যেদিন মা তাহেরা বেগম ঘরে মুরগী রান্না করেন, সেদিন ছেলে আমিন এবং জিহাদ মুরগীর রান খাবার জন্য শিকারি বাঘের মত অপেক্ষায় থাকে। মুরগীর তরকারি টেবিলে আসা মাত্রই দুজনে শকুনের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে মুরগীর রান নিজের প্লেটে নেবার জন্য!
যদিও আমিন এবং জিহাদ তারা ভালো করেই জানে যে মা সবসময় দুটো রানই রান্না করে, তবুও বাটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুরগীর রান খুঁজে নেয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা এই দুই ভাই ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে কিনা সন্দেহ। অবশ্য তাদের এই চেষ্টার পেছনে আরেকটা কারণও আছে আর সেটি হচ্ছে কে কার চেয়ে বড় মুরগীর রানটি পেয়েছে। এখানে ভাইদের মধ্যে একধরণের বাহাদুরি দেখানোর প্রয়াস থাকে। যেদিন বড় ভাই আমিন একটু নাদুসনুদুস দেখতে রান পায়, সেইদিন জিহাদকে একটু পর পর এই বলে রাগাতে থাকে যে,
- কি মজা! আজ আমি মস্ত বড় মুরগীর রান পেয়েছি!
- মুরগীর রান কি দুটো দুরকম হয় নাকি? দুটোইতো সমান!
- কে বলেছে সমান? তোর মুরগীর রানের একদিকে মাংস কম ছিল; তুই দেখিসনি?
- না, আমি অতটা খেয়াল করিনি। আসলে জিহাদ ঠিকই খেয়াল করেছিল তবে বড় ভাইয়ের কাছে স্বীকার করলে তিনি তাকে আরও বেশী চেতাতে শুরু করবেন বলে অস্বীকার করছে।
তাহেরা তার দুই নয়নমণিকে এভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখে না হেসে পারে না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তার দুই ছেলেই মুরগীর রানের জন্য পাগল। তাই তিনি দুটি রানসহ মুরগীর মাংস রান্না করেন সবসময়। একদিন একটু অসচেতনতায় তিনি মাংসের তরকারি রান্নার সময় দুটি রানের বদলে একটি রান রাঁধেন।
যথারীতি খাবার টেবিলে তরকারি পরিবেশন করার পর আমিন এবং জিহাদ মাংসের বাটির দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু বড় ভাই আমিন একটি রান পেয়ে চোখের পলকেই সেটিকে তার প্লেটে নিয়ে নেয়। অন্যদিকে জিহাদ বাটিতে রান খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত!
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রান উদ্ধার করতে না পেরে জিহাদ ‘মা মা’ বলে চেঁচাতে থাকে। রান্নাঘর থেকে বিদ্যুতের বেগে মা এসে বলে,
- কি রে, কি হয়েছে? এভাবে গরুর মত চিৎকার দিচ্ছিস কেন?
- মুরগীর রান একটা রান্না করেছো কেন?
- একটা রান্না করেছি মানে? সবসময়তো দুটোই রান্না করি!
- কিন্তু বাটিতেতো একটাই ছিল আর সেটা ভাইয়া নিয়ে নিয়েছে! আমারটা কোথায়?
- আচ্ছা, দাঁড়া, আমি পাতিলে খুঁজে দেখছি।
তাহেরা পাকঘরে গিয়ে মুরগীর দ্বিতীয় রান খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে আমিন জিহাদের দিকে তাকিয়ে মুরগীর রানে বেশ খায়েশ করে কামড় দেয় এবং ইচ্ছে করেই চোখমুখ বিকৃত করে বলে, “ওহ! আজকে মুরগীর রানটা কি যে মজা হয়েছে!” এমনিতেই জিহাদ রান না পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়েছে, তার উপর ভাইয়া তাকে রাগাচ্ছে। জিহাদ মনে মনে রেগে গণ্ডারের মত হয়ে আছে কিন্তু আমিনকে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না যে সে রেগে আছে!
জিহাদ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও রাগে তার চোখমুখ তরমুজের মত লাল হয়ে আছে। মার দেরী দেখে জিহাদ আবারও চিৎকার দিয়ে ‘মা মা’ বলতে থাকে। তার চেঁচামেচি শুনে আমিন আবারও রাগানোর জন্য হেসে হেসে বলে, “তুমি আজকে মুরগীর রান খেতে পারবে না, আমি খাচ্ছি, তুমি চেয়ে চেয়ে দেখো, কি মজা!” তাহেরা এসে জিহাদের পীঠে এবং মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
- লক্ষ্মী সোনা আমার! আজকে আমার ভুল হয়ে গেছে! আজ ভুল করে একটি মুরগীর রান রেঁধেছি।
- না, না, আমি কিচ্ছু জানি না, ভাইয়া পেয়েছে, আমারও চাই! এতক্ষণ রাগ চেপে রেখেছিল ঠিকই কিন্তু এ কথা বলতে গিয়ে অগ্নিগিরির লাভার মত রাগ এবং কষ্ট মিলে কান্না হয়ে চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে।
- আরে বাবা, বললামতো ভুল হয়ে গেছে! আমার কখনও কি এমন হয়েছে বল?
- আমি এসব শুনবো না! আমাকেও রান এনে দিতে হবে নাহলে আমি ভাত খাবো না!
- প্রয়োজনে তুই আরও কয়েক টুকরা মাংস নিয়ে খা।
- না, এসব বললে কোনও কাজ হবে না।
- কি জেদি ছেলে রে বাবা! এখন আমি তোর জন্য আরেকটি মুরগীর রান কোত্থেকে আনবো?
- সে আমি জানি না!
- খেলে খা না খেলে নাই! তোকে নিয়ে আর পারি না!
তাহেরা রাগ করে রান্নাঘরে চলে যাবার পর আমিন আবারও কান্নারত জিহাদকে রাগানোর জন্য হাতে ধরা মুরগীর রানে কামড় বসিয়ে বলে, “সাধের রান বানাইলো মোরে বৈরাগী!” এটি শোনার পর এতক্ষণ জিহাদের মনে থাকা রাগ এবং ক্ষোভ বোমার মত বিস্ফোরিত হয়। সে নিজের ভাতের প্লেটটি হাতে নিয়ে সজোরে মেঝেতে ফেলে দেয়। মুহূর্তেই সেই কাঁচের প্লেটটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়!
প্লেট ভাঙার গগনবিদারী আওয়াজ শুনে তাহেরা ঝড়ের গতিতে দৌড়ে এসে আমিন এবং জিহাদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, “কি হয়েছে?” উত্তরে আমিন বলে, “জিহাদ রাগ করে তার প্লেট ভেঙে ফেলেছে!” এ কথা শুনে তাহেরা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে “তোর রাগ আমি আজ বের করছি” বলে জিহাদকে চড় মারতে থাকে। মায়ের চড় খেয়ে জিহাদ কাঁদতে থাকে। এতক্ষণ আমিন ছোট ভাইটিকে রাগাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু সে মার খাচ্ছে দেখে আমিনের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সে এগিয়ে এসে মাকে বলে, “মা, আর মেরো না মা!”
জিহাদ দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের সামনে চলে আসে। সেখানে একটি সুদৃশ্য পুকুর আছে; পুকুরের ঘাটে গিয়ে জিহাদ তার হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে নেয়। তারপর সে ঘাটের পাশে থাকা বড়ই গাছের সুশীতল ছায়ার নিচে বসে থাকে। একটু পরপর যখন মা তাকে মারছে এটি মনে পড়ে, তখন তার দু চোখ জলে ভিজে যায়।
অভিমানী জিহাদ মনে মনে ঠিক করে যে সে আর বাসায় ফিরবে না। তার মনে হয় যে কোনও দোষ না করা সত্ত্বেও মা তাকে শুধু শুধুই মেরেছে। প্লেট ভাঙাটা যে কোনও মতেই ঠিক হয়নি সেটি তার মস্তিষ্কের কোথাও উদয় হচ্ছে না। রাগ করে প্লেট ভাঙাটাই জিহাদের কাছে একপ্রকার বিজয়!
চোখের জল মুছতে মুছতে জিহাদ একটি যাত্রা নাটকের দলকে স্কুলের দিকে আসতে দেখে। দলটির প্রধান এখলাস রহমান গাছের নিচে জিহাদকে একা বসে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
- খোকা, তোমার নাম কি?
- জিহাদ।
- তুমি এখানে একা বসে আছো কেন?
- এমনিতেই।
- তোমার কি ঘর বাড়ি নেই?
- না। ‘আছে’ বলতে গিয়েও মায়ের প্রতি রাগ থেকে সে না বলে।
- তুমি কি আমাদের সাথে যাবে?
- কোথায়?
- আমরা গ্রামেগঞ্জে ঘুরি। যাত্রা নাটক করি। মানুষের ভালোবাসা পাই। যাবে?
- যাব।
জিহাদের জীবন এক নতুন পথে মোড় নেয়। এ পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ সে জানে না; জানার কোথাও নয় কারণ এতো অল্প বয়সে জীবন নামক বইয়ের মাত্র কয়েকটি পাতা সে পড়েছে, পুরো বইটি পড়তে আরও অনেক দেরী!
যাইহোক, জিহাদ যাত্রা নাটকে অভিনয় করতে থাকে। তার চমৎকার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা তাকে ভালোবেসে “অভিরাজ” [অভিনয়ের রাজা] উপাধি দিয়েছে। দেখতে দেখতে আটটি বছর কেটে যায়। ওদিকে তাহেরা তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজতে কোনও চেষ্টাই বাদ রাখেননি। সময়ের সাথে সাথে তিনি কষ্টকে সহ্য করতে শিখে গেছেন। তবুও মায়ের মন এতো সহজে কি সন্তান হারানোর বেদনা ভুলতে পারে? যখনই জিহাদের কথা মনে পড়ে, তখনই তার দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরনা হয়ে বইতে থাকে। বিশেষ করে মুরগীর মাংস রান্না করার সময় জিহাদের কথা খুব বেশী মনে পড়ে। তিনি জানেন না জিহাদ বেঁচে আছে কিনা। বেঁচে থাকলে নিশ্চই আজ তার বয়স ষোল হবে।
জিহাদ তার যাত্রা দল নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় মঞ্চনাটক করে বেড়ায়। প্রথম প্রথম মায়ের কথা, বড় ভাই আমিনের কথা খুব মনে পড়তো। একা একা তাদের কথা মনে করে সে অনেক কেঁদেছে।
একদিন তাহেরা আমিনকে নিয়ে কোরবানির ঈদ করতে সমবেতনগর গ্রামে যান। ঈদ শুরু হতে এখনো প্রায় পনেরো দিন বাকী। যেহেতু আমিনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবার একটু আগেই ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছে, তাই তাহেরা ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন।
আমিন তার চাচা মতিনের সাথে গ্রামের হাটে গরু কিনতে যাবার পথে কানে গানের আওয়াজ ভেসে আসে। সে একটু কৌতূহলী হয়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করে,
- চাচা, ঐদিকে কি হচ্ছে?
- যাত্রা নাটক। অভিনয় করে, গান গায় এসব আর কি!
- চাচা, আমি দেখতে যাই?
- তুই নাটক দেখতে গেলে গরু কিনবে কে?
- তুমিতো আছো তাই না?
- তোর পছন্দের একটা ব্যাপার আছে না?
- আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি মনে মনে গরু বাছাই করে রাখো, আমি এসে দেখার পর কেনা যাবে।
- আচ্ছা, ঠিক আছে যা। তবে দেরী করিস না।
- না, না, দেরী হবে না। আমি যাব আর আসবো!
কিছুক্ষণ শিল্পীদের অভিনয় দেখে আমিন চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়াতেই তার ছোট ভাই জিহাদ মঞ্চে প্রবেশ করে। যদিও তার মুখ মেকআপে ঢাকা, তবুও আমিন তার ছোট ভাইটিকে ঠিকই চিনে ফেলে! সে উত্তেজনায় নিজেকে আর সামলাতে না পেরে “জিহাদ” বলে চিৎকার দিলে জিহাদ অভিনয় থামিয়ে তার দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে দর্শকসহ প্রতিটি মানুষের চোখ আমিনের উপর।
আমিন ঘরে ফিরে সজোরে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। তাহেরা দরজা খুললে আমিনের সাথে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমিনকে জিজ্ঞেস করে,
- তোর সাথে এই ছেলেটি কে?
- তুমিই বলো কে?
তাহেরা আজকাল চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখতে পান না। তিনি ঘরের ভেতর থেকে চশমাটি এনে চোখে দেবার পর তার হারানো বুকের ধন জিহাদকে দেখতে পেয়ে “ও আমার জিহাদ!” বলে পরম আদরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতন কাঁদতে থাকেন। জিহাদও “মা! মাগো!” বলে হাউমাউ করে অঝোরে কাঁদতে থাকে। তাদের কান্না দেখে আমিনেরও চোখ জলে ভিজে যায়। এ কান্না দুঃখের নয়, এ কান্না সুখের। সুখের কান্না অনেক মধুর হয়!
প্রকৃতিতে নিয়ম বিরুদ্ধ কিছু ঘটলেই বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা হারানো ছেলেকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিয়ে ছোট্ট পরিবারটির হারিয়ে যাওয়া ভারসাম্য ফিরিয়ে দিলেন।