১৯৯৩ সালের এক অলস দুপুরবেলা। শাহানা এক বিয়ের দাওয়াতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বড় মেয়ে আন্নি এবং ছোট ছেলে রাতুল ঘরেই থাকবে। রাতুলের খুব ইচ্ছে ছিল যে সেও মায়ের সাথে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাবে। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরের কারণে শাহানা তাকে বিশ্রাম নিতে বলে।
উত্তপ্ত আগুনে ডেকচি যেমন গরম হয়ে উঠে, রাতুলের সমস্ত শরীরও তেমন উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যখন শাহানা চলে যাবার আগে রাতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তখন সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে! ছেলের এমন অকস্মাৎ কান্নায় মায়ের মন মোমের মতন গলে যায়। তার চোখেও জল জমে। শাহানা রাতুলকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বলে,
- কি রে পাগল! কাঁদছিস কেন?
- কিছু না!
- কিছু না মানে?
- বললাম তো কিছু না!
- আচ্ছা, আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি?
- না!
- তাহলে এমনভাবে কাঁদছিস কেন?
- আচ্ছা যাও, তোমার দেরী হচ্ছে নিশ্চয়ই!
- ও বুঝেছি! তুই সাথে যেতে পারছিস না বলে কাঁদছিস, তাই না?
- না!
- ঠিক তাই!
- ঠিক তাই নয়!
- তুই না বললে কি হবে, আমিতো মা, আমি বুঝি!
- বুঝলেতো ভালোই!
- আচ্ছা বল, আসার সময় তোর জন্য কি আনবো?
- কিছু আনতে হবে না!
- আচ্ছা বল না কি আনবো? চকলেট আনবো নাকি?
- না!
- তাহলে কি খাবি? কিছু একটা বল!
- বিয়ে বাড়ির খাবার নিয়ে এসো!
- বিয়ে বাড়ির খাবার আমি আনবো কি করে?
- কেন, তোমার ব্যাগে করে!
- আমার ব্যাগে ঝোল লেগে নষ্ট হয়ে যাবে না?
- তাহলে ব্যাগে করে একটা পলিথিন নিয়ে যাও! খাবার সময় মজার মজার খাবারগুলো কয়েকটা ঐ পলিথিনে ঢুকিয়ে ফেলবে!
- মানুষ দেখলে কি বলবে?
- দেখবে না! এমনভাবে পলিথিনে রাখবে যাতে কেউ টের না পায়!
- আচ্ছা, দেখি কি করা যায়? তবে আমি যে আনবোই সে কথা দিতে পারছি না!
- চেষ্টা করলে আনতে পারবে, আর যদি না পারো সমস্যা নেই!
- আচ্ছা, এবার তুই একটু চুপ করে বিশ্রাম নে। তোর বোন আন্নি ঘরেই থাকবে। যদি কিছু লাগে আপুকে বলবি, ঠিক আছে? আমি যাবো আর আসবো!
- আচ্ছা, মা, ঠিক আছে। তুমি চিন্তা করো না।
- আল্লাহ্ হাফেজ!
- আল্লাহ্ হাফেজ!
শাহানা বিয়ে বাড়িতে খাবার খেতে বসে নিজের খাওয়ার দিকে কোনও মনোযোগ দিতে পারেন না। তার সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঘরে অসুস্থ রাতুল এবং তার সাধের মজার মজার খাবার! মা ঈগলের মতন শাহানা মুখে একটু খাবার নেন, আর এদিক ওদিক তাকান; যখনই টেবিলে বসা অন্যান্য মহিলারা নিজ নিজ প্লেটের দিকে মাথা নিচু করে খেতে থাকে, ঠিক তখনই শাহানা নিজের প্লেট থেকে মুরগীর রান, বিফ টিক্কা ইত্যাদি একটু একটু করে পলিথিনের ব্যাগে রাখে।
একসাথে অনেক খাবার রাখতে গেলে কেউ না কেউ দেখে ফেলবে বলে একটু পরপর রাখে। যাইহোক, খাওয়া শেষ হলে শাহানা হাতমুখ ধুয়ে ঘরের উদ্দেশে রওনা হয়। শাহানা যতই ঘরের নিকটবর্তী হয়, ততই তার কানে কান্নার ভারী শব্দ এসে লাগে। রাতুলের জন্য পলিথিনে করে সুস্বাদু খাবার আনতে পারার আনন্দ মুহূর্তেই সন্ধ্যায় চুপসে যাওয়া ফুলের মত হয়ে যায়।
এক অজানা শঙ্কায় শাহানার হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যাবার যোগাড়! তার ঘরের ভেতরে এবং বাহিরে কেবল মানুষ আর মানুষ! সবাই কাঁদছে, যেন আজ পৃথিবীর সকল মানুষ কেঁদে কেঁদে মনের কষ্ট দূর করছে!
শাহানা অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখে যে খাটের উপর একটি লাশের উপর কাফনের কাপড় রাখা! সে বিদ্যুতের গতিতে দৌড়ে গিয়ে সেই কাফন সরাতেই দেখে তার আদরের ছেলে রাতুল ফ্যাঁকাসে পাথরের টুকরার মতন পড়ে আছে! শাহানার বুকে কষ্টের হিমালয়; সে কাঁদতে চায় কিন্তু তার চোখে জল নেই! মায়ায় আচ্ছন্ন মানুষের মতন শাহানা তার মৃত ছেলের লাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে!