ভুতুড়ে! [Bangla Story]

       আকরাম আলী অকস্মাৎ জ্ঞান হারিয়ে উঠানে পড়ে গেলে তার স্ত্রী মদিনা বানু গ্রামের ডাক্তার ইদ্রিস মিয়াঁকে ডেকে আনে। ইদ্রিস ডাক্তার বয়সের ভারে ন্যুজ এবং এক চোখ কানা হলেও এখনও রোগীর শিরা ধরলেই বুঝতে পারেন কোথায় সমস্যা হয়েছে! তিনি আকরামের হাতের শিরায় আঙুল বুলিয়ে বললেন,


- মারা গেছে! ইন্না লিল্লাহ!


- মইরা গেছে! এইডা কি হুনাইলেন ডাক্তার সাব? অহন আমার দুইডা সাওয়ালের কি অইব? মদিনা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে।


- কি আর করা যাবে? সবই আল্লাহ্‌র ইচ্ছা! তাড়াতাড়ি দাফন কাফনের ব্যবস্থা করো।

 

        মদিনা এবং পাড়া প্রতিবেশীদের বুকফাটা আর্তচিৎকারে আশেপাশের গাছে বসে থাকা পাখিরাও কেঁপে উঠে। ইতোমধ্যে মাগরিবের নামাজের সময় মাইকে আকরামের মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হয়েছে। এশার নামাজের পরে জানাজায় শরিক হতে বলা হয়েছে।

 

        দূর দূরান্ত থেকে আকরাম এবং মদিনার আত্মীয়স্বজন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে এসে সমবেদনা জানাচ্ছে। কিন্তু কেউই আকরামের এমন অকস্মাৎ চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না! এমন যদি হতো যে অনেকদিন রোগে ভোগার পর তার মৃত্যু হয়েছে, তাহলেও মানা যেতো, কিন্তু এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াটা সবার কাছেই কেমন যেন ঠেকে।

 

        যাইহোক, এশার নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরম শ্রদ্ধায় আকরামকে পার্শ্ববর্তী কবরস্তানে দাফন করা হয়। দাফনকার্য শেষ হতে না হতেই প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। আকরামের আকস্মিক মৃত্যুর মতই এ ঝড়ও বেশ অদ্ভুত! কবরস্তানের বুক চিড়ে বেড়ে ওঠা বাঁশ গাছগুলো যেন প্রলয়ঙ্করী নৃত্যে মেতেছে! একটি গাছ আরেকটির সাথে খুব জোরে ধাক্কা লেগে এক ভীতিকর আওয়াজ সৃষ্টি করছে। আহত সিংহ কিছুক্ষণ পরপর ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে যেভাবে গর্জে উঠে অনেকটা তেমন।

 

        লোকজন দ্রুত যার যার ঘরে ফিরে যেতে থাকে। মুহূর্তেই আকাশে প্রচণ্ড শব্দে বিজলী চমকাতে থাকে। মনে হয় যেন আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর শিলাবৃষ্টির দেখা মেলে। দাফন সম্পন্ন করে যারা ঘরে যাবার পথে, তাদেরকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। শিলাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে তাদেরকে পার্শ্ববর্তী নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়।

 

        রাত বারোটার দিকে বৃষ্টিপাত থেমে যায়। মদিনা বিছানায় শুয়ে শুধু কাঁদে আর চোখ মুছে। জীবন বেশ কঠিন ছিল, এখন স্বামীকে হারিয়ে জীবন কঠিনতর হয়েছে। হঠাৎ মদিনার কানে কারো পদধ্বনি আসে। পরে মনের ভুল ভেবে প্রয়াত স্বামীর কথা ভাবতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ঘরের দরজায় টোকা পড়তেই মদিনা বাঘের কবলে পড়া মানুষের মত প্রচণ্ড ভয়ে দরজার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়।

 

        মদিনা মনে মনে ভাবে যে এটা নিশ্চয়ই তার মনের ভুল! কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আবারও পাশ ফিরে শুয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আবারও দরজায় টোকা পড়ে। এবার মদিনা সাহস করে জিজ্ঞেস করে,


- কে?


- মদিনা দরজাডা খোলো।


- কে?


- আমি আকরাম।

 

        আমি আকরাম শব্দ দুটো শোনার পর মদিনার মনের ভয় আরও বেড়ে যায়। সে যে ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারে না! একবার মনে মনে ভাবে দরজা খুলে দেবে, আবার মনে হয় দরজা খুললে ভূতটুত এসে আক্রমণ করবে নাতো? যাকে কবরে শুইয়ে এসেছে, রাত একটার দিকে সে দরজায় টোকা দিয়ে বলছে, মদিনা দরজাডা খোলো, এটা কি করে সম্ভব? বাইরে অপেক্ষারত লোকটি আবারও বলে,

 

- মদিনা দরজাডা খোলো না!


- আফনে কেডা?


- আমি তোমার মরদ! আমার গলা চিনো না?


- আফনেরেতো আমরা হক্কলে মিল্লা কবর দিয়া আইছি!


- হ, তুমি ঠিকই কইছো। তয় আমি মরি নাই! হক্কলে মনে করছে আমি মইরা গেছি! তুমি দরজাডা একটু খুলো, আমি তোমারে সব বুঝাইয়া কইতাছি।

 

        মদিনা দরজাটি খুলে তার স্বামী আকরামকেই দেখতে পায়। তার সমস্ত শরীর শুকিয়ে যাওয়া কাঁদায় ঢাকা! তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে কবর থেকে উঠে এসেছে। আকরাম ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে। মদিনা কোনও কথা না বলেই আকরামের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে আকরামের আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে!

 

        কাপড়চোপড় নিয়ে আকরাম বাড়ির উঠানের নলকূপের পানিতে গোসল করে এসে পরম আদরে মদিনাকে জড়িয়ে ধরে। মদিনার নাকে সেই চির পরিচিত ঘ্রাণ এসে লাগে। কিন্তু তার মনে এখনও সন্দেহ আছে; সে ভাবছে এটা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না।

 

        আকরাম তার ভেজা গামছাটি খাটে রেখে মদিনাকে বলে, অনেক রাত হয়েছে; এখন শুয়ে পড়ো। কাল সকালে উঠে বলবো আমি কিভাবে ঐ কবর থেকে উঠে এলাম। মদিনা আকরামকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।

 

সকালে মোরগের বিরামহীন ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে মদিনা বিছানায় উঠে বসে। সে আকরাম আকরাম বলে ডাকতে থাকে। পাশের বাড়ির আছিয়া বলে উঠে, আহা রে! বেচারি মদিনা, জামাইরে হারাইয়া পাগলের মতন আকরাম আকরাম করতাছে!

 

উঠানে, পুকুরে, বাড়ির পেছনের ক্ষেতে- সবখানে খুঁজেও আকরামের কোনও হদিস পাওয়া যায় না। হঠাৎ মদিনার মনে হয় একবার আকরামের কবরের কাছে গিয়ে দেখলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে দেখে আকরামের কবর ঠিকমতই আছে।

  

      মদিনা নিশ্চিত হয় যে গতরাতে সে আকরামকে স্বপ্নে দেখেছিলো। আবারও হতাশা ভূতের মত এসে তার মনে ভর করে। সে ক্লান্ত যোদ্ধার মত নিজের শরীরটাকে বিছানায় ছুঁড়ে দেয়। ঠিক তখন খাটের গামছাটির দিকে তার নজর যায়। গতরাতে আকরাম এই লাল গামছাটি দিয়েই নিজের গা মুছেছিলো! 

View kingofwords's Full Portfolio
tags: