শামীম সিলেটের মধুশহীদ এলাকায় একটি বাসায় কাজ করে। গ্রামে ছোট বোন রাহেলার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ফোনে তার মা লাইজু বানু এ কথা জানাতেই খুশীতে মনটা ভরে যায়। কিন্তু সেই আনন্দ কুয়াশার মতন অল্পক্ষণ স্থায়ী হয় কারণ রাহেলার বিয়ের খরচ সামলানোর সাধ্য তার মায়ের নেই। রাহেলার স্বামী আজম খান দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর থেকে শামীমকেই সংসারের হাল ধরতে হয়।
যাইহোক, এমনিতেই শামীম নানামুখী চাপে থাকে, এখন রাহেলার আসন্ন বিয়ের কথা জেনে তার চাপ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। স্বভাবতই বিয়েতে প্রচুর খরচ আছে। শামীম মাস শেষে যেটুকু টাকা পায় তাতে কোনওমতে গ্রামের বাড়ির খরচ মিটে যায়।
ইতোমধ্যে লাইজু এর ওর কাছ থেকে সাহায্য এবং ধার নেয়া শুরু করেছে। কোনওমতে মেয়েকে অন্যের ঘরে বুঝিয়ে দিতে পারলেই যেন তার মনে শান্তি আসবে! যাইহোক, শামীম অনেক চিন্তা করে স্থির করে যে সে যে বাসায় কাজ করে সেই ঘরের কর্ত্রীর কাছে বিশ হাজার টাকার মতন ধার চাইবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ। শামীম অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে বাড়িওয়ালার স্ত্রী সাদিয়া আক্তারকে অনুরোধ করে বলে,
- ম্যাডাম! একটু কথা আছে।
- কি কথা?
- আগামী মাসে আমার ছোট বোন রাহেলার বিয়ে।
- এ তো সুখবর রে!
- জি ম্যাডাম!
- তোর ছুটি দরকার, গ্রামে যাবি তাইতো? টেনশন করিস না, কতদিন ছুটি লাগবে বল?
- জি না ম্যাডাম! আমি ছুটি চাইবার জন্য আপনার কাছে আসিনি!
- তাহলে কিসের জন্য এসেছিস?
- মানে বলছিলাম কি আপনি যদি দয়া করে আমাকে বিশ হাজার টাকা ধার দিতেন তবে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আপনিতো জানেন ম্যাডাম, বিয়েতে কত রকম খরচ আছে। আমরা গরীব মানুষ, বাবা মৃত, এমতাবস্থায় আমাকেই পরিবারের হাল ধরতে হচ্ছে।
- সবই বুঝি শামীম, তবে আমি তোকে এই মুহূর্তে এতো টাকা দিতে পারবো না!
- প্লিজ ম্যাডাম! আপনি অনুগ্রহ করে টাকাটা দিন! প্রয়োজনে আমার মাসের টাকা থেকে একটু একটু করে কেটে নেবেন! আল্লাহ্র দয়ায় আপনাদের অনেক আছে, আমাকে একটু সাহায্য করুন, আমি আপনার জন্য আল্লাহ্র কাছে মন থেকে দোয়া করবো।
- বললাম তো, আমি তোকে টাকা দিতে পারবো না! কেন বারবার একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিস?
সাদিয়া এবং শামীমের মধ্যে কথোপকথন চলাকালীন সময়ে গৃহকর্তা আফজাল মসজিদে নামাজ পড়ে বাসায় আসেন। মালিককে দেখে শামীম তাকেও একই অনুরোধ করলেও কোনও লাভ হয় না। উল্টো আফজাল শামীমকে না পুষলে কাজ ছেড়ে দিতে বলেন। শহরে নাকি কাজের লোক কাকের মতন ঘুরছে! চাইলেই আরেকজন জুটে যাবে!
আফজালের বলা শেষ তিক্ত কথাটি শুনে শামীমের মনে হয় কেউ যেন ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছের মতন তার বুকের ভেতর থেকে হৃদয়টি টেনে বের করে এনেছে! সে মনে মনে অভিশাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে মনের তীব্র কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আফজালকে বলেই ফেলে,
- আমি আর আপনাদের এখানে কাজ করবো না!
- দুই টাকার কাজের লোকের দেমাগ দেখো! কাজ না করলে নাই!
- এই বাসায় এতো বছর ধরে কাজ করার পরও আপনাদের কাছ থেকে বিপদে একটু সাহায্য পর্যন্ত পাচ্ছি না! আসলে আপনাদের মনে দয়া মায়া বলতে কিছুই নেই!
- তুই আমাদেরকে জ্ঞান দিচ্ছিস নাকি! বেশী কথা না বলে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে বিদায় হ! তোদের মতন ছোটলোককে আমার চেনা আছে। তোরা বসতে দিলে শুতে চাস! ব্যাটা পাজি কোথাকার!
- দেখুন, আমি গরীব হলেও মানুষ! আমারও আত্মসম্মান বোধ আছে! আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না!
- চুপ ব্যাটা ফাজিল! আর একটা কথা বললে তোকে আমি গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করবো!
- উপরে আল্লাহ্ সবই দেখছেন! একদিন না একদিন আপনারা এই অবিচারের ফল পাবেন!
শেষ কথাটি বলে শামীম তার ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাবার সময় সাদিয়া তাকে এই মাসে যতদিন কাজ করেছে সেই টাকা বুঝিয়ে দেন। অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে শামীম ঘরের বাইরে পা রাখে।
দুই মাস পর আফজালের ঘরে চুরি হয়। গভীর রাতে চোর মূল্যবান জিনিস নিয়ে পালাবার সময় সাদিয়া দেখে ফেলায় ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে। সাদিয়ার নিথর দেহ পাথরের টুকরোর মতন ডাইনিং টেবিলে রাখা চেয়ারের উপর পড়তেই প্রচণ্ড শব্দ হয়। সেই আওয়াজে আফজালের ঘুম ভেঙে যায়। ইতোমধ্যে চোর পালিয়েছে। আফজাল এসে দেখেন যে সাদিয়ার রক্তাক্ত দেহ মরা হরিণের মতন মেঝেতে পড়ে আছে। তিনি আশেপাশে কেউ আছে কিনা তা দেখেন। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি থানায় ফোন করেন।
পুলিশ এসে সবকিছু দেখেশুনে আফজালকে জিজ্ঞেস করেন,
- আপনার ঘর থেকে চোর কি কি মূল্যবান জিনিস নিয়েছে?
- স্বর্ণালংকার এবং দুই লাখ ক্যাশ টাকা।
- দেখেতো মনে হচ্ছে চুরি করাই উদ্দেশেই এসেছে। মনে হয় না যে খুন করাই উদ্দেশ্য ছিল। আপনার কি কোনও শত্রু আছে যে এরকম ভয়ানক কাণ্ড ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
- না, আমার কারো সাথে কোনও প্রকার শত্রুতা নেই!
- কারো সাথে কি ইদানীং কোনও ঝগড়া হয়েছে?
- না, তেমন কিছু তো ঠিক মনে পড়ছে না!
- একটু মনে করার চেষ্টা করুন প্লিজ, কারণ আপনার দেয়া তথ্যগুলো থেকে আমরা এই খুনের মামলাটির সুরাহা করতে পারবো।
- ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে, দুইমাস আগে আমাদের বাসায় একটি কাজের ছেলে ছিল যার নাম শামীম। একদিন তাকে অনেক বকা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলাম।
- সে কি এমন করেছিলো যে তাকে বাসা থেকে বের করে দিলেন?
- সে তার ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষে বিশ হাজার টাকা ধার চেয়েছিলো, আমার প্রয়াত স্ত্রী এবং আমি সেই টাকা দিতে অপারগতা জানালে সে বেয়াদবের মতন আচরণ করা শুরু করেছিলো; আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো বলে তাকে বিদায় করে দিলাম।
- আপনার কি মনে হয় যে শামীম টাকার জন্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে?
- ঘটাতেও পারে কারণ তার টাকার দরকার ছিলো। তাছাড়া ঘর ছেড়ে যাবার সময় তার মনোভাব বেশ প্রতিহিংসামূলক ছিলো।
- এখন সে কোথায় আছে জানেন?
- জি না, আমার জানা নেই।
- তার ফোন নাম্বার আছে?
- না, সে কাজ ছেড়ে দেবার পর থেকে তার নাম্বার ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়েছিলাম।
- তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাতো মনে আছে?
- তা মনে আছে। জকিগঞ্জে তার বাড়ি।
- আপনি দয়া করে একটি কাগজে তার পূর্ণ ঠিকানা লিখে দিন।
- জি, এখনই দিচ্ছি।
- আর আপনি আমাদের উপর আস্থা রাখুন; আমরা অবশ্যই খুনিকে ধরে ফেলবো।
- জি, আমি মনেপ্রাণে চাই যে খুব দ্রুত খুনি ধরা পড়ুক এবং তার ফাঁসি হোক!
যদিও প্রবাদ আছে- অভাবে স্বভাব নষ্ট, তবুও কিছু অর্থপ্রাপ্তির লোভে চুরি এবং প্রাণ নাশের মতন ঘটনা শামীম কখনও ঘটাতে পারে না! সে এমন ছেলেই নয়! যাইহোক, পুলিশ শামীমের সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়। তাকে জেলে নিয়ে অনেক জেরা করার পরও সে খুনের কথা স্বীকার করে না। এমনকি রিমান্ডে নিয়ে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুকুরের মতন পেটানোর পরও সে সেই খুনের দায় নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে পুলিশের হাতেও কোনও শক্ত প্রমাণ নেই যে তারা শামীমকে খুনি সাব্যস্ত করবে।
শামীমকে জেলে নেয়া হয়েছে শুনে তার বৃদ্ধা মা লাইজু চরকির মতন প্রায় প্রতিদিন থানায় চক্কর দিতে থাকে। এমনকি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অনেক অনুরোধ করার পরও কোনও কাজ হয় না। একপর্যায়ে লাইজু তার পায়ে ধরে শামীমের প্রাণভিক্ষা চাইলেও সেই পুলিশ কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত পাহাড়ের মতই অনড় থাকে। এ যেন নব্য শাইলক!
এদিকে পুলিশ প্রকৃত খুনিকে ধরতে পারছে না বলে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে প্রতিদিন চাপ আসছে। সংবাদ মাধ্যমেও এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অধিনস্ত এক পুলিশ কর্মকর্তার কুপরামর্শে নিরীহ শামীমকেই খুনি সাব্যস্ত করে চার্জশীট দাখিল করা হয়।
অপরাধ না করেও অপরাধী হওয়ার মতন কষ্টের আর কিছু আছে কি না আমাদের জানা নেই! ইতোমধ্যে বৃদ্ধা লাইজু তার আদরের সন্তানের জামিন চেয়েও ব্যর্থ হয়। দিনের পর দিন কোর্টে মামলার শুনানি চলতে থাকে; আজও চলছে! সম্মানিত পাঠকগণ যখন এই হৃদয়বিদারক গল্পটি পড়ছেন, তখন বেচারা শামীম হয়তো জেলের চার দেয়ালে গুমরে কাঁদছে, নতুবা কোর্টে জজ সাহেবের সামনে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করছে!