গুলিবিদ্ধ বিবেক! [Bangla Story]

       ফয়সাল হাবিব এবং ইরিন আমিনের বিয়ের কয়েকমাস যেতে না যেতেই ফয়সালের মধ্যে বসবাসরত বন্য ফয়সালকে আবিস্কার করতে ইরিনের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মাতলামি করে অনেক রাতে ঘরে ফেরা, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, বস্তির লোকের মতন গালিগালাজ করা ইত্যাদি প্রতিদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছে।

 

        অনেক কষ্ট হলেও ইরিন তার পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু যতদিন গড়িয়ে যায়, ফয়সাল আরও বেশী দৈত্যের মতন আচরণ করতে থাকে। ইরিনের মাঝে মাঝে মনে হয় যে আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেই স্বর্গীয় শান্তি মিলবে!

 

        ইতোমধ্যে ইরিনের কোল আলো করে একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। মেয়েটি যেন সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদস্বরূপ। ঠিক এমন সময় তার জন্ম হয়েছে, যখন ইরিনের কাছে জীবন এক ভয়ানক বিষের মতই মনে হতে শুরু করেছে।

 

মেয়েটির নাম রাখা হয়েছে জয়তু। এখন ইরিনের সমস্ত মায়া মমতা চাঁদের আলোর মতই আদরের মেয়ের উপর গিয়ে পড়েছে। ফয়সাল এখনও আগের মতই বাজে আচরণ করলেও ইরিন জয়তুর মায়াবী মুখের পানে তাকিয়ে নিজের দুঃখ কষ্ট সব ভুলে যায়।

 

দেখতে দেখতে জয়তু বড় হয়ে উঠে। সে এখন কলেজে পড়ে। ফয়সালের বয়স বাড়লেও বিচক্ষণতা মোটেও বাড়েনি। স্ত্রীকে প্রহার করার পাশাপাশি জয়তুর গায়েও সে হাত তুলে। যখনই ক্রন্দনরত মায়ের কাছে সমবেদনা জানাতে যায় এবং বাবাকে এমন অন্যায় আচরণ থামাতে বলে, তখনই ফয়সাল সাপের মতন ফোঁস করে উঠে জয়তুর গালে ঠাস করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয়। এসবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

 

ঘর আর ঘর নেই, রীতিমত নরকে পরিণত হয়েছে। একদিন জয়তু একটি ফোনের জন্য তার বাবাকে বলে,

 

- বাবা, আমার একটা ফোন দরকার।


- কেন, ফোনের কি এতো দরকার শুনি?


- এই যে আমি কলেজে যাই আসি, পথে বিপদ আপদ হলে আমি ফোন করে বাসায় জানাতে পারবো। তাছাড়া আমার পড়ালেখার প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বান্ধবীদেরকে ফোন দিতে পারবো; তারাও আমাকে ফোন করতে পারবে।


- না, তোমাকে ফোন কিনে দেয়া যাবে না।


- কিন্তু কেন বাবা?


- তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছো নাকি? আমি সব বুঝি! তুমি ফোনে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে কথা বলবে, প্রেম করবে, ফষ্টিনষ্টি করবে- এসবের সুযোগ আমি কখনই দেবো না! ফোন কিনে দিলে তোমার পড়ালেখায় উন্নতির চেয়ে অবনতিই হবে কারণ আজকাল ফেইসবুকসহ আরও কত কি এসেছে, এসবে ব্যস্ত থাকবে আর নিজের পড়াশোনার বারোটা বাজাবে, এসব আমি কখনই বরদাশত করবো না বলে দিচ্ছি!


- বাবা প্লিজ! তুমি যা ভাবছো আমি তেমন কিছুই করবো না!


- না মানে না। আমাকে আর কখনও এ বিষয়ে অনুরোধ করবে না।

 

        জয়তু আর উপায়ান্তর না দেখে কাঁদো কাঁদো গলায় তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

 

- দেখো না মা! বাবাকে সামান্য একটা মোবাইলের জন্য অনুরোধ করেছি। তিনি সেটি নাকি কিনে দিতে পারবে না। তার উপর আমাকে কত কিছু শুনিয়ে দিয়েছে। আচ্ছা মা, বাবার মনে এতো সন্দেহ কেন?


- কি আর বলবো মা? তোর বাবার স্বভাব সম্পর্কেতো তুই সবই জানিস! এবার বুঝ, আমি কিভাবে দিনের পর দিন এমন একটা মানুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আছি?

 

        একদিন কলেজ থেকে ফেরার পর জয়তু তার নিজের কক্ষে গিয়ে খাটের উপর একটি মোবাইল ফোনের বাক্স দেখে অবাক হয়ে যায়। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে,

 

- মা! খাটের উপর রাখা এই ফোনটি কার?


- এটা তোর ফোন!


- আমার ফোন মানে?


- হ্যাঁ, তোর জন্য কিনেছি!


- সত্যি মা!


- হ্যাঁ রে বাবা, সত্যি!


- ওয়াও মা! থ্যাংক ইউ সো মাচ!


- আচ্ছা শোন, তোর বাবা যাতে ভুলেও জানতে না পারে যে তোর কাছে ফোন আছে! যদি জানতে পারেন, তাহলে এর পরিণতি কি হবে তা তুই ভালো করেই বুঝতে পারছিস!


- হ্যাঁ মা, বুঝেছি। আমি এটা লুকিয়ে লুকিয়েই ব্যবহার করবো।


- হ্যাঁ, তাই ভালো। খুব সাবধানে ব্যবহার করিস কিন্তু।


- ঠিক আছে আমার লক্ষ্মী মা!

 

        সেই থেকে জয়তু ফোনে তার বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ফোনে যোগাযোগ শুরু করে দেয়। কিন্তু একদিন তার বাবা সেই মোবাইলটি দেখে ফেলে। তারপর পারমাণবিক বোমার মতই রাগ বিস্ফোরিত হয়। জয়তুকে ডেকে অকথ্য ভাষায় গালি আর মুহুর্মুহু চড় দিতে থাকে। যখন ইরিন জয়তুকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে তখন ফয়সাল তাকেও প্রহার করতে থাকে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ চোর ধরে গণপিটুনি দিচ্ছে! ফয়সাল যখন জানতে পারে যে ইরিনই ফোনটি কিনে দিয়েছে, তখন তার উপর আরও বেশী করে হাত তুলে নিজের লেলিহান ক্রোধ মেটাতে থাকে।

 

        রাতে জয়তু তার মাকে বলে,

 

- মা, এমন পশুর সাথে তুমি এতো বছর ধরে একই ছাদের নিচে আছো কি করে?


- ঠিকই বলেছিস মা, সে একটা নরপশু! মানুষের কোনও গুণ তার মধ্যে নেই!


- তাকে বাবা ডাকতেও আমার ঘৃণা হয় মা! তার চেহারা দেখতেও ইচ্ছে হয় না!


- কি আর করার আছে বল? আমিতো কোনও সমাধান দেখি না! এসব থেকে কবে যে মুক্তি পাবো?


- তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মুক্তি নেই মা! এসব চলতেই থাকবে! কোথাও দুর্ঘটনায় পড়ে মরে না কেন? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে খুন করে ফেলি! 

 

        সাতদিন পর পুলিশ এসে ইরিনকে খবর দেয় যে একটি ড্রেনে ফয়সালের লাশ পাওয়া গেছে। স্বামীর মৃত্যুর কথা শুনে ইরিনের মনে একটুও কান্নার উদ্রেক হয় না! তার মনেই হয় না যে আপন কেউ মারা গেছে! জয়তুর অবস্থাও ঠিক একই রকম! পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। তবে কেন জানি পুলিশের সন্দেহের তালিকায় মা ও মেয়ে নামই একেবারে উপরের দিকে আছে!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: