[গ্রামের চেয়ারম্যান শিকদার আহমেদ ও তার চাকর মদন মঞ্চে প্রবেশ করে। চেয়ারম্যান একটি চেয়ারে বসেন। মদন তার পায়ের কাছে বসে আছে।]
চেয়ারম্যানঃ [মুচকি হেসে চাকর মদনকে বলেন] নদীর ধারের বিশাল বটবৃক্ষ কেটে বিক্রি করলে লাখ লাখ টাকা পাওয়া যাবে তাই না রে মদন?
মদনঃ [চেয়ারম্যানের পা টিপতে টিপতে বলে] জি হুজুর! একশত ভাগ খাঁটি কথাই বলেছেন! আপনি চেয়ারম্যান, আপনি চাইলে যে কোনো সময় বটগাছ কেটে ফেলতে পারেন।
চেয়ারম্যানঃ হুম, তা পারি, তবে গ্রামের মাস্টার শক্তি ইসলাম এটার বিপক্ষে কথা বলবে এ কথা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। এমনও হতে পারে যে গাছটি যেন না কাটা হয় সেজন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে আমার বিপক্ষে খেপিয়েও দিতে পারে!
মদনঃ তা আপনি মন্দ বলেন নাই চেয়ারম্যান সাহেব। তবে সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে।
চেয়ারম্যানঃ সমাধান? কি রকম?
মদনঃ সেই শক্তি মাস্টার যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে কয়েকজন মাস্তান পাঠিয়ে তাকে শায়েস্তা করে দিলেই হয়।
চেয়ারম্যানঃ দেখি কি করা যায়? অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
মদনঃ বেয়াদবি মাফ করলে একটা কথা বলতাম!
চেয়ারম্যানঃ বল।
মদনঃ আপনি যদি মানুষকে এই বলে বোঝান যে নদীর পার যেভাবে ভাঙছে, তাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বটগাছটি নদীর বুকে বিলীন হয়ে যাবে। তার আগেই যদি আপনি গাছটি কেটে সেটির কাঠ গ্রামের উন্নয়নের কাজে লাগানোর কথা বলেন, তাহলে সবাই খুব খুশিই হবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না!
চেয়ারম্যানঃ তোর কথায় যুক্তি আছে রে মদন! এক কাজ কর, তুই এক্ষুনি গিয়ে ফরিদকে আসতে বল। আমি আজ রাতেই গাছ কাটা শুরু করে দিতে চাই। এই গ্রামে ফরিদ ছাড়া এতো বড় গাছ কাটার কাজ আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। যা, জলদি যা!
মদনঃ কিন্তু, চেয়ারম্যান সাহেব, রাত ১২টায় গাছ কাটা শুরু করলেও রাতের মধ্যেই এত্ত বড় গাছ কাটা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ আছে!
চেয়ারম্যানঃ তোর কথা ঠিক। তবে সারারাত কাটতে থাকলে অন্তত অর্ধেক পর্যন্ত কাটা হবে এটা নিশ্চিত। সেটাও মন্দ নয়। বাকি অর্ধেকটা সকালে কাটবে।
মদনঃ দিনের আলোতে সবাই গাছ কাটা দেখলে বিভিন্ন কটু মন্তব্য করবে, বিশেষ করে শক্তি মাস্টারের কানে কথাটা যাবার সাথে সাথেই তিনি বেগুনের মতন ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠবেন, তখন কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবেন চেয়ারম্যান সাহেব?
চেয়ারম্যানঃ তুই এতো দুশ্চিন্তা করিস নাতো! ফরিদকে আসার খবর দেবার পর কালু গুন্ডাকে বলিস যে আমি সালাম জানিয়েছি। মনে থাকবেতো?
মদনঃ জি চেয়ারম্যান সাহেব, মনে থাকবে। আপনার অনুমতি নিয়ে আমি তাহলে আসি। আসসালামুয়ালাইকুম।
চেয়ারম্যানঃ ওয়ালাইকুমআসসালাম।
[মদন মঞ্চ ত্যাগ করে। একটু পর চেয়ারম্যানও মঞ্চ ত্যাগ করেন।]
[মদন ফরিদ এবং কালু গুণ্ডাকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে চেয়ারে বসে। একটু পর চেয়ারম্যান মঞ্চে প্রবেশ করেন।]
ফরিদ, মদন ও কালুঃ [চেয়ারম্যানের উদ্দেশে] আসসালামুয়ালাইকুম।
চেয়ারম্যানঃ ওয়ালাইকুমআসসালাম। ফরিদ, আজ রাতেই নদীর পারের বটগাছ কাটা শুরু করতে হবে, বুঝেছো?
ফরিদঃ আজ রাতেই চেয়ারম্যান সাহেব?
চেয়ারম্যানঃ হুম, আজ রাতেই, আর দেরী করা ঠিক হবে না। তুমি তাহলে এখুনি গিয়ে তোমার লোকজন ও যন্ত্রপাতি যোগাড় করে প্রস্তুত থাকো।
ফরিদঃ জি চেয়ারম্যান সাহেব, আসসালামুয়ালাইকুম।
চেয়ারম্যানঃ ওয়ালাইকুমআসসালাম।
[ফরিদ মঞ্চ ত্যাগ করে।]
চেয়ারম্যানঃ কালু!
কালুঃ জি চেয়ারম্যান সাহেব।
[চেয়ারম্যান হাতের ইশারায় কালুকে সামনে আসতে বলেন। তিনি কালুকে কানে কানে কি যেন বলেন। মদন কোনও কথা না বলে একটি ছোট লাঠি হাতে নিয়ে মাটিতে এলোমেলোভাবে কিছু একটা আঁকছে।]
চেয়ারম্যানঃ আমার কথা বুঝতে পেরেছোতো কালু?
কালুঃ জি চেয়ারম্যান সাহেব, সব পানির মতন পরিস্কার!
চেয়ারম্যানঃ তাহলে যাও, কাজে নেমে পড়ো!
কালুঃ জি চেয়ারম্যান সাহেব, আসসালামুয়ালাইকুম।
চেয়ারম্যানঃ ওয়ালাইকুমআসসালাম।
[রাত ১১:৩০ বাজে। ফরিদ তার দলবল নিয়ে বটগাছ কাটা শুরু করে দিয়েছে। কালু গুন্ডা ও তার সাগরেদরা শক্তি মাস্টারের হাত পা বেধে মঞ্চে নিয়ে আসে। মাস্টারের মুখে কাপড় আঁটা। তিনি কথাও বলতে পারছেন না।]
কালুঃ [শক্তি মাস্টারের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে বলে] মাস্টার! তোমার পাখা গজিয়েছে তাই না? উড়তে চাও?
শক্তিঃ আমি ভালো করেই জানি তোমাদের আসল নেতা কে। আমি এও জানি যে তোমরা নিশ্চয়ই গ্রামে কোনও বড় লুটপাটের কাজ শুরু করে দিয়েছো! তোমরা খুব ভালো করেই জানো যে আমি জানতে পারলে অবশ্যই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো। তাই প্রতিবাদ করার কোনও সুযোগ না দিতে আমাকে এভাবে অপহরণ করা হয়েছে। মনে রেখো, সত্যের জয় হবে নিশ্চয়! অন্যায়ের হাত দেখতে যত মজবুত হোক না কেন, সত্যের কঠোর আঘাতে সে চুরমার হবেই হবে!
কালুঃ [তার মাস্তান সাগরেদদের উদ্দেশে বলে] মাস্টারের সাহস দেখ! বাঘের খাঁচায় থেকেও তর্জন গর্জন করেই যাচ্ছে!
শক্তিঃ [পরিহাসের হাসি হেসে] তোমরা বাঘ! হাসালে আমায়! তোমরা হলে গিয়ে কদর্য কুকুরের পাল!
কালুঃ [রেগে গিয়ে মাস্টারের কলার চেপে ধরে] কি বললি? সাহস থাকলে আরেকবার বলতো?
শক্তিঃ তোরা সব কুকুরের চেয়েও অধম, নিকৃষ্ট!
[কালু ভীষণ রেগে গিয়ে মাস্টারকে এলোপাথাড়ি কিল আর ঘুষি মারতে থাকে। একপর্যায়ে মাস্টারের নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে থাকে।]
কালুঃ [ঘাবড়ে গিয়ে সাগরেদ বিধানকে বলে] কি রে, শালা মরেটরে গেলো নাতো?
বিধানঃ [মাস্টারের শ্বাস প্রশ্বাস পরীক্ষা করে ভয়ে বলে] ওস্তাদ! মাস্টার ফিনিশ!
কালুঃ এ্যা! কি বলছিস? মরে গেছে!
বিধানঃ হ, ওস্তাদ! মইরা গেছে!
কালুঃ [সাগরেদদের উদ্দেশে বলে] এই চল, চল, আর দেরী করা যাবে না! চল তাড়াতাড়ি পালাই! যা হবে পরে দেখা যাবে! চল!
[কালু তার পাঁচজন সাগরেদ নিয়ে দৌড়ে মঞ্চ ত্যাগ করে।]
[মঞ্চে পুলিশ প্রবেশ করেন। তারা মাস্টারের লাশের সামনে আসেন। গ্রামের কয়েকজন মানুষ এসে লাশটির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে জল।]
ওসি সাহেবঃ [দুইজন গ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন] আপনারা একটু কষ্ট করে লাশটা উঠিয়ে ঐ দূরে দাঁড়ানো এ্যাম্বুলেন্সে দিয়ে আসেনতো।
[দুইজন গ্রামবাসী লাশটি কাঁধে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এ্যাম্বুলেন্সের উদ্দেশে এগিয়ে যেতে যেতে মঞ্চ ত্যাগ করে। পুলিশরাও মঞ্চ ছেড়ে চলে যান।]
[বিধান হাঁপাতে হাঁপাতে ভীত হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। তার পেছনে কয়েকজন পুলিশ এসে তার ঘাড় ধরে। বিধান মঞ্চে পড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ে।]
ওসি সাহেবঃ [রেগে চিৎকার করে] হারামজাদা বল, মাস্টার সাহেবকে কে খুন করেছে?
বিধানঃ [কাঁদতে কাঁদতে বলে] আমি জানি না স্যার!
ওসি সাহেবঃ [রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তার পিঠে জোরে লাথি দিয়ে বলে] বল শালা!
বিধানঃ কালু গুণ্ডায় মারছে স্যার!
ওসি সাহেবঃ কালু গুন্ডা?
বিধানঃ হ স্যার!
ওসি সাহেবঃ সত্যি বলছিসতো? নাকি আসল খুনিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস বদমাইশ?
বিধানঃ [কাঁদতে কাঁদতে বলে] না, স্যার, হাছা কইতাছি! এক্কেরে ভগবানের কিড়া!
[পুলিশরা বিধানকে ধরে মঞ্চের বাইরে চলে যান।]
[হাঁপাতে হাঁপাতে কালু গুন্ডা মঞ্চে প্রবেশ করে। পুলিশ তার পেছনে এসে দাঁড়ান।]
ওসি সাহেবঃ কালু! তোর সাগরেদ বিধান আমাদেরকে সবকিছু টিয়া পাখির মতন বলে দিয়েছে। সুতরাং, তুই আর লুকোচুরি খেলার চেষ্টা না করে চুপচাপ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা বল, যদি কিছু লুকানোর চেষ্টা করিস তাহলে কিন্তু তোর হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবো।
কালুঃ স্যার, ঐ চেয়ারম্যান আমাকে বলেছিলো যে নদীর পারের বটগাছটি কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন আমি শক্তি মাস্টারকে আমার আস্তানায় বেধে রাখি। আমি সেই নির্দেশ মেনেই মাস্টারকে আমার আস্তানায় নিয়ে যাই ঠিকই তবে মাস্টার আমাকে ‘কুকুর’ বলে অপমান করায় আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। তখন আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তাকে বেদম প্রহার করায় তার মৃত্যু হয়। বিশ্বাস করুন স্যার, মাস্টারকে হত্যা করা আমাদের কারোই উদ্দেশ্য ছিল না। এটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়ে গেছে।
ওসি সাহেবঃ এভাবে গাছ কাটা অন্যায় এ কথা কি তোরা জানিস না? যেমন কর্ম তেমন ফল! পাপ বাপকেও ছাড়ে না! এবার আজীবন জেলে পচে গলে মরবি! আর ঐ চেয়ারম্যানও তোদের সাথে জেলের ঘানি টানবে!
[পুলিশ কালুকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন।]
[চেয়ারম্যান কাঁদো কাঁদো ভঙ্গীতে মঞ্চে প্রবেশ করে। তার হাত দড়ি দিয়ে বাধা। পুলিশ তার পেছনে দাঁড়িয়ে। চেয়ারম্যান কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ ত্যাগ করেন। পুলিশও তার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের বাইরে চলে যান।]
[সমাপ্ত]