ভক্ত [Bangla Story]

এই ফ্যান বাসার সিলিং ফ্যান নয়, এই ফ্যান হচ্ছে চিত্রনায়িকার প্রতি পাগলের মত ভালোবাসা পোষণ করা এক ভক্তের কথা। এই ফ্যানটির নাম হচ্ছে জিয়ান। কলেজে পড়ে। সেই স্কুলে পড়া অবস্থায় সে বাংলাদেশি অত্যন্ত রূপসী নায়িকা বিদ্যা সিনহা মিমের প্রেমের পুকুরে পিছলে পড়েছে! ঐ পুকুর থেকে ওঠার কোনও ইচ্ছাও তার হৃদয়ে নেই!  

 

চুম্বকের মত আকর্ষণ যাকে বলে আর কি, ঠিক একই রকম জিয়ানের আকর্ষণ মিমের প্রতি। মিমের ছবি এবং পোস্টার যখন যেখানে দেখতে পায় তখনই সেটি কিনে নিয়ে সংগ্রহে রাখে; কখনও পকেটে টাকা না থাকলে চুরি করতেও দ্বিধা করে না!

 

একদিন এক দোকানে মিমের পোস্টার কিনতে গিয়ে ফেরার পথে দোকানে রাখা একটি সুদৃশ্য মগের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। সেই মগে মিমের একটি অসাধারণ নান্দনিক ছবি আছে। টাকা নেই বলে কিনতে না পারার ব্যর্থতায় তার হৃদয় মাছের মত অস্থির হয়ে লাফাতে থাকে।

 

দোকানদার সামান্য অন্যমনস্ক হতেই জিয়ান খুব সুকৌশলে মগটি নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়! আর সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ে। কিন্তু দোকানদারের চোখ ঐদিকে যেতেই সেখানে মগটি দেখতে না পেয়ে চোর চোর বলে চিৎকার দিতে দিতে দোকানের বাইরে এসে জিয়ানকে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। সৌভাগ্যবশত জিয়ান নানান অলিগলি দিয়ে বেশ দ্রুতই সটকে পড়ে, তা না হলে মানুষ তাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে একেবারে আলুভর্তা বানিয়ে ছাড়ত!

 

জিয়ান মিমের স্মৃতি বিজড়িত যাই দেখুক না কেন, সেটি সে সংগ্রহ করেই ছাড়ে! তার রুমের দেয়াল হতে শুরু করে প্রতি কোণায় মিমের পদচারণ। তার মা বিপাশা ছেলের এই আজব মোহে বিরক্ত; এসব পাগলামোর কারণে জিয়ান যে কতবার মায়ের হাতে মার খেয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। এতো মার খাবার পরও তার কোনও শিক্ষা হয়নি; তাই বিপাশাও এখন আর তেমন কিছুই বলে না।

 

যাইহোক, কলেজে জিয়ানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিফাতের প্রস্তাবে সে ঢাকায় গিয়ে মিমের সাথে দেখা করতে সংকল্পবদ্ধ হয়। কিন্তু সে কখনও সেখানে যায়নি; তাছাড়া একা যাবে শুনলে যাওয়া দূরে থাক, মা মেরে তার হাড়গোড় এক করে দেবে!

 

তবে রিফাত বেশ কয়েকবার ঢাকা গিয়েছে; সেখানে তার ফুফুরা থাকেন। এটা শুনে জিয়ান তাকে অনুরোধ করে তার সাথে ঢাকা যাবার জন্য। একদিন মাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়ে দুই বন্ধু ঢাকায় যায়। কিন্তু মিমের মত এতো বিখ্যাত চলচ্চিত্র তারকার দেখা পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?

 

ঢাকায় এসেছে প্রায় সাত দিন হয়; ইতোমধ্যে কতবার যে বিএফডিসির আশেপাশে চরকির মত চক্করের উপর চক্কর দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু কোনও লাভ হয় না। একদিন রিফাত তার ফুফুকে জিজ্ঞেস করে মিমের বাসার ঠিকানা যোগাড় করে।

 

মিম কোথায় থাকে এটা জানার পরে জিয়ান ইয়াহু বলে চিৎকার দিয়ে একটা লাফ দেয়! যেন সে ডানা মেলে পাখীর মত আকাশে উড়ে যাবে! কিন্তু প্রায় প্রতিদিন তারা মিমের বাসার গেইট পর্যন্ত যায়, দারোয়ানকে অনেক মিনতি করে একটিবার মিমকে দেখার সুযোগ দেবার জন্য, কিন্তু কোনও সুফল হয় না। রোদে পুড়ে, অনাহারে থেকে, বৃষ্টিতে ভিজে জিয়ান এবং রিফাতের অসংখ্য নামহীন ভক্ত সেখানে প্রতিদিন ভিড় করে!

 

জিয়ানের বিশ্বাস ছিল যে সে নিজেই মিমের সবচেয়ে বড় ভক্ত; কিন্তু মিমের বাড়ির সামনে এসে তার ভুল কাঁচের মত ভেঙে যায়! এক ভক্ত মিম মিম বলে মাটিতে গড়াগড়ি করছে দেখে দারোয়ান অনেক চেষ্টা করেও গেইটের কাছ থেকে তাকে সরাতে পারছে না!

 

দেখতে দেখতে পনেরো দিন হয়ে গেছে। মা প্রায় প্রতিদিন ফোনে জিজ্ঞেস করে কবে আসবি? জিয়ান রিফাতকে বলে যে যদি সে একপলকের জন্যও মিমকে দেখতে পায়, তবে ঢাকায় আসাটা সার্থক হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে মিমকে সরাসরি দেখতে পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া একই কথা!

 

সৌভাগ্যবশত একদিন গেইট দিয়ে একটি সুদৃশ্য গাড়ি বের হতে দেখে জিয়ানসহ অন্যরা সেখানে মৌমাছির মত ভিড় করে! জিয়ান ও রিফাত গাড়িটির একেবারে কাছেই দাঁড়ানো। পেছনের সিটে এক নারীর অবয়ব ভেসে উঠে; গাড়ির জানালা কিছুটা খোলা থাকায় জিয়ান তাকে স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি দেখতে পায়। সাদা রঙের ড্রেস পরা মিমকে স্বর্গের পরির মত লাগে! চোখে কালো সানগ্লাস।

 

মিম তার ভক্তদের দিকে তাকিয়ে ভিঞ্চির মোনালিসার মত হেসে উঠে। জিয়ানের মনে হয় যেন মিম শুধু তার দিকে তাকিয়েই হেসেছে! যেন আসপাশ জনশূন্য! মুহূর্তে সে কোন এক অজানা রূপকথার জগতে ভেসে বেড়াতে শুরু করে! যেখানে শুধু জিয়ান এবং মিম! এমনকি সেখানে তার বন্ধু রিফাতেরও স্থান নেই!

 

গাড়িটি জিয়ানের পাশ ঘেঁষে যাবার সময় জিয়ান মিমকে উদ্দেশ্য করে লিখা একটি আবেগঘন এবং রোম্যান্টিক চিঠি আলতো করে গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয়। এটি করতে দেখে রিফাত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,

 

- এটা তুই কি করলি?

- কিছু না!

- কিছু না মানে? আমিতো দেখলাম তুই কি একটা কাগজ ছুঁড়ে দিলি!

- সেটা একটি চিঠি বন্ধু!

- চিঠি? কিসের চিঠি?

- সে তুই বুঝবি না!

- বুঝব না মানে? তুই আমার কাছে লুকাবি?

- আচ্ছা বাবা! পরে বলব, এখন চলতো!

 

        এ ঘটনার পরদিন জিয়ান ও রিফাত বাড়ি ফিরে যায়। ঢাকায় মিমকে দেখার যে বাসনা ছিল সেটি অল্প হলেও পূর্ণ হয়েছে। প্রায় একমাস পর জিয়ানের কাছে একটি কুরিয়ার আসে; একটি গিফট বক্স; সেটি খুলে দেখে সেখানে মিমের ছবি সংবলিত একটি সুদৃশ্য মগ এবং একটি চিঠি। চিঠিতে লিখা-

 

        আমি তোমার মত এতো বড় মাপের ভক্ত পেয়ে গর্বিত এবং আনন্দিত! তুমি আমার প্রতি তোমার ভালোলাগার কথা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও ছলনার আশ্রয় না নিয়ে লিখেছ যা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে। তোমার প্রতি আমার দেয়া এই ছোট্ট গিফট; ভালো থেকো, আমার ভক্ত হয়ে এমন ভালোবাসা প্রকাশ করে যেয়ো আজীবন                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                             - মিম।

 

        এই লাইনগুলো জিয়ান যে কতবার পড়েছে আর আনন্দে চোখের জল ফেলেছে তা কেউ দেখেনি! গুপ্তধন অনুসন্ধানীরা যেমন নতুন কিছু পাবার আশায় বারবার খুব সাবধানে তাদের গবেষণা চালিয়ে যায়, জিয়ান ঠিক তেমনি বারবার চিঠির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি বিরামচিহ্ন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে!

 

        জিয়ান তার জীবনে এতো আনন্দ আর কখনও পায়নি! সে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে বিখ্যাত অভিনেত্রী মিম তার এক ভক্তের জন্য উপহার ও চিঠি পাঠিয়েছে! এ ঘটনায় জিয়ানের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় এই ভেবে যে পৃথিবীতে এখনও সুন্দর মনের মানুষ আছে!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: