ব্যাংক এবং বিভিন্ন পরিচিত মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অনেক কষ্টে দোতলা বাড়িটির কাজ সম্পন্ন করার পর দীপ রহমান সেটির দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় পুলক অনুভব করেন। কামার যেমন মাটির কোনও নান্দনিক বস্তু তৈরির পর সেটির দিকে অপলক চেয়ে থাকে, ঠিক তেমনি দীপেরও পলক পড়ে না।
বলাই বাহুল্য যে তার স্ত্রী জ্যোতি এবং মেয়ে আফসানাও যারপরনাই খুশী! এতদিন ভাড়া বাসায় থাকতে হতো বলে তাদেরকে অনেক কষ্ট পোহাতে হত। মাসে মাসে ভাড়া দেবার ঝামেলা, ঘরে একটু আওয়াজ হলেই বাড়িওয়ালার নোটিশ, কটু কথা শোনানো ইত্যাদি আর ভালো লাগছিল না। শেষ পর্যন্ত সবার সম্মতি নিয়ে বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে বলে নতুন ঘরে সাজ সাজ রব! ইতোমধ্যেই আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন বিয়ে বাড়ি!
অনেক রাত পর্যন্ত অতিথিদের আনাগোনা চলে। সবার সুষ্ঠু আপ্যায়নের দিকে দীপ এবং জ্যোতির বাড়তি সতর্কতা রয়েছে। প্রত্যেক অতিথির মুখেই তাদের জন্য প্রশংসার খই ফুটছে। এতো কম খরচে এমন নান্দনিক বাড়ি নির্মাণ করতে পারার ভূয়সী প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ।
ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে থাকে; একে একে মেহমানরাও বিদায় হতে থাকে। অত্যন্ত ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত দেহে দীপ, জ্যোতি এবং আফসানা ঘুমাতে যায়। সারাদিনের ক্লান্তির ফলে বিছানায় গা এলিয়ে দেবার সাথে সাথেই চোখে প্রশান্তির ঘুম নামে।
রাত আনুমানিক তিনটা পনেরোর দিকে এক প্রলয়ঙ্করী কাঁপুনির ফলে জ্যোতির ঘুম ভেঙে যায়। সে দীপকে জাগিয়ে বলে,
- দীপ, কি হচ্ছে? সবকিছু এভাবে কাঁপছে কেন?
- আমার মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে! আর দেরী না করে চলো আফসানাকে নিয়ে ঘরের বাইরে খোলা স্থানে চলে যাই। যে অবস্থা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে যে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িটি গাছের ডালের মতন ভেঙে পড়বে!
- হ্যাঁ, চলো বাইরে চলে যাই!
ইতোমধ্যে দীপ, জ্যোতি এবং আফসানা আতঙ্কিত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত ঘরের বাইরে চলে আসে। এমন ভয়ানক ভূমিকম্প এর আগে কখনও বাংলাদেশে হয়েছে কিনা সন্দেহ! চারিদিকে ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার এবং গগনবিদারী চিৎকার। প্রায় সবার মুখেই সৃষ্টিকর্তার নাম ফিরে ফিরে আসে। সকলের মনেই বাঁচার আকুতি, শান্তি, স্বস্তি এবং নিরাপত্তার ক্ষুধা।
যাইহোক, দীপ, জ্যোতি এবং আফসানার চোখের সামনেই নবনির্মিত বাড়িটি চোখের পলকে ভূমিতে মিশে যায়! অনেক স্বপ্ন, ভালোবাসা, অর্থ, পরিশ্রম, সাধনা ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত রূপকথার মত বাড়িটি এভাবে বিলীন হয়ে যাবে এমনটা কি কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারে? যেন কেউ কালো জাদুর মাধ্যমে মুহূর্তেই বাড়িটিকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে!
সেই ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে দীপ, জ্যোতি এবং আফসানা মনে মনে আবারও নতুন করে শুরু করার পণ করে। কারণ তারা বেশ ভালো করেই জানে যে টিকে থাকতে হলে চেষ্টা করতেই হবে। সূচনা হয়তো কঠিন, তবুও শুরু করাটা জরুরী। বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার মধ্যেই মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সার্থকতা!