ছোট কবিতা নিয়ে বিষদ আলোচনার পূর্বে ‘কবিতা’র মূল সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা অপরিহার্য। মূলত, ‘কবিতা’ শব্দটির ইংরেজি হচ্ছে ‘poetry’ যেটি গ্রিক শব্দ ‘poiesis’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘নির্মাণ’ অথবা ‘তৈরি করা’। এটি শিল্পের একটি অন্যতম মূল্যবান শাখা যেখানে ভাষার নান্দনিক বৈশিষ্টের ব্যবহার লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি কবিতায় ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তুর অনবদ্য উপস্থিতি রয়েছে। এরিস্টটলের “পোয়েটিকস” গ্রন্থেও কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আমার মতে কবিতা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিকতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ যেখানে মানুষের আভ্যন্তরীণ আবেগ এবং অনুভূতির সাথে পার্থিব বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই যে অনেক সাহিত্য গবেষকদের মতে সাহিত্যের আদিমতম শাখা হচ্ছে কবিতা। এ কথার সমর্থনে বেশ জোরালো যুক্তিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে মেসোপটেমিয়ার [বর্তমানে ইরাক] মহাকাব্য “গিল্গামেশ” [প্রায় ২১০০ খ্রিষ্টপূর্ব] সাহিত্য জগতের সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শন। তাছাড়া ‘বৈদিক সংস্কৃত’ ভাষায় রচিত প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ “বেদ” [১৭০০-১২০০ খ্রিষ্টপূর্ব] এবং হোমারের “অডিসি” [৮০০-৬৭৫ খ্রিষ্টপূর্ব] কিন্তু কাব্যিক ধারায়ই লিখিত।
যেহেতু এই প্রবন্ধটি ‘ছোট কবিতা’ বিষয়ক, তাই কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাসের দিকে বেশী মনোনিবেশ না করে মূল বিষয়বস্তুতে ফিরে আসা যাক। যদিও নাম তার ‘ছোট কবিতা’, কিন্তু কাজে তার বিশালতা একমাত্র ঐ আকাশের সাথেই তুলনীয়! না, আমি বিন্দুমাত্র বাগাড়ম্বর করছি না; কিংবা একেবারেই বাড়িয়ে বলছি না। সত্যকে সত্য বলতেই হবে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য সেই অসাধারণ নান্দনিকতা এবং জাদুময় ক্ষমতা আছে বলেই ছোট কবিতা যুগ থেকে যুগান্তরে সূর্যের মতই আজও অক্ষয় এবং আলোকিত!
ছোট কবিতা মানব মনের সুপ্ত অনুভূতিকে এমনভাবে আন্দোলিত করে যেমন করে মৃদুমন্দ বাতাস ঐ গাছের সবুজ পাতাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়! মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেই কিন্তু ছোট কবিতার দায়িত্ব শেষ হয় না, সেই হৃদয়কে সৃষ্টিশীলতার দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত করতে থাকে। উল্লেখ্য, রবি ঠাকুর যেমন ঘরের বাইরের একটি শিশির বিন্দু দেখতে বলেছেন, সেই শিশির কণার স্বর্গীয় দ্যুতি এবং অপার সৌন্দর্য অবলোকন করতে বলেছেন- তাতেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে ক্ষুদ্র বা ছোট হলেই কোনও কিছু তুচ্ছ নয়। ক্ষুদ্র থেকেই কিন্তু বিশাল জন্ম নেয়। একটি অতিকায় বৃক্ষের শুরুটা কিন্তু সেই অতি ক্ষুদ্র বীজ থেকেই হয়! যাইহোক, ছোট কবিতা দেখতে ছোট হলেও ব্যক্তির মননে কিংবা মানসিকতায় যে আমূল পরিবর্তন সাধনের যোগ্যতা তার আছে, সেটা কেউই অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তাইতো এখনও হাইকু, সিঙ্কুএইন, লিমেরিক, রুবাই, সিজো ইত্যাদি ছোট কবিতার ধারা হিমালয়সম গৌরব নিয়ে এখনও টিকে আছে। বর্তমান যুগের যে কোনও ভাষার কবিরাই অনায়াসে এসব ছোট কবিতার ধরণ অনুসরণ করে অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত কবিতা লিখে চলেছেন এবং পাঠকগণের মনে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তুলছেন।
সাধারণত, কবিতা প্রকৃতিকে অনুকরণ করে; অন্যদিকে ছোট কবিতা হচ্ছে পৃথিবীকে দেখার এবং বোঝার জন্য একটি অসাধারণ পন্থা বা মাধ্যম। অনেক সাহিত্যিকগণ মনে প্রাণে বিশ্বাস পোষণ করেন যে ছোট কবিতার মাঝে যেসব অমূল্য উপাদান বিদ্যমান তা হচ্ছে-প্রজ্ঞা, পরামর্শ, সতর্কতা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি। জাপানি কবি মাতসু কিন্সাকু বাশোর অনবদ্য সৃষ্টি ‘হাইকু’ কবিতায় আমরা এসব উপাদানের দেখা পাই। বিখ্যাত কবিদের মধ্যে যারা ছোট কবিতা লিখেছেন তাদের নাম বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কথা; তার ছোট ছোট সনেটগুলো আজও সাহিত্য অনুরাগীদের মনে এক অসাধারণ দ্যোতনা সৃষ্টি করে চলেছে। এডগার এলান পোর কথা যার ছোট কবিতা “ড্রিম উইদিন অ্যা ড্রিম” পৃথিবী খ্যাত; তার “সনেট ১৮”-র উল্লেখ করতেই হয় যেটির প্রথম লাইন- “Shall I compare thee to a summer’s day?” এতটাই রোম্যান্টিক যে আজও প্রেমিকগণ তাদের প্রেমিকার রাগ ভাঙানোর জন্য কিংবা কেউ সুন্দরী মেয়ে পটানোর জন্য এই অসাধারণ লাইনটির ব্যবহার করে থাকে! এমিলি ডিকিন্সনও প্রচুর ছোট কবিতা লিখেছেন যার বেশীরভাগ জুড়ে তার ব্যক্তিগত হতাশা এবং দুঃখের বিবরণ বিদ্যমান। তার “ইফ আই ক্যান স্টপ ওয়ান হার্ট ফ্রম ব্রেকিং” একটি অসাধারণ ছোট কবিতা। জালাল উদ্দীন রুমির “লাভ”, ‘দ্যা টেম্পল অব লাভ” ইত্যাদি কবিতাগুলো স্বর্গীয় প্রেমের অনাবিল আনন্দ এবং রহস্যময়তাকেই তুলে ধরে। পারস্যের কবি হাফিজ অমর হয়ে আছেন তার অতুলনীয় ছোট কবিতা এবং গজলের দ্বারা। তার অসংখ্য ছোট কবিতার মধ্যে যেগুলো প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে- “হোপ”, লার্নিং টু ফ্লাই”, প্লেয়িং দ্যা গেইম” এবং “পানিশমেন্ট”। তার কবিতায় সৃষ্টিকর্তা, প্রেম, নিষ্ঠা, বিশ্বাস, কপটতা এবং জীবনের প্রতি রহস্যময়তার এক নান্দনিক প্রতিফলন লক্ষণীয়। এছাড়াও রবার্ট ফ্রষ্টের ছোট কবিতা “ষ্টপিং বাই উডস অন এ স্নোই ইভনিং” এবং “দ্যা রোড নট টেকেন” খুবই সহজ ভাষায় লিখা হলেও কবিতাগুলোর চিন্তার গভীরতা এতটা ব্যাপক যে পাঠকগণ মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। আসলে অনেক বিখ্যাত কবিরাই ছোট কবিতা লিখেছেন; কার নাম ছেড়ে কার নাম বলব সেটা ভেবেই হিমশিম খেতে হয়। এ তালিকায় আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম হচ্ছে- হুইটম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কিটস, হেনরি ডেভিড থরু, থমাস হার্ডি প্রমুখ। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবিগণও হৃদয়ছোঁয়ানো প্রচুর ছোট কবিতা লিখেছেন; তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ প্রমুখ।
প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কথা না বললেই নয়- সাহিত্যে যেমন একজন কবি বা লেখকের নিয়ম মানতে হয়, তেমনি কিন্তু তাকে মাঝে মাঝে নিয়ম ভাঙতেও হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে সাহিত্যের নিয়ম ভাঙ্গাটা কিন্তু নতুন কোনও ধারার জন্ম দেয়! যেমন, ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর জ্যাক কেরুয়াকসহ অন্যান্য মার্কিন কবিগণ ১৭ সিলেবলের হাইকুর ধারা ভেঙে আরও বেশী সিলেবল অন্তর্ভুক্ত করে হাইকু লিখেছেন।
সাহিত্যকর্ম নিজেই সৃষ্টিশীলতার আরেক নাম; যখন সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে কেউ নতুনত্ব নিয়ে আসে তখন কিন্তু সেটা হবে ‘সৃষ্টিশীলতায় সৃষ্টিশীলতা’! সাহিত্যের প্রচলিত ধারাগুলো মেনে চলায় যেমন সৌন্দর্য বিদ্যমান, একইভাবে নতুন ধারা তৈরিতেও লুকিয়ে আছে নান্দনিকতা। আমি নিজে ছোট কবিতা লিখতে গিয়ে ভাবলাম এমন কোনও ধারায় লিখব যে ধারা বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে! সেই চিন্তা থেকেই একটি নতুন শব্দের সৃষ্টি করলাম যেটি হল ‘poetenry’ এবং এটি ইংরেজি শব্দ ‘poetry’ থেকেই এসেছে। সহজে বললে বলা যায়- poet + en + ry = poetenry বা দশপদী কবিতা। ২০১৪ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত আমার বই “Give Me a Sky to Fly”- এ ১৯৩ টি কবিতার প্রত্যেকটি ১০ লাইন করে। তাছাড়া ২০১৫ সালে “Poetenry: Poems of Ten Lines” নামে আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আসলে দশপদী কবিতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে- তাতে ৪ + ৪ + ২ = ১০ এই কাঠামো থাকতেই হবে। যদিও শব্দের সংখ্যা নিয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই তবে লাইনগুলো যত ছোট হয় ততই ভালো। পাশাপাশি অন্ত্যমিল থাকা আবশ্যিক। অন্ত্যমিলের বিন্যাস এভাবে হতে পারে- aabb, ccdd, ee অথবা abab, cdcd, ee, অথবা abcb, defe, gg, অথবা aabb, ccdd, dd ইত্যাদি।
পরিশেষে “পথের পাঁচালী”-র শেষ লাইন- ‘চল এগিয়ে যাই’- এর সুরে বলতে চাই- ছোট কবিতা তার আপন মহিমায় এগিয়ে যাক দূর থেকে দূরান্তরে, ছুঁয়ে যাক অগুনতি হৃদয়ের অন্তঃস্থল, বিমোহিত করুক প্রতিটি মুহূর্তে, জাগিয়ে তুলুক বিবেক মোদের, সর্বোপরি সমাজ পরিবর্তনের এক বলিষ্ঠ হাতিয়ার হয়ে উঠুক এই ছোট কবিতা! এই কামনায় ছোট কবিতা নিয়ে আমার লেখা একটি দশপদী কবিতা যেটির নাম দিয়েছি “ছোট কবিতা”:
ছোট কবিতা আকারে হলেও ছোট,
এর মর্যাদা আকাশের মত উঁচু, নয় খাটো,
ছোট কবিতা ছোট মুক্তার মত,
তবে তার মহিমা সর্বময় বিস্তৃত!
এমনই কালজয়ী ক্ষমতা একটি ছোট কবিতার,
একটি উপন্যাসও মানতে পারে হার,
আসলে শব্দের বাহারে নয়,
মর্মেই লেখা মৃত্যুঞ্জয়ী হয়!
ক্ষুদ্র হতেই বিশাল নেয় রূপ,
ক্ষুদ্র শিশির বিন্দুর মতই তার স্বরূপ!