ছাত্র ছাত্রীরা পরীক্ষার পূর্বে খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেবে এটাই তো স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার। কিন্তু সেই ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ যদি পড়ালেখা না করে সহজেই কেষ্ট লাভ করতে চায় তখনই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত।
সাধনাপুর গ্রামের ‘ভোরের আলো বিশ্ববিদ্যালয়’-এ ছাত্র সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এটি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্বে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অনেক নামডাক ছিল; কিন্তু যখন থেকে ‘রাজনীতি’ নামক কালসাপটি ক্ষতিকর ভাইরাসের মত এর রন্ধ্রে প্রবেশ করে, তখন থেকেই কষ্ট করে শিক্ষালাভের চেয়ে শিক্ষকদেরকে পরীক্ষার হলে হুমকি ধামকি দিয়ে নকল করে শর্টকাটে পাশ করাটাই ছাত্রদের মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়।
বর্তমান উপাচার্য নিজের পদটি ধরে রাখার জন্য ছাত্রদেরকে রাজনীতি করতে উৎসাহ দেয়, তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দেবার পাশাপাশি গোপনে প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে তাদের সমর্থন আদায়ে উপাচার্য সদা সচেষ্ট থাকে। এসব করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি রসাতলে গেলেও তার কোনও কিছুই যায় আসে না, পরিস্থিতির সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে এমনটিই বোধগম্য হয়।
ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রায় প্রতিদিন রাজনৈতিক মহড়া, মারামারি ইত্যাদি দেখতে দেখতে সাধারণ ছাত্ররা মহাবিরক্ত। মনে মনে তারা এসবের অবসান চায়; তারা বোঝে যে বাবা মা কত কষ্ট করে অর্থ যোগাড় করে তাদেরকে এখানে পড়তে পাঠিয়েছে, এসব দলীয় নোংরামির অংশ হতে তারা কখনও চায় না। ইতোমধ্যে সাধারণ ছাত্ররা বহুবার উপাচার্যের কাছে খোলা চিঠি, বন্ধ চিঠিসহ নানান আল্টিমেটাম দেয়ার পরেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি; গাছের মতই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সেই পূর্বের স্থানেই বিদ্যমান। বরং এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে পরিস্থিতি দিনদিন আরও খারাপ হচ্ছে।
সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতা ও উপরি অর্থের লোভে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হচ্ছে। বয়স কম হবার কারণে কিসে ভালো কিসে মন্দ সেটি বুঝতে না পেরে সুন্দর ভবিষ্যতের পায়ে কুড়াল মারছে!
শিক্ষকদের মধ্যেও সমস্যা আছে; বেশীরভাগ শিক্ষক মনেপ্রাণে চায় যে প্রতিষ্ঠানটি রাজনীতিমুক্ত হোক কিন্তু কিছু কিছু শিক্ষক আছে যারা তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গোপনে এসবে প্রণোদনা দিয়ে যায়। তারা মনে করে যে রাজনৈতিক নেতা শ্রেণির ছাত্রদের হাতে রাখলে নিজেরাও তাদের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারবে।
যখন সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়, তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। বিশেষ করে হলের ভেতরের পরিবেশ হয় নোংরা। প্রায় প্রতিটি রুমেই রাজনীতি করে এমন ছেলেপেলে থাকে; তারা রীতিমত বই খুলেই পরীক্ষা দেয়; এসব দেখে বিবেকবান কোনও শিক্ষক যখন বাধা দেয়, তখন সেই ছেলে এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ঐ নির্দিষ্ট শিক্ষককে সরাসরি অপমান করতে থাকে; কিন্তু যখন ঐ শিক্ষক অনড় অবস্থায় থাকে, তখন তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে হলের বাইরে এসে তুলকালাম কাণ্ড করতে থাকে; তারা অন্যান্য রুমে গিয়ে সকল শিক্ষার্থীকে জোর করে বাইরে বের করে দেয়।
এসব কিছুই উপাচার্য জেনেও না জানার ভান করে থাকে; ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের এসব নোংরা ব্যাপার সেপার সংবাদপত্র ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারের দ্বারা দেশ বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। অভিভাবকরা চান না যে তাদের ছেলেমেয়েরা এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হোক। প্রয়োজনে পড়ালেখার খরচ একটু বেশী হলেও অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়।
এতে করে দিনদিন ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা কমেই যাচ্ছে। এতো কিছুর পরেও স্বার্থপর ও লোভী উপাচার্যের টনক নড়ে না। সে উটের মত দেখেও না দেখার ভান করেই যাচ্ছে। তার যদি একটুও আত্মসম্মান বোধ থাকতো, তবে কবেই পদত্যাগ করে চলে যেত। একদিন কিছু সাহসী এবং শিক্ষানুরাগী ছাত্র উপাচার্যের কক্ষে যায়। তাদের মধ্যে সংগ্রাম নামে একজন এগিয়ে এসে বলে,
- স্যার, আপনাকে আমরা শ্রদ্ধা করতাম কিন্তু আপনার বর্তমান কর্মকাণ্ড আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। আমরা আপনার কাছ থেকে অন্তত কোনও প্রকার দুর্নীতি আশা করিনি।
- এসব কি বলছো? আমি কোথায় দুর্নীতি করলাম?
- স্যার, হাসালেন! আপনি উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকে ভার্সিটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন সব শিক্ষকদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন যারা ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী। তাছাড়া তাদের চেয়েও বহু যোগ্য শিক্ষক আছেন যাদেরকে আপনি রীতিমত কোণঠাসা করে রেখেছেন। এসব কি দুর্নীতি নয়? আমাদের আশা ছিল আপনি ভার্সিটিটাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু সে আশায় পানি ঢেলে দিয়েছেন আপনি। আপনার পূর্বে যে ভিসি ছিলেন, তিনিও দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। তাহলে আপনার আর তার প্রতি কি তফাত থাকলো?
- দেখো! তোমরা আজকালকার ছেলে! আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না! যাও! এসব নেতাগিরি বাদ দিয়ে বাসায় গিয়ে পড়ালেখা করো। ভার্সিটি বেশ ভালোই চলছে।
- সত্য কথা বললেই আপনার গায়ে আগুন লেগে যায় তাই না? ভার্সিটি কোনও দিক দিয়েই ভালো চলছে না। বরং আপনি ভালো আছেন সেটা বলুন! দিনদিন ছাত্র ভর্তির সংখ্যা কমেই চলেছে, দেশে বিদেশে লোকজন ছি ছি করছে! যে ভার্সিটিতে একদিন পরপর মারামারি হানাহানি হয়, সেই ভার্সিটিতে কি কেউ ভর্তি হতে চাইবে? আপনি অচিরেই কিছু ভালো উদ্যোগ নিন, তা না হলে আমরা আমাদের পদক্ষেপ নেব।
- কি করবে? আমাকে হুমকি দিচ্ছ নাকি?
- আপনি কিভাবে নিচ্ছেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমরা অবশ্যই ভালো এবং কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব।
- কে কি পদক্ষেপ নেয় তা সময়ই বলে দেবে! যাও!
যে সকল শিক্ষক সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উন্নতি চায়, তারা যখন প্রকাশ্যে উপাচার্যের নীতিহীন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কথা বলে, তখন উপাচার্য অন্যায়ভাবে নানান কৌশল অবলম্বন করে তাদের প্রোমোশন আটকে দেয়। আর যারা তোষামোদ করে, উপাচার্যের মতই দুর্নীতিবাজ যারা, তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। একেক জনকে নানান পদে নিয়োগ দিয়ে সে নিজের দল ভারী করে চলেছে। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা তার একাউণ্টে গেছে কিনা সেটি জানার জন্যই তার যত আগ্রহ। যার ফলে যারা খুবই দক্ষ, মেধাবী এবং যোগ্য শিক্ষক, তারা হতাশায় ভুগে এবং অন্যত্র চাকরী নিয়ে চলে যায়। অসীম সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর মত ক্ষয়ে যাচ্ছে দেখে বিবেকবান শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবকসহ সকল শুভানুধ্যায়ীরা হায় হায় করছে।
গিরগিটি যেমন যে কোনও পরিস্থিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য রং পাল্টায়, ঠিক তেমনি যেসব দুর্নীতিবাজ এবং বিবেকহীন শিক্ষকরা এতদিন সকল দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, এখন তারাই এমন ভাব করছে যেন প্রতিষ্ঠানটির রক্ষাকর্তা শুধু তারাই! অন্যদের সমর্থন আদায়ে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে।
সময়মত যেমন গাছের ফল পাঁকে, ঠিক তেমনি সময়মতই আন্দোলন শুরু হয়। এসব মুখোশধারী, স্বার্থপর এবং লোভী শিক্ষকদের পদত্যাগ দাবী করে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা প্রায় প্রতিদিনই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের দাবী ন্যায্য এবং যথার্থ। মুষ্টিমেয় এসব জীবাণু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূর হলেই কেবল একটি উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে এক পা এগিয়ে যাবে এই ‘ভোরের আলো বিশ্ববিদ্যালয়’। আলোর কাছে আঁধার পরাজিত হয় সবসময়; আমরা আছি সেই আলোর অপেক্ষায়...