লাল ফিতা! [Bangla Story]

      সরকারি অফিসের পাশাপাশি টেবিলে থাকা সত্ত্বেও একটি ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যেতে যেতে যে সময় পার করে, এতটুকু সময়ে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে যে কতবার ঘুরে আসতে পারতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

        আইমান সাহেব তার নতুন বাড়িতে গ্যাসলাইনের সংযোগের জন্য আবেদন করেছেন প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও সেই ফাইলটি অন্য টেবিলে যাওয়া তো দূরের কথা ঐ নির্দিষ্ট টেবিল থেকে এক ইঞ্চিও এদিক সেদিক নড়েনি। যেন শামুকের মত একটি স্থানে সেটি লেগে আছে!

 

        দেখতে দেখতে এক বছরের উপর হয়ে যায়। কিন্তু তিনি যতবারই ঐ ফাইলের খোঁজ নিতে আসেন, ততবারই অফিসার বিভিন্ন টালবাহানা করে তাকে এড়িয়ে যান। বলেন- অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ফাইলটি পাস হয়ে যাবে; এতদিন নানান ব্যস্ততার কারণে হয়নি ইত্যাদি। যে কোনও সমাজে যখন গুটিকয়েক মানুষ ন্যায়ের টুঁটি চেপে ধরে, তখন মানবতা গুমরে মরে!    

 

আইমান সাহেব যতবারই বুকে সাগরের মতন আশা নিয়ে আসেন, ততবারই তাকে বানভাসি মানুষের মত হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। আসা আর যাওয়ার মধ্যেই আরও ছয়টি মাস কেটে যায় কিন্তু ফাইল যে আর নড়ে না!

 

আইমান সাহেব জানেন না কোন জাদুবলে সেই ফাইলটি নাড়ানো সম্ভব। তার এই পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে এমনটি তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

 

যদিও আইমান অফিসের কোনও কর্মকর্তার সাথেই দুর্ব্যবহার করেননি কিন্তু ধৈর্যের তো একটি সীমা আছে। ইনি বলেন তার সাথে কথা বলেন, উনি বলেন ঐ রুমে গিয়ে ওনার সাথে কথা বলেন। এভাবে খেলনা গাড়ির মত এই রুম থেকে ঐ রুম, এই টেবিল থেকে ঐ টেবিলে ঘুরতে ঘুরতে আরও ছয়টি মাস কেটে যায়।  

 

একদিন আইমান সাহেব সেই সরকারি অফিসে ঢোকার পথে একজন কেরানীর মতন দেখতে লোক তাকে থামান। সে বলে,

 

- আপনি এভাবে দিনের পর দিন আসা যাওয়া করলেও কোনও লাভ হবে না।

- লাভ হবে না, কি বলছেন আপনি?

- রোগ একটা ঔষধ দিলেন অন্য রোগের, তাহলে কি হবে? রোগ অনুযায়ী ঔষধ দিতে হবে। তাহলেই কাজ হবে।

- রোগ, ঔষধ! কি যে বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন?

- ঘুষ লাগবে ঘুষ! বুঝলেন!

- ঘুষ দিতে হবে? কেন?

- আপনি কি অন্য দুনিয়ার মানুষ নাকি? ঘুষ ছাড়া আপনার ফাইল কখনও পাস হবে না।

- কিন্তু ঘুষ দেয়া এবং নেয়া তো অন্যায়!

- এসব অন্যায় টন্যায় বলে লাভ নেই!

 

        পরদিন আইমান সাহেব আবারও অফিসে আসেন। আজ তার হাতে একটি ছোট্ট খাম। খামটি দেখে গতকালে সাক্ষাত হওয়া সেই কেরানীর মত দেখতে লোকটি মুচকি হাসে। সে বুঝতে পারে যে আজ এই খামে নিশ্চয়ই টাকা ভরে আনা হয়েছে। তাকে দেখে মনে হয় যেন সে গর্বিত; যেন সে কোনও যুদ্ধজয়ী বীর সেনা। গতকাল ঘুষ আনার কথা বলতেই আইমান সাহেব ঘুষ নিয়ে এসেছে- এটা ভেবেই হয়তো বা সেই লোকটি ভাব দেখাচ্ছে!

 

        যাইহোক, আইমান সাহেব যাকে দরখাস্তটি দিয়েছিলেন সেই অফিসারের কাছেই যান সরাসরি। তিনি অফিসারের হাতে খামটি দেন এবং নিঃশব্দে প্রস্থান করেন। অফিসারও মনে মনে ভীষণ খুশী হয় যে এতদিনে আইমান সাহেবের জ্ঞান হয়েছে!  

 

অফিসারটি সেই খাম খুলে সেখানে টাকার পরিবর্তে একটি কাগজ দেখতে পান। সেই কাগজে দুটি লাইন লেখা-

 

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,

 

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।

View kingofwords's Full Portfolio
tags: