আকবর মিয়া মুক্তিযুদ্ধে স্প্লিন্টারের আঘাতে দু চোখ হারিয়ে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। যদিও তার স্ত্রী রেহনুমা বেগম দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই তার অন্ধ স্বামীর সেবায় ছায়ার মতন পাশে থাকেন, আকবরের কিন্তু ভালো লাগে না। তিনি এই সুন্দর পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে তার মন খারাপ নয়, সে দুঃখী কারণ অন্যদের কাছে তার নিজেকে একটা পাথরের মতন বোঝা মনে হয়। তিনি নিজে কোনও কাজ করতে পারেন না বললেই চলে; এ কারণে আকবর নিজের উপরই বীতশ্রদ্ধ।
হতাশা মাকড়শার জালের মতন যেন সবসময় তার মনোজগতে বিচরণ করে চলেছে। এ জীবন তার আর ভালো লাগে না। কতবার যে আত্মহত্যা করার জন্য মনঃস্থির করেছে তার হিসেব নেই! একবার তো স্ব ইচ্ছায় এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার জন্য একা একা অনেক কষ্টে রেল লাইনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ট্রেন আসার শব্দ কানে আসে; আকবর প্যাঁচার মতন সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পান। মৃত্যুর ভয় তার কখনই ছিল না; এখনও নেই। মুক্তিযুদ্ধে কতবার যে মরতে মরতে প্রাণ বেঁচেছে তার ইয়ত্তা নেই! যাইহোক, আকবর মনে মনে ভাবেন যে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের হাতে মারা গেলে তিনি বীরের মর্যাদা পেতেন কিন্তু এভাবে চোরের মতন লুকিয়ে নিজেকে নিজে হত্যা করার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই, নেই কোনও সম্মান! তবুও আকবর আত্মহত্যা করতে চান। তিনি ভাবেন যে এভাবে এতোটা অসহায় হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। এখন মৃত্যুই তার কাছে মুক্তির সমান!
আকবর স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতন সটান হয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ট্রেন খুব দ্রুততার সাথে ছুটে আসছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মৃত্যু অনিবার্য জেনে আকবর মনে মনে আল্লাহ্র নাম জপতে থাকেন। পরক্ষণেই তার স্ত্রী রেহনুমার কথা ভাবেন। ট্রেন চলে যায়; আকবর যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেভাবেই দাঁড়ানো! ট্রেন চলে যাবার পরও তার কিছুই হয়নি কেন এ কথা ভেবে ভেবে সে হয়রান! আসলে সেখানে ট্রেন যাবার দুটি লাইন ছিল; আকবর যে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেনটি সেই লাইন দিয়ে যাচ্ছিল না, অন্যটা দিয়ে যাচ্ছিল!
এমন আশ্চর্য অভিজ্ঞতার পর আকবর হাসবে নাকি কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না! তার এ ধারণা হয় যে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা চান না যে তার মৃত্যু হোক! তিনি আর কালক্ষেপণ না করে বাসার দিকে ফিরে যেতে উদ্যত হন। যথারীতি অনেক চড়াই উতরাই পার করে তিনি ঘরে ফিরে আসেন।
আকবরকে দেখে রেহনুমা অস্থির হয়ে ছুটে এসে তাকে জিজ্ঞেস করেন,
- তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
- ছিলাম আশেপাশে।
- কোথায় যাচ্ছ একটিবার কি আমাকে বলে যাওয়া যায় না?
- এতো দুশ্চিন্তা করো কেন? আমি কি বাচ্চা?
- এ অবস্থায় একা একা ঘরের বাইরে গেলে বিপদ হতে পারে তা কি তুমি বোঝো না?
- তুমি এসব কথা বলে বারবার আমার অসহায়ত্বকে মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দাও কেন বলো তো?
- আমি ওটা ভেবে কথাটা বলিনি। আমি তোমার চিন্তায় অস্থির ছিলাম। ইতোমধ্যে আশেপাশের কয়েকটি বাসায় গিয়েও তোমার খোঁজ করেছি, কিন্তু তোমার কোনও খবর পাইনি। এমনকি প্রতিবেশী জয়নাল ভাইকেও বলেছি তিনি যেন হাটে গিয়ে একবার খোঁজ করে দেখেন।
- এখনতো আমি সহি সালামতে ফিরে এসেছি, খুশী তো?
- আর কখনও একা একা ঘরের বাইরে যাবা না!
- আচ্ছা যাবো না।
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতন একটি অসাধারণ খবর যে আকবর এবং রেহনুমার জন্য অপেক্ষা করছে তা হয়তো তাদের ধারণার বাইরেই ছিল! একদিন রেহনুমার চাচাতো ভাই রুবেল আহমেদ এসে উপস্থিত। বলাই বাহুল্য যে আকবর এবং রেহনুমা দুজনই তার আগমনে আনন্দিত হয়েছেন।
রুবেল ঢাকায় ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কাটার কাজ করে। প্রায় প্রতিদিন লাশ কাটাকুটি করাই তার পেশা। রেহনুমা তাকে বসার জন্য একটি চেয়ার দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
- তুমি এসেছো আমরা খুব খুশী হয়েছি!
- আমারও অনেক ভালো লাগছে আপনাদেরকে এতদিন পরে দেখতে পেয়ে।
- তা তোমার কাজকর্ম কেমন চলছে? এখনও কি সেই আগের কাজটাই করছো নাকি অন্য কাজে নিয়োজিত হয়েছো?
- সেই আগের কাজ! নতুন কাজ খোঁজার অনেক চেষ্টা করেও কোনও লাভ হয়নি। মনে হয় লাশ কাটতে কাটতেই জীবনটা পার হয়ে যাবে!
- কিভাবে যে তুমি এই কাজ করো বাবা, ভয় লাগে না?
- প্রথম প্রথম লাশ দেখে ভয়ে শরীর বরফের মতন ঠাণ্ডা হয়ে যেত, এখন আর তেমন কোনও অনুভূতি কাজ করে না! আমরা মানুষরাতো অভ্যাসের দাস, তাই না! সবই অভ্যাস হয়ে গেছে!
- তা অবশ্য ঠিকই বলেছো।
- আমি অবশ্য এমনি ঘুরতে আসিনি, একটি বিশেষ কাজে এসেছি।
- কি কাজ শুনি?
- আমি এসেছি একটা সুখবর দিতে!
- সুখবর!
- হ্যাঁ, আমার সাথে দয়া নামে একজন লোক লাশ কাটার কাজ করতো, তার এক জটিল রোগ ছিল। তার ডাক্তার বলেছেন যে সে আর বেশীদিন বাঁচবে না। একদিন কথা প্রসঙ্গে তাকে আমি আকবর সাহেবের অন্ধত্বের কথা বলি। তার নাম যেমন দয়া, তার মনটাও দয়ার সাগর! সে এ কথা শোনা মাত্রই তার মৃত্যুর পর দুই চোখ আকবর সাহেবকে দান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রথমে আমি বিষয়টিকে নিতান্তই মশকরা হিসেবে ভাবি, কিন্তু পরদিন সে কোত্থেকে একজন ডাক্তারকে এনে আমার সামনে কি সব চুক্তিনামা এবং কাগজে স্বাক্ষর করলে আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে দয়া চক্ষু দান করার ব্যাপারে রীতিমত সিরিয়াস!
- বলো কি?
- হ্যাঁ, আমি একশো ভাগ সত্যি কথাই বলছি!
- দুনিয়ায় এমন মানুষও আছে নাকি? এতো মানুষ নয়, ফেরেশতা!
- ফেরেশতাই বটে!
- পরে কি হলো?
- পরে ডাক্তার সাহেব বিদায় নেবার সময় আমাকে বলেন যে দয়ার মৃত্যুর পর আর কোনও সময় নষ্ট না করে যেন আমি আকবর সাহেবকে ঢাকায় নিয়ে যাই। সেখানেই অপারেশন করে দয়ার চোখ তার চোখে বসানো হবে।
- হে আল্লাহ্! তুমি মহান! তুমি অসীম দয়ালু!
- আসলেই সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা!
এতক্ষণ আকবর এক কোণায় বসে মনিষীর মতন রেহনুমা এবং রুবেলের কথা শুনছিলেন। তিনি আনন্দে এতোটাই আপ্লুত হয়ে গেছেন যে মুখ ফুটে একটি শব্দও বলতে পারছেন না! আবেগের বসে তিনি প্রায় কেঁদেই ফেলেন।
দুই মাস পর দয়া মারা যায়; অত্যন্ত সফলতার সাথে তার চোখ দুটো আকবরের অক্ষিগোটরে স্থাপিত হয়। যেদিন আকবরের চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে, সেদিন তার স্ত্রীসহ অন্য আত্মীয় স্বজনরা খুশীতে তার চারপাশে মৌমাছির মতন অবস্থান নেয়। যথাসময়ে ডাক্তার সাহেব বেশ সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেন।
আকবর আস্তে আস্তে চোখ খুলে তার চারপাশে শুধু লাশ দেখতে পান! তিনি ভয়ে চোখ বন্ধ করে আবারও খুলেন। এখনও তিনি সেই আগের মতই লাশ দেখতে পান!