চোখের পলকে পরিস্কার আকাশ মেঘের কালো চাঁদরে ঢেকে যায়! শুরুতে মেঘের রং হালকা কালচে ধোঁয়ার মত থাকলেও ভারী হতে হতে তা প্রায় কলমের কালির রং ধারণ করে। সাইফুল মিয়া ক্ষেতের আগাছা তোলায় ব্যস্ত। তাকে তার ছেলে জায়েদ সহযোগিতা করছে। আকাশের এমন ভয়ংকর রূপ দেখে সাইফুল জায়েদকে বলে,
- তুই তাড়াতাড়ি ঘরে যা! আসমানের অবস্থা খুব খারাপ! মনে হয় তুফান আইবো!
- না বাজান! আমি তোমারে একলা রাইখা যামু না! গেলে একলগেই যামু!
- আমার কথা শোন, জেদ করিস না! জলদি ঘরে যা!
- না, আমি যামু না!
- যা কইছি না! বেশী তর্ক করলে কিন্তু মাইর খাবি! যা!
অগত্যা জায়েদ ঘরের দিকে রওনা দিতে বাধ্য হয়। সে এক কদম হাঁটে, পিছনে তাকায়, আবার হাঁটে আবার পিছনে তাকায়। সাইফুল তার ছেলের দিকে তাকিয়ে তার হাঁটার ধরণ দেখে মনে মনে হেসে উঠে। তার প্রতি জায়েদের ভালোবাসা এতো বেশী যে সে তাকে একা ফেলে যেতে চায়নি; যদিও তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে তবুও যাওয়ার পথে সে তার বাবার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। এই বিষয়টি সাইফুলের মনে আনন্দের সুবাতাস ছড়িয়ে দেয়।
যাইহোক, কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রচণ্ড বজ্রপাত শুরু হয়। সাথে প্রবল বৃষ্টিপাত। এতো ভয়ংকর বজ্রপাত সাইফুল তার জীবনে দেখেনি! সে মনে মনে ভাবে যে কেয়ামত চলে আসলো নাকি? সে তার কাজ বন্ধ করে জোরে জোরে আল্লাহ্কে ডাকতে ডাকতে ক্ষেতের পাশের বটগাছের নিচে অবস্থান নেয়ার জন্য হাঁটতে থাকে। অকস্মাৎ সাইফুলের চোখের সামনে একটি কারেন্টের খাম্বার উপর এতো জোরে ঠাটা পড়ে যে সেই ঠাটার কানফাটানো শব্দে তার হৃৎপিণ্ড প্রায় থেমে যাবার মতন অবস্থা!
প্রকৃতি নারীর মতই খামখেয়ালী! সে কখনও প্রচণ্ড রাগ করে দূরে ঠেলে দেয়, কখনও আবার পরম ভালোবাসায় কাছেও টেনে নেয়। বলাই বাহুল্য যে প্রকৃতি আজ শিবের মতই ক্রোধান্বিত হয়ে আছে! সাইফুল তার নিজ জীবনের মায়ায় হাঁটার পরিবর্তে দৌড়বিদদের মতন প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে! কিন্তু ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন! একটি ঠাটা সাইফুলের উপর পড়তেই সে পানির উপরে তোলা ইলিশ মাছের মত ধড়ফড় করতে করতে মুহূর্তেই মারা যায়!
প্রায় এক ঘণ্টা প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা চলার পর জায়েদ তার বাবার খোঁজে ক্ষেতে এসে তার মৃত লাশ দেখতে পেয়ে শোকে পাথর হয়ে যায়। একটু আগে আকাশ যেমন অঝোরে কেঁদেছে, তেমনি জায়েদও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গ্রামের লোকজনও মাছির মত এসে লাশের চারদিকে দাঁড়িয়ে হায় হায় করছে। তাদের মধ্যে কেউ একজন বলে, “সাইফুলের অকালমৃত্যুর মাধ্যমে আরও একটি পরিবার ধংস হয়ে গেছে!”