গ্রামের নাম সর্পনগর! গ্রামটির এমন অদ্ভুত নামকরণের পেছনের ইতিহাস সবারই জানা। একসময় প্রচুর বিষাক্ত সাপের বাস ছিল এই গ্রামে। সেই থেকেই গ্রামের নাম সর্পনগর হয়ে গেলো।
এখনও অনেক মারাত্মকরকম বিষাক্ত সাপের দেখা প্রায় প্রতিদিনই মেলে। তাইতো গ্রামে সাপের সংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে গাণিতিক হারে ওঝার সংখ্যাও বেড়েছে। ওঝার সংখ্যা এতোটাই বেড়েছে যে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে একজন করে ওঝা আছে!
এই ওঝাদের কাজ হচ্ছে মূলত সাপে কাটা রোগীদেরকে নানান ঔষধ জড়ি বুটি দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা এবং বিষাক্ত সাপ ধরে সেগুলোর বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে ও পোষ মানিয়ে অন্যান্য গ্রামে-গঞ্জে সাপের খেলা দেখিয়ে দুপয়সা উপার্জন করা। অবশ্য এই আধুনিক যুগে ওঝাদের পেশা বিপন্নপ্রায়। ইতোমধ্যে অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। কেউ ট্যাক্সি চালাচ্ছে, কেউ বা দোকান দিয়েছে ইত্যাদি।
যাইহোক, সর্পনগর গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত ওঝা হচ্ছেন জগলু মিয়া। লোকে তাকে ভালোবেসে এবং শ্রদ্ধাভরে নাম দিয়েছে ‘সর্পরাজ’ অর্থাৎ সাপেদের রাজা। তিনি যেভাবে খুব দ্রুত যে কোনও সাপকে বশে আনতে পারেন সেরকম আর কোনও ওঝাই পারে না!
একদিন সর্পরাজ পার্শ্ববর্তী গ্রাম মোহনপুরে যান। সেখানে তার চাচাতো ভাই হুমায়ূন মিয়ার বাসায় গিয়ে উঠেন। বাড়ির সামনেই পুকুর; পুকুরটির পানি এতোটাই স্বচ্ছ যেন সমুদ্রের পানি! মাঝে মাঝে সুমিষ্ট হাওয়ায় দু একটা গাছের পাতা উড়ে এসে পুকুরের জলে পড়ছে; দেখে মনে হয় যেন পাতাগুলো গোসল করতে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে যেমন করে দুষ্টু বাচ্চারা পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ থেকে ঝুপ করে গিয়ে পুকুরে পড়ে অনেকটা সেরকম!
সর্পরাজ গোসল শেষে গায়ের ভেজা গামছা এবং লুঙ্গিটি কাছেই ঝুলতে থাকা দড়িতে শুকাতে দেন। বিকেলের দিকে বাড়ির উঠোনে পায়চারী করতে এসে সর্পরাজের চোখ গিয়ে পড়ে সেই গামছার উপর। গামছাটি গোসল করার পর যেমনটা ভেজা ছিল, এখনও ঠিক তেমনি আছে! একটুও শুকায়নি! অন্যদিকে লুঙ্গিটি শুকিয়ে খসখসে কাগজের মতন দেখাচ্ছে!
সর্পরাজ চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু মন্ত্র আওড়াতে থাকেন। ঠিক তখন তার চাচাতো ভাই হুমায়ূন সেখানে আসে। সর্পরাজের মন্ত্রপাঠ শেষ হলে হুমায়ূন তাকে প্রশ্ন করে,
- কিসের মন্ত্র পড়ছো ভাই?
- তোদের এই এলাকায় কি কাউকে সাপে কেটেছে?
- হ্যাঁ, গত পরশু দিন এক চল্লিশ বছর বয়সী এক মহিলাকে সাপে কেটেছিল।
- মহিলা কি হিন্দু না মুসলমান?
- মুসলমান। তার নাম আসিয়া বেগম। নিয়মমাফিক জানাজাও হলো। জামে মসজিদের পাশেই যে কবরস্থান আছে না, সেখানেই তাকে কবর দেয়া হয়। ভাই, তুমি কি করে বুঝলে যে কাউকে সাপে কেটেছে কি না?
- এসব কথা থাক।
রাত দুইটার দিকে সর্পরাজ একা সেই মহিলার কবর খুঁড়ে আসিয়ার দেহটি বাইরে নিয়ে আসেন। যদিও আসিয়াকে অনেক আগেই দাফন করা হয়েছিল তবুও তার দেহ একেবারে সতেজ আছে! দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত একজন মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! যেন একটু শব্দেই চোখ মেলে তাকাবে! শরীরের কোথাও কোনও কীটপতঙ্গের কামড়ের দাগ নেই!
সর্পরাজ খুব সতর্কতার সাথে আসিয়ার পায়ের পাতা পরীক্ষা করতে থাকেন। তিনি সাপের বিষাক্ত দাঁতের কামড় দেখতে পান। তিনি তার নিজের মুখে সেখান থেকে একটু একটু করে বিষ চুষে মাটিতে ফেলতে থাকেন। একপর্যায়ে মৃত আসিয়া চোখ মেলে তাকায়! চারিদিকে আলকাতরার মত ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার। সেই অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে সে সামনে বসে থাকা ওঝার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। দেহের নীচে শীতল মাটি এবং ঘাস অনুভব করার পর আসিয়া বুঝতে পারে যে সে তার ঘরের বিছানায় নয়, বাইরে শুয়ে আছে!
মুহূর্তেই আসিয়ার মাথায় ভূতের চিন্তা আসে এবং সে প্রচণ্ড আতংকে চিৎকার দিতে চেষ্টা করলে সর্পরাজ তার মুখে হাত রেখে বলেন,
- ভয় পেয়ো না মেয়ে! আমি তোমার বন্ধু, আমি তোমার কোনও ক্ষতি করবো না।
- কে আপনি? এতো রাতে আমি এখানে কেন?
- তোমাকে সাপে কেটেছিল। তোমার আত্মীয়স্বজন ভাবলেন যে তোমার মৃত্যু হয়েছে। আসলে তোমার দেহে তখনও প্রাণের স্পন্দন ছিল। গতকাল একটি ঘটনায় আমি সেটা অনুভব করতে পেরেছিলাম বলেই তোমার ব্যাপারে জানতে পারলাম। তাই আর কালক্ষেপণ না করে তোমাকে রক্ষা করতে এলাম।
- আপনি কে? আপনার নাম কি?
- আমার পরিচয় না হয় কাল তোমার বাসায় এসে দেবো। আর দেরী না করে তোমার ঘরে যাও।
- ঠিক আছে, আপনি যেমনটি চান তেমনটিই হবে। আপনি মহান, আপনি দয়াময়!
- এসব বলে আমাকে লজ্জিত না করে এক্ষুনি বাসায় চলে যাও।
রাত সাড়ে তিনটার দিকে আসিয়া তার ঘরের দরজায় আঘাত করতে থাকে। তার স্বামী খালেক আহমেদ এতো রাতে মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আঁতকে উঠে। তার ভয় হয় এই ভেবে যে কেউ মারা গেলো নাতো! দরজার কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
- কে?
- আমিগো, তোমার স্ত্রী আসিয়া!
- আসিয়া?
- হ্যাঁ! দরজাটা খোলো তাড়াতাড়ি!
- সত্যি করে বলো তুমি কে?
- আরে বাবা বলেছিতো আমি আসিয়া!
- হতেই পারে না! তাকে আমি নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়েছি! তুমি এক্ষুনি এখান থেকে দূর হও, তা না হলে কিন্তু খুব খারাপ হবে!
- আচ্ছা, তুমি কি আমার গলার আওয়াজ চিনতে পারছো না?
- গলার আওয়াজ মিল আছে ঠিকই তবে তুমি কোনও ভাবেই আমার আসিয়া হতে পারো না কারণ সেতো মারা গেছে!
- আরে বাবা! বিশ্বাস করো আমিই তোমার স্ত্রী আসিয়া!
- আচ্ছা, ঠিক আছে, একটু পড়ে দরজা খুলছি!
ভয়ে খালেকের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। সে তার ছোট ভাই আনিসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে পুরো বিষয়টি জানালে আনিসের সন্দেহ হয় যে নিশ্চয়ই আসিয়ার নাম করে কোনও ডাকাতের দল আশেপাশে ঘাপটি মেরে আছে। নিশ্চয়ই দরজা খোলার সাথে সাথেই তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করবে!
তবে আনিসের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। প্ল্যানটা এমন যে খালেক দরজা খুলবে এবং আনিস কোদাল দিয়ে সেই কথিত আসিয়া নামক মহিলার মাথায় আঘাত করে দরজা বন্ধ করে দেবে। এতে করে ডাকাতরা তাদের আহত সদস্যকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খালেক অতি সাবধানে দরজা খোলে। আনিস লুকিয়ে থাকা বাঘের মতন কোদাল হাতে আসিয়ার হাতে বজ্রের মতন আঘাত হানে। সাথে সাথে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আসিয়া ধপ করে মাটিতে পড়ে যায় ঠিক যেমন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছটি ধপাস করে নদীতে পড়ে যায় অনেকটা তেমন।
সকালের আলো ফুটলে খালেক দরজা খুলে। সে ভেবেছিল যে গত রাতের প্রাণঘাতী আঘাতের ফলে দরজার সামনে লাল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ থাকবে কিন্তু সেখানে রক্তের পাশাপাশি একটি মহিলার নিথর দেহও পড়ে থাকতে দেখা যায়। মহিলার মুখ নীচের দিকে হওয়াতে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। খালেক ধীরে ধীরে মহিলার দেহ সরালে আসিয়ার রক্তাক্ত মুখটি আকাশের মেঘের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠে!