আমাদের সমাজে কোনও পরিবারে মূল্যবান কিছু চুরি হলেই প্রথমে সন্দেহ বর্শার গতিতে ছুটে যায় ঘরের কাজের লোকের দিকে। যেন ওরা জন্মগতভাবেই চোর! মানুষ ধরেই নেয় যে অভাবের তাড়নায় তাদের স্বভাব নষ্ট হয়েছে।
আতিফ এবং শাহানার ছোট সংসারের মধ্যমণি হচ্ছে তাদের একমাত্র সন্তান অন্তু। তার বয়স মাত্র দু বছর। আর দু দিন পরই তার জন্মদিন। এবার তার জন্মদিন খুব ঘটা করে পালন করার জন্য স্বামী স্ত্রী দুজনেই মুখিয়ে আছে।
ইতোমধ্যে আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদেরকে নিমন্ত্রণ জানানোও হয়ে গেছে। আতিফ এবং শাহানা দুজনে মিলেই কাজটি করেছে। জন্মদিনের ক্ষণ আসে। মেঘের মত ধীরে ধীরে মেহমানরা আসতে থাকে। হই হুল্লোড় আর হাসি ঠাট্টায় এক অসাধারণ আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বলাই বাহুল্য যে খাবার দাবারের আয়োজন করার ক্ষেত্রে বেশীরভাগ অবদান শাহানার। তবে কাজের মেয়ে আম্বিয়ার সহায়তা না পেলে হয়তো এতো পরিমাণ খাবারের সমাহার করা সম্ভব হত না!
যদিও আতিফ এবং শাহানা সব আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে পূর্বেই অনুরোধ করেছিলেন যাতে কোনও উপহার সঙ্গে করে না আনেন, তবুও তারা নানান রকম উপহার নিয়ে এসেছেন। বিপুল আনন্দে শুরু হওয়া জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর আতিফ ও শাহানা এতো ক্লান্ত যেন এইমাত্র দুজনে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে বরফে হাঁটু গেড়ে হাঁপাচ্ছে!
উপহারের ছোট খাটো টিলা নাড়াচাড়া করার শক্তি বা সাধ কোনটাই নেই এই দম্পতির। আম্বিয়াও তার কাজ গুছিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে গেছে। তার বাসা বেশ দূরে নয়। রাস্তা পার হলেই একটি মাঝারি আকারের বস্তি চোখে পড়ে, সেখানেই সে আর তার বৃদ্ধা মা বাস করে। মানুষের ঘরে কাজ করে যা রোজগার হয় তাই দিয়েই কোনওমতে কষ্ট করে দিন চলে যায়। আম্বিয়া সবচেয়ে বেশী দুশ্চিন্তায় পড়ে যখন তার মা অসুখে আক্রান্ত হয়। তখন খরচ অনেক বেড়ে যায়; খাবারের ব্যবস্থা করার আগে মায়ের ঔষধ কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
যাইহোক, পরদিন আতিফ অফিসে যাবার পর শাহানা এবং আম্বিয়া এক এক করে উপহারের বাক্সগুলো খুলে খুলে ভেতরের জিনিসগুলো আলাদা করে রাখছে। যেহেতু অন্তু এখনও বাচ্চা, তাই বেশীরভাগ উপহারই খেলনা- গাড়ি, ট্রেন, পুতুল ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার দু একটা স্বর্ণের আংটি এবং চেইন দিয়েছেন। সর্বশেষ যে বাক্সটি শাহানা খুলেছে সেটার ভেতর একটি হীরার আংটি দেখে সে চমকে উঠে! সে অসীম আনন্দে মনের অজান্তেই বলে উঠে- “হীরার আংটি!”
যখন এ শব্দগুলো উচ্চারণ করে তখন আম্বিয়া তা শুনে ফেলে। কিন্তু সে শুনেও না শোনার ভান করে খালি বাক্সগুলো সরাতে থাকে। শাহানা রীতিমত অবাক এই হীরার আংটি দেখে। সে উপহারের বাক্সে লেখা নামটি ভালো করে পড়ে দেখে। আংটিটা দিয়েছে তার বান্ধবী লিমা। লিমার স্বামী মস্ত বড়লোক; তার হীরার ব্যবসা আছে।
শাহানা সবার আগে হীরার আংটিটি আলমারিতে রেখে বাকি উপহারগুলো খুব সাবধানে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে থাকে। এক ঘণ্টার মধ্যেই কাজটি শেষ হয়ে যায়। এদিকে আম্বিয়া আজ একটু আগে বাসায় যেতে চায় কারণ তার মায়ের শরীরটা নাকি খুব অসুস্থ। শাহানার মন শিশুর মত কোমল হওয়াতে কাউকেই ‘না’ বলতে পারে না।
অনুমতি পেয়ে আম্বিয়া বাসায় চলে গেলে শাহানা আলমারি থেকে হীরার আংটিটি বের করে খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে সেটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে নতুন কাপড় কেনার পর ক্রেতা যেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ঠিক তেমনি!
শাহানা এতটাই মুগ্ধ যে সে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না! আসলে তার কখনও ধারণাই ছিল না যে কেউ তার বাচ্চার জন্মদিনে হীরার আংটি উপহার দিতে পারে। হীরার তৈরি অলংকারের প্রতি তার সবসময়ই একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে। আতিফও সেটা ভালো করেই জানে কিন্তু তার ইনকাম এতটা নয় যে স্ত্রীকে হীরার আংটি কিনে দেবে। যদিও তার স্বপ্ন আছে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে একসময় হীরার তৈরি গহনা কিনে দিয়ে শাহানাকে অবাক করে দেবে।
আতিফ ফিরে এলে খাওয়া দাওয়া সেরে বিকেলে শুয়ে শুয়ে স্বামী স্ত্রীর মাঝে টুকটাক কথা হবার ফাঁকে শাহানা ঐ হীরার আংটির কথা বলে। এ কথা শুনেই আতিফ বজ্রপাতের মত চমকে উঠে। সে শোয়া অবস্থা থেকে খাটে উঠে বসে এবং আংটিটি দেখতে চায়।
শাহানা আংটি এনে দিলে আতিফ পাকা জহুরীর মত সেটিকে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করে। নিবিষ্ট মনে আংটি দেখার সময় তার কপালের মাঝখানে সন্দেহের ভাঁজ পড়ে যেটি শাহানার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। একসময় সন্দেহবশত আতিফ বলে,
- এটা কি আসলেই হীরার আংটি, নাকি হীরার মত দেখতে সাধারণ কোনও আংটি?
- এ কথা শুনে শাহানা বাচ্চার মত হেসে উঠে বলে, “কি যে বল না তুমি? হীরার আংটি। আমার বান্ধবী লিমা দিয়েছে। তুমি তো জানো যে লিমার স্বামীর হীরার ব্যবসা আছে! একবার বলেছিলাম অনেক আগে। তোমার হয়তো মনে নেই!”
এ কথা শুনে আতিফ অনেকটা আশ্বস্ত হলেও কেন জানি তার মনের কোথাও এখনও একটুখানি সন্দেহের নুড়ি পাথরের অস্তিত্ব আছে। যদিও সে তার আনন্দকে প্রকাশ করেনি তবে মনে মনে ভীষণ খুশী। কিন্তু খুশী হবার পাশাপাশি তার মধ্যে এক ধরণের হতাশা সাপের মত ফণা তুলে আছে যেন। নিজের অসহায়ত্বটা অনেক বড় আকারে তার সামনে এসে প্রেতাত্মার মত দাঁড়িয়ে আছে! শাহানার কোনও শখই সে ঠিকমত পূরণ করতে পারে না। ছোট খাটো চাকরি করে যে বেতন পায় তাতে বড় কোনও স্বপ্ন দেখা অসম্ভব। তবে শাহানার মন অত্যন্ত ভালো এবং সে আত্মসংযমী বলেই এসব অলংকারের জন্য তার স্বামীকে অহেতুক মানসিক পীড়া দেয় না।
পরদিন আম্বিয়া যখন বাসায় আসে তখন তাকে অনেক রোগা এবং অসুস্থ দেখায়। শাহানা বুঝতে পারে যে অসুস্থ মাকে নিয়ে একা একা সংসারের চাকা ঠেলতে ঠেলতে সে অনেক ক্লান্ত। তাকে দেখলেই মনে হয় যেন কেউ তার কোমল দুই কাঁধে বিশাল কোনও পাথরের খণ্ড রেখে দিয়েছে যেন পুরাণের সেই সিসিফাসের মতন যার কোনও নিস্তার নেই!
শাহানা আম্বিয়াকে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বাচ্চার মত কেঁদে উঠে। শাহানার চোখও ছলছল করে। সে বোঝায় যে এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। মনোবল বাড়াতে হবে। মা খুব অসুস্থ কিন্তু ঔষধ কেনার সামর্থ্য আম্বিয়ার নেই। শাহানার কাছে অনুরোধ করে সামনের মাসের বেতন থেকে কিছু টাকা অগ্রিম দিতে।
শাহানা পড়েছে উভয় সঙ্কটে! একদিকে মানবিকতা আবার অন্যদিকে নিজের সংসারের খরচের কথা মাথায় রাখা। সে যদি একটু বেশী টাকা দেয় তাহলে নিজের দৈনন্দিন খরচে টান পড়বে। যাইহোক, আম্বিয়াকে নিরাশ করার কোনও ইচ্ছে তার নেই। কিছু টাকা আম্বিয়ার হাতে দিয়ে সে বলে,
- আজ আর কাজ করার দরকার নেই; তুমি গিয়ে তোমার মায়ের সেবা করো যাও।
- কিন্তু শাহানার এমন মধুর ব্যবহারে আম্বিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে বলে, “আমি এখনই যেতে হবে এমন নয়। কিছু কাজ করে দিয়ে তারপর যাব। বাথরুমে রাখা ময়লা কাপড়গুলো ধুয়ে দিয়ে যাই?
- লাগবে না।
- আমি না ধুয়ে দিলেতো আপনাকেই কষ্ট করে ধুতে হবে।
- তাতে কি? একদিন না হয় ধুলাম!
- সেটা যে আমার খুব খারাপ লাগবে!
- আহা! আমি বলছিতো যাও। একদিন একটু কম কাজ করলে তেমন ক্ষতি হবে না। বাকী কাজগুলো আমি গুটিয়ে নেবো।
এদিকে অন্তুর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কাঁদতে থাকে। শাহানা দৌড়ে গিয়ে ছেলের পাশে শোয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তু আবারও ঘুমের রাজ্যে ঢলে পড়ে। এই ফাঁকে শাহানা পাকঘরে গিয়ে দুপুরের রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে থাকে।
কাপড় ধোয়া শেষ হলে আম্বিয়া ঘর ঝাড়ু দেয়া শুরু করে দেয়। শাহানা ফিরে এসে তাকে চলে যেতে বলে। যেহেতু ঘর ঝাড়ু দেয়া শেষ, তাই আম্বিয়া নিশ্চিন্তমনে চলে যায়। যাবার আগে শাহানাকে বলে তার মায়ের জন্য দোয়া করতে।
আম্বিয়া আরেকবার অন্তুকে দেখতে আসে। সে এখনও ঘুমাচ্ছে। তার এতো আরামের ঘুম দেখে শাহানার একটু হিংসা হয়! মনে মনে ভাবে- বাচ্চাদের কি সুখ! কোনও চিন্তা নেই! কোনও ঝামেলা নেই! ইশ! আবার যদি শিশু হতে পারতাম!
অন্তুর কপালে মায়াভরা চুমু দিয়ে আবার পাকঘরের দিকে যেতেই আলমারির দিকে চোখ পড়ে। শাহানার মনে আছে যে আলমারিটা ভালো করে লাগানো ছিল কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে কেউ এটা খুলেছে; আলমারির দরজা ঠিকমত বন্ধ হয়নি।
হঠাৎ শাহানার মনে এক অজানা আশংকা ভর করে! সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে আলমারিটা খুলে দেখে হীরার আংটিটা যথাস্থানে নেই! তখন তার মনে হয় যে কেউ তার বুক চিড়ে হৃদয়টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
শাহানার গলা শুকিয়ে মৃত খালের মত হয়ে যায়! সে নিজেকে সামলে নিয়ে আতিফকে ফোন করে বিষয়টা জানায় এবং বলে যেন দ্রুত ঘরে আসার জন্য। আতিফ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরে আসে। আসার সাথে সাথেই শাহানা কান্নারত অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরে। রাগ করে চলে যাওয়া ছেলে অনেকদিন পর ফিরে এলে আবেগপ্রবণ মা যেভাবে ছেলেকে পরম আদরে বুকে টেনে নেয় ঠিক তেমনি।
সবকিছু শোনার পর আতিফ ও শাহানার কোনও সন্দেহই থাকে না যে চুরিটা আসলে আম্বিয়াই করেছে। যখন শাহানা পাকঘরে রান্নায় ব্যস্ত ছিল ঠিক তখন ঘর ঝাড়ু দেয়ার ভান করে সে এই জঘন্য কাজটি করেছে।
যেহেতু আম্বিয়ার বাসা ওরা দুজনেই চেনে, তাই আর দেরী না করে তারা তখুনি বেরিয়ে পড়ে। পথিমধ্যে অনেক মানুষের জটলা দেখে তারাও একটু এগিয়ে গিয়ে দেখার চেষ্টা করে যে কি হয়েছে। ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে সামনে যাবার পর যা দেখে তার অন্য স্বামী স্ত্রী দুজনেই প্রস্তুত ছিল না।
রাস্তার পাশে আম্বিয়ার রক্তাক্ত দেহ কাঠের তক্তার মত পড়ে আছে। লাশের ঠিক পাশেই একটি ছোট পলিথিনের ব্যাগের ভেতরে থাকা ঔষধ এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। আশেপাশের লোকজন বলাবলি করছে যে একটু আগে একটি মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিলে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হয়।
এমতাবস্থায় আতিফ ও আম্বিয়া বুঝে উঠতে পারে না যে কি করা উচিত। ঐ লাশের পাশে দাঁড়িয়েও আতিফের মনে হীরার আংটিটার কথা সূর্যের মত উঁকি দেয়। সে লাশের আশেপাশে চোখ ঘুরায় এই আশায় যে হয়তো আংটিটা এখানেই কোথাও আছে কারণ চুরি করার পর নিশ্চয়ই আম্বিয়া সেটি লুকানোর সুযোগ পায়নি।
আংটির জন্য আম্বিয়ার মৃতপ্রায় মায়ের কাছে গিয়েও কোনও লাভ হবে না। তাছাড়া যার যুবতী মেয়ে মাত্র মারা গেছে, তার কাছে গিয়ে সমবেদনা না জানিয়ে আংটির খোঁজ করাটা পশুর মত আচরণ হবে এ কথা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া এটা প্রমাণ করাও মুশকিল যে আংটিটি আম্বিয়াই চুরি করেছে। কারণ কেউ তো সেটি নিতে দেখেনি। যদি সে নিয়েও থাকে তবে এখন তো প্রমাণ করারও কোনও উপায় নেই।
অত্যন্ত হতাশ এবং দুঃখী মন নিয়ে আতিফ এবং শাহানা বাসায় ফিরে আসে। আতিফ শাহানাকে বলে যে সে আলমারির ভেতরটা ভালো করে দেখেছে কিনা। এমনও তো হতে পারে যে শাহানা আংটিটি অন্য জায়গায় রেখেছে এবং ভুলে গেছে।
শাহানা আতিফের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তখুনি আরেকবার আলমারির ভেতরে ভালো করে দেখতে থাকে। আম্বিয়া হীরার আংটিটি খুঁজে পায়; আসলে সেটি অন্য একটি কাপড়ের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল যে কারণে শাহানার মনে হয়েছিল যে আংটিটি চুরি হয়েছে। তখন স্বামী স্ত্রী দুজনের বুকে মৃত আম্বিয়ার প্রতি ঘৃণা এবং অভিশাপের বদলে শ্রদ্ধা এবং দরদ উথলে উঠে সাগরের বুকে যেমন ঢেউ জেগে উঠে ঠিক তেমন!