আলতাফ সারারাত ঘুমাতে পারেনি এই চিন্তায় যে কখন ভর হবে আর সে কাজের ছেলে সেলিমকে নারকেল গাছে উঠতে বলবে কচি ডাব পেড়ে আনার জন্য। গতকাল বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এসে সবুজ ডালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কচি ডাব দেখে আলতাফের জিবে জল এসে যায়।
চাঁদ মামা সাময়িকভাবে বিদায় নিলে সূর্য তার কাজে লেগে যায়। জানালা ভারী পর্দা ভেদ করে ডাকাতের মত আলো ঘরের ভেতরের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কোণা দখল করে নেয়। আলতাফ যদিও একফোঁটাও ঘুমায়নি, তবুও তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে হাই তুলছে আর কচি ডাবের কথা চিন্তা করছে। কখন যে সেই ডাবের সুমিষ্ট পানি তার পাকস্থলীতে প্রবেশ করবে এই চিন্তায় সে অস্থির!
ডাব পেড়ে খাওয়ার ব্যাপারে সে কিন্তু বাবা কিংবা মা কাউকেই কিছু বলেনি। কারণ সে জানে যে কারো কাছে অনুমতি নিতে গেলেই বিপদ। বাবা অনুমতি দিলে মা হয়তো বাগড়া দেবেন, আবার মাকে কোনওমতে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করতে পারলেও বাবা হয়তো বেঁকে বসবেন। তাই আলতাফ মনে মনে ঠিক করে নেয় যে আজ স্কুল থেকে ফিরে এসে বাড়ির পেছনের নারিকেল গাছ থেকে সেই ডাব পেড়ে খাবেই খাবে!
স্কুল ছুটি হবার পর বুলেট ট্রেনের গতিতে আলতাফ বাসায় ছুটে আসে। এসেই কাপড়চোপড় পাল্টে বাইরে বেরিয়ে যাবার সময় মা দেখে বলে,
- ‘কি রে! এমন পাগলের মত কোথায় ছুটছিস?’
- ‘আসছি মা!’ বলে আলতাফ দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়।
সেলিমকে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগে যায়। সে পার্শ্ববর্তী পুকুরের পারে ঝোপের আড়ালে বসে পুঁটি আর তেলাপিয়া মাছ ধরছে। তাকে দেখেই আলতাফ বলে যে তার সাথে যাওয়ার জন্য। সেলিম সবেমাত্র কয়েকটা মাছ ধরেছে। আজ বরশিতে মাছ ধরছেও বেশ! সেলিমের খায়েশ ছিল যে আরও কিছু মাছ ধরতে পারলে পেয়াজ আর মরিচ দিয়ে ভেজে সাদা ভাত এবং কাঁচা মরিচ দিয়ে খুব তৃপ্তি সহকারে খাবে। কিন্তু সেই সাধে বালি ছিটিয়ে দিতে এসেছে আলতাফ।
অত্যন্ত অনিচ্ছা এবং বিরক্তির সাথে সেলিম মাছ ধরায় ক্ষান্ত দিয়ে আলতাফের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। ইতোমধ্যে দুয়েকবার জানতে চেয়েছে যে কি কাজ করতে হবে, কিন্তু আলতাফ বোবার মত একটি কথাও বলেনি; যেন তার মুখে চেইন লাগানো!
যাইহোক, নারিকেল গাছের নিচে যাওয়ার পরে আলতাফ সেলিমকে গাছে উঠতে বলে। এর আগেও সেলিম গাছে উঠে ডাব পেড়েছে ঠিকই তবে যে গাছে আলতাফ এখন উঠতে বলছে, সেই গাছটি অনেক লম্বা। গাছটি দেখেই সেলিম ভুতে আছর করা মানুষের মত দৌড় দেয়! কিন্তু আলতাফ বিদ্যুতের গতিতে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে! সেলিম আবারও দৌড় দিতে গেলে আলতাফ তাকে একটি লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। সে বলে,
- যদি তুই ডাব পেড়ে আনিস তবে আমি তোকে দুটো ডাব দেবো খাওয়ার জন্য।
যদিও মাছ বরশিতে গাঁথা খাবারের লোভে পড়ে আটকে যায়, সেলিম কিন্তু আলতাফের বিছানো লোভের জালে সহজেই জড়ায় না! সেলিম যতই বলে যে সেই গাছে সে উঠবে না, আলতাফ ততই জোঁকের মত তাকে যেন ধরে থাকে। অগত্যা সেলিমকে গাছে উঠতেই হয়। অনেক কষ্টে সে গাছের ডগায় পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে কয়েকটি ডাবও সে মাটিতে ফেলে। দুর্ভাগ্যবশত, দুয়েকটি ডাব এতো কচি যে মাটিতে পড়েই ফেটে যায়। এর ফলে ভেতরে থাকা পানিও গড়িয়ে পড়তে থাকে।
ডাবের সুমিষ্ট পানি এইভাবে নষ্ট হতে দেখে আলতাফের বুকটা বেলুনের মত যেন ফাটতে থাকে। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই ফেটে যাওয়া ডাব হাতে নিয়ে যে অংশ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে, সেই অংশ মুখের কাছে নিয়ে পানি পান করতে থাকে। কিছু পানি তার মুখে যায় কিন্তু বেশীরভাগই মাটিতে পড়তে থাকে।
এদিকে সেলিমকে নামতে দেখে আলতাফের মেজাজ খারাপ হয়। সে বলে,
- আরও কয়েকটা ডাব পাড়!
- আর পারব না; আমার হাত পা প্রচণ্ড ব্যথা করছে।
গাছে থাকা ডাব সজোরে হাতের মোচড়ে আলগা করতে হয়; যেহেতু এ কাজটি করতে গিয়ে অনেক শক্তি ক্ষয় হয়, তাই সেলিম খুব ক্লান্ত বোধ করছে।
কথায় আছে যে- শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। কিন্তু ডাব খাওয়ার প্রচেষ্টার শেষটা মোটেও ভালো হয়নি। নামতে গিয়ে মাঝ পথে এসে সেলিম আকাশ থেকে উড়ে আসা কোনও উল্কাপিণ্ডের মত মাটিতে পড়ে যায়। তার হাত পা ছিলে যায়; নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। তার নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়।
এমতাবস্থায়, আলতাফ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। তার মাথা কাজ করছে না। মাঝে মাঝে কম্পিউটার যেমন হেং হয়ে যায়, সেলিমের মাথাও যেন ঠিক তেমনি হেং হয়ে গেছে! আলতাফ নিজেকে সামলে নিয়ে তার মাকে ডেকে নিয়ে আসে। মা খুব দ্রুত সেলিমকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
আলতাফ এই দুর্ঘটনার জন্য মনে মনে নিজেকেই দায়ী করতে থাকে। সে আল্লাহ্র কাছে বারবার প্রার্থনা করতে থাকে সেলিম যাতে বেঁচে যায়। সে যাতে আবার আগের মত সুস্থ সবল হয়ে উঠে। আলতাফ এও প্রতিজ্ঞা করে যে সে আর কখনও সেলিমকে এভাবে গাছে উঠতে জোরাজুরি করবে না।
ইতোমধ্যে সেলিমের বাবা মাও অসুস্থ ছেলেকে দেখতে এসেছে। সকলেই তার জন্য উদ্বিগ্ন!