথা জানাতে পারতো। ফোন পেয়ে নিশ্চয়ই তারা ঝড়ের মতন ছুটে আসতেন এবং শাহিনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন।
এসব ভাবতে ভাবতেই নীল প্রায় মূর্ছা যাওয়া শাহিনের কাছে জানতে চায় যে তার পকেটে মোবাইল আছে কি না। তীব্র যন্ত্রণায় কাঁতর শাহিনের মুখ ফুটে একটি শব্দও বের হয় না। তবে সে তার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। নীল সাথে সাথে তার পকেট থেকে ফোন নিয়ে শাহিনের বাবাকে কল করে। তার নিজস্ব গাড়ি থাকায় কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে চলে আসেন এবং শাহিনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
শাহিন বেঁচে যায়; ডাক্তার তার বাবাকে বলেছেন যে আর একটু দেরী হলেই শাহিনকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। শাহিন এবং তার পরিবার নীলের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ। নীল বাসায় ফিরে তার মা বাবাকে পুরো ঘটনাটি জানানোর পর কেন জানি রাহাত সাহেবের মনে হয় যে নীলকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেয়া দরকার। কারণ শাহিনের সাথে মোবাইল ছিল বলেই বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। বলাতো যায় না যে নীলও কখনও এমনভাবে কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে সে তার ফোন ব্যবহার করে সহজেই রক্ষা পেতে পারবে।
এসব কথা বিবেচনা করে ঐদিনই সন্ধ্যাবেলা রাহাত সাহেব একটি সুদৃশ্য মোবাইল ফোন কিনে বাসায় ফিরেন। নীল তখন পড়ছিল। তার বাবা পেছন থেকে এসে মুচকি হেসে তাকে বলে,
- নীল, এটা তোমার জন্য!
- এটা কি বাবা!
- প্যাকেটটা খুলেই দেখো কি আছে?
ইতোমধ্যে সিতারাও সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। নীল দ্রুত সেই প্যাকেট খুলে দেখে সেখানে একটি চমৎকার মোবাইল ফোন! আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে নীল তার বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “থ্যাংক ইউ সো মাচ বাবা!”