স্কুল পড়ুয়া রাসেল নিজ গ্রাম রতনপুরের কথা শুনলেই খুশীতে টগবগ করে উঠে! গত ঈদে গিয়ে কি যে মজা করেছে তার ইয়ত্তা নেই! কখনও দুষ্টু বাছুরের লেজ ধরে দৌড়েছে, কখনও পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছে, কখনও গাছে থাকা বাসা থেকে ঘুঘু পাখীর ছানা ধরার চেষ্টা করেছে ইত্যাদি।
এসব রাসেল একা একা করেনি; গ্রামে তার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু আছে যার নাম সুমন। সুমন পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মাঝপথেই পড়ালেখার ইতি টানতে বাধ্য হয়। এখন সে তার বাবার কৃষিকাজে সাহায্য করে।
যাইহোক, রাসেল যখনই রতনপুরে যায়, তখনই সুমনকে সাথে নিয়ে দেদারসে চরকির মতন সারা গ্রাম চষে বেড়ায় যেন তার কোনও ব্যাপারে চিন্তা নেই! যেন সে একটি স্বাধীন ঈগল পাখী!
রাসেলের বাবা শফিক রেহমান এবং মা তারানা রেহমান এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে রতনপুরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে খুশীতে রাতে রাসেলের ঘুম আসে না! সে দিনরাত এই নিয়ে ভাবতে থাকে যে গ্রামে গিয়ে কখন কোথায় যাবে, কি কি খাবে, কি কি করবে ইত্যাদি। এককথায় সে মনে মনে একটি বিশাল কার্য তৈরি করে রেখেছে!
রতনপুরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই রাসেল তার বন্ধু সুমনের খোঁজে দক্ষ দৌড়বিদদের মতন এক দৌড়ে চোখের পলকে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়! তার মা তারানা তাকে থামাতে যাবার ফুরসতটুকুও সে দেয়নি!
সুমনকে খুঁজে পেতে রাসেলের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। সে অদূরের ক্ষেতে বাবার সাথে ধান গাছ রোপণে ব্যস্ত ছিলো। ‘সুমন’ বলে ডাকতেই সে রাসেলকে দেখতে পেয়ে খুশীতে হেসে উঠে। অনেক কষ্টে সে তার বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাসেলের কাছে যায়।
যেহেতু সুমনের সর্বাঙ্গে কাঁদা লেগে আছে, তাই সে রাসেলকে নিয়ে সোজা পুকুরের দিকে চলে যায়। সুমন বলে,
- বন্ধু, তোকে দেখে অনেক ভালো লাগছে!
- আমারও অনেক ভালো লাগছে!
- অনেকদিন পর দেখা হয়েছে, তাই না?
- হ্যাঁ, অনেকদিন পর!
- কতো দিন থাকা হবে গ্রামে?
- তা ঠিক জানি না। সাত আট দিন হয়তোবা।
- মাত্র সাত আট দিন!
- হ্যাঁ বন্ধু! কারণ আব্বু আর আম্মুর অফিস আছে। তাছাড়া আমার স্কুলও খুলে যাবে।
- আচ্ছা বন্ধু, তুই একটু বস। আমি পুকুরে লাফ দিয়ে কয়েকটা ডুব দিয়ে আসি। দেখতেইতো পাচ্ছিস সারা শরীরে কতো ময়লা লেগে আছে!
- সমস্যা নেই, আমি এখানে আছি, তুই যা গোসল করে নে।
সুমনের গোসল করা শেষ হলে ঐ ভেজা কাপড়েই সে রাসেলকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হয়। আলোর মতন গতিতে কাপড় পাল্টে দুই বন্ধু দখিণা হাওয়ার মত গ্রামের এখান থেকে ওখানে নেচে বেড়াতে থাকে। ইতোমধ্যে তারা পুকুর ঘাটের পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খেয়েছে। ক্ষুধা তেমন একটা নেই বললেই চলে। রাসেলের ক্ষুধা লাগলেই সুমন কোনও না কোনও ফলের গাছে চড়ে বানরের মত ফল পেড়ে আনে।
দেখতে দেখতে আটদিন চোখের পলকেই কেটে যায়। চলে যাবার দিনটি রাসেলের জন্য সবচেয়ে কষ্টের দিন। তার মন বর্ষার আকাশের কালো মেঘের চেয়েও বেশী কালো হয়ে যায়। একেবারে বোবার মতন হয়ে যায় সে। কারো সাথেই কথা বলতে চায় না। রাসেলের শুধুই মনে হয় যদি আরও কয়েকটি দিন গ্রামে থাকা যেতো! শহরের যান্ত্রিকতা তাকে টানে না; সে গ্রামের সুজলা সুফলা প্রকৃতির বুকে স্বর্গীয় শান্তি খুঁজে পায়। গ্রামে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে প্রকৃতির সাথে কথা বলা, প্রকৃতিকে বুকে ধারণ করার মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেই সুখ এবং স্বস্তি শহরে কোথাও পাওয়া যায় না।
মালপত্র গাড়িতে ওঠানো শেষ হলে একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসে। সুমন নিকটেই একটি বট গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রোবটের মতন দৃষ্টিতে রাসেলের দিকে চেয়ে থাকে। রাসেলও তার পানে তাকিয়ে থাকে।
গাড়ি স্টার্ট নেয়া মাত্রই এতক্ষণ ধরে রাসেলের মনে চেপে রাখা কষ্টের লাভা যেন মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসে! গাড়ি আসতে আসতে সামনে এগোতে থাকে; রাসেল আশেপাশের গাছগুলোর দিকে তাকায়। প্রতিটি গাছ, গাছের পাতা যেন তাকে বলছে, “যেয়ো না!” রাসেল সুমনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে আর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে মা পরম আদরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
রাসেল মনে মনে ভাবে, ‘আবার যে কবে আসবো এই চিরসবুজ গ্রামে?’