সত্যের জয় [Bangla Story]

       সত্যের খোঁজ নাকি একদিন না একদিন মেলে। লোকে এমনই বলে। কিন্তু দুঃখী কাশেম সেই সত্যের দেখা আজও পায়নি।

 

        কাশেম ফুটপাতের পাশে তার ছোট্ট গাড়িতে চটপটি আর ফুচকা বিক্রি করে যা পায় তাই দিয়েই তার সংসার চালাতে হয়। দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তার পরিবার। স্ত্রী মালেকা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অনেকদিন ধরেই শয্যাশায়ী। সে একটি গাছের মতই বিছানায় পড়ে থাকে।  

 

        কাশেম প্রথম যখন এই চটপটি বিক্রির কাজ শুরু করে তখন তার মাথায় বিশাল ঋণের পাহাড়! চটপটি বিক্রি করতে গেলে বিভিন্ন সরঞ্জামের পাশাপাশি ছোট্ট গাড়িটিও এর ওর কাছ থেকে ধার নিয়ে কিনতে হয়।

 

        শুরুতে অনেক কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে কাশেম সবার ঋণ শোধ করে দেয়। এখন সে মোটামুটি স্বাবলম্বী হলেও কয়েকদিন ধরে একটি সমস্যা তার মনে স্প্লিনটারের মত বিঁধে আছে। পাড়ার মদখোর এবং গাঁজাখোর কিছু তরুণ ছেলে প্রায়ই এসে কাশেমের কাছ থেকে টাকা দাবী করে। তাদের টাকা চাওয়ার ধরণে মনে হয় যেন তারা কাশেমের কাছে টাকা গচ্ছিত রেখেছে, সেই টাকা ফেরত চাইছে!

 

        প্রথম প্রথম কয়েকবার প্রতিবাদ করায় বখাটে ছেলেরা কাশেমকে প্রহার করার এবং গাড়ি পুড়িয়ে দেবার হুমকি দিয়েছে। একদিন তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ছেলেগুলো কাশেমকে বলে,

 

- ঐ মিয়াঁ! আমাগো কতা কি কান দিয়া ঢুকে না? টেকা চাওয়ার লগে লগে টেকা হাতে দিতে অইব, নাইলে কইলাম মাইরা ভর্তা বানাইয়া ফালামু!

 

- আমি গরীব দোকানদার! চটপটি বেইচা ঘর চালাই। আমার উপরে আফনেরা একটু দয়া করেন। এতো জুলুম আল্লায়ও সহ্য করব না।

 

- চুপ হালা! আমাগোরে জ্ঞান দিতাছো নাকি? জ্ঞান দেওন বন্ধ কইরা টেকা দেও মিয়াঁ!

 

- আমার কাছে টেকা নাই ভাই!

 

- আরে হালায় কয় কি? সারাদিন ধইরা চটপটি বেইচা হালায় অহন কয় টেকা নাই!

 

- হাছা কইতাছি ভাই! বেচা বিক্রি ভালা না।

 

- ঐ মার হালারে! দেখ হালার পকেটে কত টেকা আছে। যা আছে সব লইয়া লো!

 

বখাটে ছেলেগুলো কাশেমকে বেদম প্রহার করে। যখন এই কাণ্ডটি ঘটে তখন আশেপাশে অনেক সাধারণ লোক থাকলেও কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি; কেউই বলেনি যে কেন এই গরীব বেচারা কাশেমকে এভাবে কুকুরের মত পেটানো হচ্ছে। সেইদিন তারা নির্দোষ কাশেমকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, জোর করে তার কাছ থেকে পাঁচশত টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

 

        টাকাগুলো কাশেমের খুব প্রয়োজন ছিল; অসুস্থ মালেকার জন্য ঔষধ কেনার জন্য রাখা ছিল। নেশাগ্রস্ত ছেলেদের হাতে মার খেয়ে কাশেমের যতটা কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বেশী কষ্ট হয়েছে স্ত্রীর ঔষধের টাকা হারিয়ে।

 

        নিজের রক্তাক্ত শরীর কোনওমতে টেনে হিঁচড়ে কাশেম বাসায় পৌঁছে। অসুস্থ মালেকা মৃতপ্রায়। অভুক্ত সন্তানেরা এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল কখন বাবা খাবার নিয়ে আসবে। অনেক কষ্টে কাশেম হাতমুখ ধুয়ে কাঁটাছেঁড়া শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দেয়। তার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। কথাও বলতে পারছে না। তেষ্টায় বুকটা গ্রীষ্মের মরা ক্ষেতের মত ফেটে যাচ্ছে। ইশারায় মেয়েকে এক গ্লাস পানি এনে দিতে বলে। সেই পানি খেয়ে কাশেম চোখ বুজে শুয়ে থাকে।

 

        সকালে কাশেমের সন্তানেরা বাবা বাবা বলে ডাকতে থাকে কিন্তু কাশেমের দেহ একটুও নড়ে না। কাশেম যে আর এই পৃথিবীর বাসিন্দা নেই! সে এখন এক নতুন জগতের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু তার সন্তানেরা যে কোনোভাবেই তাদের বাবার এমন প্রস্থান মেনে নিতে পারছে না। 

 

        কান্নার রোল ক্রমে বাড়তেই থাকে। খুপরি ঘরটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ই গাছটিতে কোত্থেকে যেন হাজার হাজার চড়ুই পাখী উড়ে এসে কিচির মিচির শব্দে চারিদিক মুখরিত করে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন কাশেমের মৃত্যুতে চড়ুই পাখীরাও কাঁদছে আজ!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: