টোকাই [Bangla Story]

        হৃদয় নামের টোকাই ছেলেটার হৃদয় কিন্তু আকাশের মতন বিশাল এবং সাগরের মতন গভীর। তার বয়স মাত্র দশ বছর। এ বয়সেই তার চিন্তা চেতনা এতোটাই অসাধারণ এবং পরিপক্ক যে তা রীতিমত বয়স্ক কাউকেও অপ্রস্তুত করে দিতে বাধ্য!

 

        হৃদয় কখনও কারো অনিষ্ট কামনা করে না; তার মধ্যে হিংসা নামক ব্যাধিও নেই। সবসময় অন্যের ভালোটাই প্রত্যাশা করে। হয়তো তাই ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয়ে একদিন তাকে এক আশ্চর্য উপহার দেন!

 

        হয়েছে এমন যে একদিন হৃদয় স্বভাবতই কাঁধে বস্তা নিয়ে এদিকে ওদিকে কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল ইত্যাদি কুড়ানোর সময় একটা বড় ডাস্টবিনের কাছে এসে উপস্থিত হয়। সে গিয়ে দেখে যে ইতোমধ্যেই আরও অনেক টোকাই সেখান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস সানন্দে কুড়িয়ে নিচ্ছে। তাদের মধ্যে দুয়েকজন হৃদয়ের পরিচিত। আলাল নামের একজনকে হৃদয় জিজ্ঞেস করে,

 

- কি রে আলাল, কেমন আছস?


- এইতো আছি, তোর খবর ক।


- আমার আর খবর? এইতো আগের মতই চলতাছে!


- তাড়াতাড়ি যা লইবার লইয়া ল, দেহস না, টোকাইয়ে জাগাডা ভইরা যাইতাছে?


- হ, তুই ঠিকই কইছস রে! আয় ডাস্টবিনের ভিতরে ঢুইকা দেহি।


- না রে ভাই! যে গন্ধ! বাইরে দাঁড়াইয়াই আমার বমি আইতাছে! ভিতরে যাইবার খায়েস আমার নাই! তোর দরকার থাকলে যা।


- আইচ্ছা, তুই বাইরে থাক, আমি ভিতরে যামু আর আমু, তারপর একলগে বাসার দিগে যামু, ঠিক আছে?


- ঠিক আছে।

 

        হৃদয় সেই নোংরা ডাস্টবিনের ভেতরে প্রবেশ করে তার হাতে থাকা ছোট্ট লাঠি দিয়ে আবর্জনা এদিক ওদিক নেড়ে টুকটাক যা পাচ্ছে তাই নিয়ে ব্যাগে ভরছে। ভেতরে দুর্গন্ধ এতোই বেশী যে তার দম বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। যেন সে একটি নোংরা ড্রেনে পড়ে গিয়েছে এবং নিঃশ্বাস নিতে পারছে না!

 

যাইহোক, ফিরে আসার পথে হঠাৎ একটি চকচকে জিনিসের উপর হৃদয়ের দৃষ্টি পড়ে। সে সেটিকে আমলে না নিয়ে বাইরে এসে কেন জানি আবারও সেটি দেখতে ভেতরে প্রবেশ করে। হলুদাভ চকচকে জিনিসটি পকেটে ভরে বাইরে বেরিয়ে আসে।

 

বাসার প্রায় কাছাকাছি এসে হৃদয় আলালকে ঐ উজ্জ্বল জিনিসটি দেখায়। আলাল অবাক দৃষ্টিতে সেটা হাতে নিয়ে দেখে বলে,

 

- দোস্ত! এইডা তুই কই পাইলি?


- ঐ ডাস্টবিনের ভিতরে!


- এইডা তো স্বর্ণের মতন ঝিলিক মারতাছে! স্বর্ণ না তো?


- ধুর! কি আবোলতাবোল বকতাছস? স্বর্ণ অইবো কেমনে? কেউ কি স্বর্ণ ডাস্টবিনে ফালাইয়া দেয়নি? বেকুব কোনহানের!


- অনেকের স্বর্ণের জিনিস হারাইয়া ডাস্টবিনে আইতে পারে না?


- তা পারে, তয় আমার মনে অয় এইডা ইমিটিশন!


- কি 'শন'?


- ইমিটিশন, মানে সোনার লাহান লাগে, আসলে সোনা না!


- ও! আইজকাল কত কিছু যে বাইর অইছে দোস্ত!


- বাসা আইয়া পড়ছে; যাই রে, পরে দেহা অইবো।


- হ, আমিও যাই, ভালা থাকিস।

 

        হৃদয় সেই ব্যাগটি উঠানের এক কোণায় রাখে; চকচকে জিনিসটি তার স্কুলের ব্যাগের ভিতরে রেখে অনতিদূরে থাকা পুকুরে গিয়ে লাফ দেয়; সে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে। গোসল শেষে বাসায় ফিরে পেটভরে ভাত খেয়ে হৃদয় সেই স্বর্ণের মতন দেখতে বস্তুটি তার মা ফাতেমাকে দেখায়। ফাতেমা সেটি দেখে বলে,

 

- এইডা তুই কই পাইছস?


- আইজকে একটা ডাস্টবিনে বোতল টোকাইতে গিয়া পাইছি মা!


- হাছা কইতাছসতো? নাকি চুরি কইরা আনছস? হাছা কথা ক, নাইলে কিন্তু তোর বাপ তোরে মাইরা তক্তা বানাইয়া লাইবো!


- না মা, হাছা কইতাছি! তোমার কসম! বিদ্যা কইতাছি!


- খোদার কসম ক!


- খোদার কসম! হের পরেও বিশ্বাস না অইলে আলালরে জিগাইও! হে ও আমার লগে আছিলো!


- আইচ্ছা ঠিক আছে। এইডা আমার কাছেই থাক।


- আইচ্ছা মা।

 

        সন্ধ্যার পর ফাতেমার স্বামী মতিন ঘরে ফিরলে ফাতেমা তাকে ঐ উজ্জ্বল স্বর্ণের মতন দেখতে বস্তুটি দেখায় এবং হৃদয় সেটি কিভাবে, কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছে তার বর্ণনা দেয়। মতিনের কেন জানি মনে হয় যে এটি স্বর্ণের একটি বড় টুকরা! ফাতেমারও এমনটাই ধারণা। মতিন তৎক্ষণাৎ কোনও স্বর্ণকারকে দেখাতে চাইলে ফাতেমাও সায় দেয়।

 

        মতিন হাটের দিকে রওনা হয়; সেখানে বেশ কয়েকটি স্বর্ণের দোকান আছে। একজন স্বর্ণকার খুব নিবিড়ভাবে পরখ করে দেখার পর মন্তব্য করেন যে,

 

- মতিন মিয়া, এটি খাঁটি সোনা! এমন সোনা আজকাল খুব একটা পাওয়া যায় না! তুমি কি এটা পরীক্ষা করার জন্য এনেছো নাকি বিক্রি করার জন্য?


- জে, আসলে আমি এইডা বিক্রির লাইজ্ঞা আনছিলাম, অভাবে সংসারের চাক্কা চলে না! হেইল্লাইজ্ঞা এইডা বেইচা যদি কিছু টেহা মিলে তাইলে খুব উপকার অইতো; মতিন খুব চতুরতার সাথে প্রসঙ্গ পাল্টে দেয় কারণ সে ভালো করেই জানে যে যদি পরখ করে দেখার জন্যই সে টুকরাটি এনেছে এটি বললেই স্বর্ণকারের মনে সন্দেহ প্রবেশ করতো; তিনি মনে মনে মতিনকে চোর বলে ভাবতেন হয়তোবা।


- এটা বিক্রি করে তুমি দশ হাজার টাকা পাবে!


- দশ হাজার! মতিন মনে মনে খুশী হয় কিন্তু তা প্রকাশ করে না।


- কি, বিক্রি করবে?


- না স্যার! এতো কমে আমি এইডা বেচুম না! মতিনের লোভ বেড়ে যায়। সে জানে যে এই স্বর্ণের টুকরার দাম আরও বেশী হব। কেন জানি তার মনে হয় যে স্বর্ণকার তাকে ঠকাতে চাইছে!


- আচ্ছা যাও, তোমাকে আরও পাঁচ হাজার টাকা দেবো। মোট পনেরো হাজার, এখন খুশীতো? এই দামের বেশী কিন্তু কেউ তোমাকে দেবে না!


- আইজ বেচুম না স্যার। আমি আরেকটু যাচাই কইরা দেহি, তারপরে দেহা যাইবো।


- ঠিক আছে, যেমন তোমার ইচ্ছা। তবে এই দামে হলে কিন্তু অন্য কাউকে দিও না, আমার কাছেই বিক্রি করবে, ঠিক আছে?


- ঠিক আছে স্যার।

 

        মতিন স্বর্ণের টুকরাটিকে তার কাঁধে থাকা লাল গামছায় বেধে কোমরে বেল্টের মতন পেঁচিয়ে রাখে। তার মুখে আনন্দের হাসি; তার খুশী শেষ হয় না। সে বাড়ির দিকে এক পা এক পা করে হেঁটে যায়, তার সাথে সাথে যেন গাঁয়ের ভরা নদীটিও যাচ্ছে! নদীর বুকে ঢেউয়ের নাচন, অন্যদিকে মতিনের বুকে সুখের নাচন!

 

        মতিন বাড়ি ফিরে ফাতেমাকে উঠানে পেয়ে তার দুহাত ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে। ফাতেমা তার স্বামীর এমন অদ্ভুত আচরণের কোনও কূলকিনারা করতে না পারলেও তার সুখে সেও সুখী হয়। ফাতেমাও মতিনের সুখের অংশীদার হয়; অভাবের সংসারে দুঃখই যেখানে ছায়ার মতন নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকে, সেখানে হাসির সামান্য ছটাও স্বর্গীয় সুখের মতই মনে হয়! 

 

মতিন যখন বলে যে হৃদয়ের কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসটি খাঁটী স্বর্ণ, তখন খুশীতে ফাতেমা প্রায় মূর্ছা যায় যায় অবস্থা! স্বাভাবিকভাবেই হৃদয়ও জানতে পারে যে নিজের অজান্তেই সে একটি অতি মূল্যবান বস্তু খুঁজে পেয়েছে। সেও খুব উল্লসিত; তবে হৃদয় সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছে যখন তার বাবা হাসতে হাসতে তাকে কোলে তুলে দুই তিনবার আকাশের দিকে ছুঁড়ে আবার কোলে নিয়েছে! তখন তার মনে হয়েছে যে সে কোনও একজন যুদ্ধজয়ী বীর!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: