জাবের সাহেবের তিন সন্তান; সাইফ, ঈশান এবং আহনাফ। সাইফ সবার বড় এবং আহনাফ সবার ছোট। সাইফ বেশ চালাক প্রকৃতির; ঈশানও ঠিক সেইরকম। তবে আহনাফ বেচারা বুঝে সবই কিন্তু তবুও কেন জানি ধ্যানমগ্ন ঋষির সকল লোভ লালসা ত্যাগ করে দিয়ে রাতের নিস্তব্ধতার মতন চুপচাপ থাকে।
জাবের রিটায়ার্ড করেছেন অনেক দিন আগেই। বয়সের ভারে ক্লান্ত; তাকে দেখে মনে হয় যেন পরপারে যাবার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন। পৃথিবীর এতো জটিলতা, এতো অন্যায়, অবিচার তার আর ভালো লাগে না।
ডাক্তারও বলেছেন যে পৃথিবীতে জাবের আর অল্প কয়েকদিনের অতিথি। সাইফ এবং ঈশান যখনই বাবার কক্ষে যায়, তখনই কেঁদে বুক ভাসায়। তারা দুজনে এমন ভাব করে যেন পিতার আরোগ্য লাভের জন্য তারা প্রতিনিয়ত আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে। বস্তুত তাদের এই যে ভালোবাসা প্রদর্শন, পিতার সান্নিধ্যে অনেক সময় কাটানো- এ সবই লোকদেখানো। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে পিতাকে চাটুকারিতার মায়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কোনোভাবে উইলে সম্পত্তির বিশাল অংশ নিজেদের নামে করিয়ে নেয়া। সাইফ ঈশানকে বলে,
- বাবার সব সম্পত্তি যদি আমরা দুজনে পাই তবে কতই না মজা হত!
- ঠিকই বলেছো ভাই! কিন্তু আহনাফ থাকতে সেটা কি সম্ভব?
- আহনাফ অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না, সে একটু ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তবে আমরাতো আর তাকে গিয়ে বলতে পারি না যে বাবা তোকে সম্পত্তির যে অংশ দেবে সেখান থেকে কিছু অংশ আমাদের নামে দিয়ে দিস।
- তা ঠিকই বলেছো। তবে বাবার কাছে গিয়ে আমরা যদি নিজেদেরকে জাহির করি, মৃতপ্রায় বাবার সেবা করার ভান করি, একটু কান্নাকাটির অভিনয় করি, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে সম্পত্তির সিংহভাগ লিখে দেবেন।
- হতেও পারে। চেষ্টা করতেতো আর দোষ নেই!
যদিও আহনাফ কখনও জমিজমা সংক্রান্ত কথাবার্তা বলে না, তবুও সে তার ভাইদের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল। সে জানে কার উদ্দেশ্য কি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে বৃদ্ধ জাবের কিং লিয়ারের মতই খাঁটি মনের মানুষ চিনতে অপারগ। বিচক্ষণতার পরীক্ষায় দুজনই অকৃতকার্য হয়েছেন।
আহনাফ জানে যে সে যদি সাইফ ও ঈশানের মতন এমন অভিনয় না করে, তবে সম্পত্তির অনেকটা অংশ থেকে তাকে নিশ্চিতভাবে বঞ্চিত হতে হবে। কিন্তু তারপরও সে নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ এবং সর্বদা গর্বের সাথে ন্যায়ের পতাকা তুলে ধরতেই বদ্ধ পরিকর।
আহনাফ মাঝে মাঝে তার প্রয়াত মা জুলেখা বেগমের কথা মনে করে সবার অগোচরে কাঁদে। তার মায়ের কাছ থেকে সে সর্বদা সত্যের পথে চলার শিক্ষা পেয়েছে। এই একই শিক্ষা তার বড় দুই ভাইও পেয়েছে কিন্তু কেন জানি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তারা আজ বিপথগামী।
একদিন সকালে সাইফ এবং ঈশান জাবেরের কক্ষে গিয়ে “বাবা, বাবা” বলে ডাকতে থাকে কিন্তু অনেকক্ষণ ডাকার পরও কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে কাছে গিয়ে বাবার হাতটি ধরতেই সাইফের আত্মা কেঁপে উঠে; তার হাতটি বরফের মতন শীতল; শরীরে রক্ত প্রবাহের কোনও লক্ষণ নেই। নিঃশ্বাসও নিচ্ছে না।
সাইফ এবং ঈশান কাঁদায় পড়ে যাওয়া বাচ্চার মত কাঁদতে থাকে। তাদের চিৎকার শুনে আহনাফও ছুটে এসে যখন বুঝতে পারে যে বাবা এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে উঁচু আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখীর মতন অনেক দূরে উড়ে গেছেন! যেখানে গেছেন, সেখান থেকে ফিরে আসা কখনই সম্ভব নয়। এ যাওয়া সকল বন্ধন ছিন্ন করার, এ যাওয়া এক নতুন উত্থানের অপেক্ষার!
আহনাফ বুঝতে পারে যে সাইফ এবং ঈশানের কান্না শুধুমাত্র কুমিরের কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথেই দাফন কাফনের কাজ শেষ করা হয়। পরদিন বিকেলে উকিল সাহেব জাবেরের রেখে যাওয়া উইলের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করতে আসেন।
উকিলের মুখে উইলের ব্যাপারে আলাপের কথা শুনে সাইফ ও ঈশানের ঠোঁটের কোণে যে হাসি আকাশে রংধনুর মত ফুটে উঠে তা কিন্তু আহনাফের দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পড়ে। আহনাফ তখন ভাবে, আপনজনের মৃত্যুও কিছু মানুষের লোভের কাছে কখনও কখনও নতি স্বীকার করে।
উকিল কথা শুরু করতেই আহনাফ চোখের পানি মুছতে মুছতে উঠে চলে যেতে চাইলে সাইফ ও ঈশান কিছুটা বিদ্রূপের ছলে তাকে সেখানে থাকতে বলে। আসলে তারা নিশ্চিত যে বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির সিংহভাগ তাদের পকেটেই যাবে। তাই উকিলের মুখ থেকে শোনার পূর্বেই তারা একরকম অহংকার করতে শুরু করে; তাদের ভাব দেখে মনেই হয় না যে একদিন আগেই তাদের পিতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
সাইফ এবং ঈশান আর দেরী না করে উকিলকে উইলে কি লেখা আছে তা পড়ে শোনাতে বলে। উকিল পুরো উইলটাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধীরে ধীরে পড়ে শোনায়। উইলের শেষ লাইনটি শোনার পর সাইফ ও ঈশানের মুখ বায়ুহীন বেলুনের মত চুপসে যায়!