সমাজের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে যা মানুষ মেনে চলবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটলেই বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা দেয়!
‘বিয়ে’ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের সমাজে পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়াটাই কাম্য। অর্থাৎ বাবা মার পছন্দ অনুযায়ী ছেলে মেয়ে তাদের জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনী বেছে নেবে এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর উল্টোটা হলেই নানান আপদের জন্ম হয়। যেমন কোনও ছেলে এবং মেয়ে যদি প্রেমে পড়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে বিয়ে যদি করতেই হয়, তবে একে অন্যকে করবে, তখনই বেশীরভাগ বাবা মায়ের ঘুম হারাম হয়ে যায়!
এই গল্পে ঠিক এমনই এক প্রেমিক জুটির কথা বলবো যারা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছে এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছে। টিয়া হায়াত এবং খালেদ হোসেন দুজনই মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। তারা একে অন্যকে পাগলের মতন ভালোবাসে। যেন সাক্ষাত লাইলী আর মজনু!
টিয়ার বাবা নেই। তার মা মমতা হায়াত একটি স্কুলের শিক্ষিকা। টিয়া যখন অনার্সে ভর্তি হয়, তখন থেকেই মমতা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু টিয়াও কম যায় না! সে বিভিন্ন টালবাহানা করে বিয়ে থেকে একশ হাত দূরে থাকে!
যাইহোক, অনার্সের পর্ব চুকিয়ে মাস্টার্সে পা দিতে না দিতেই খালেদ কিভাবে কিভাবে যেন টিয়াকে তার প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে! দক্ষ লোক পুকুরে জাল ফেলে যেমন ঠিক ঠিক বড় মাছ ধরে ফেলে অনেকটা তেমন!
একপর্যায়ে মাস্টার্স শেষ হয়ে যায়; ফলাফল বের হয়, টিয়া এবং খালেদ ভালো চাকরী পেয়ে যায়। একদিন মমতা টিয়াকে বলে,
- কি রে, তুই কি বিয়ে করবি না বলে ঠিক করেছিস নাকি?
- আমি কি তাই বলেছি মা?
- তোর হাবভাবে তো তাই মনে হয়!
- তোমার ভুল মনে হয় মা!
- এখনই বিয়ে না করলে পরে তো কপালে বর জুটবে না!
- কি যে বলো না মা? দেশে বরের আকাল পড়েছে নাকি?
- আকাল পড়েনি ঠিকই, তবে শেষমেশ হয়তো কোনও ল্যাংড়া কিংবা কানার সাথে বিয়ে বসতে হবে দেখিস!
- তোমার এই কথাটা মানতে পারছি না মা।
- আচ্ছা, সত্যি করে বলতো, তোর পছন্দের কেউ কি আছে?
- হ্যাঁ আছে।
- কি নাম, কি করে?
- নাম খালেদ, ব্যাংকে চাকরী করে। ভালো বেতন পায়।
- তাহলে বল, তার মা বাবার সাথে কথা বলি।
- সমস্যাতো এখানেই মা, তার মা বাবা চান তাদের পছন্দমত মেয়ের সাথেই ছেলের বিয়ে হবে। ছেলের পছন্দ ফেলে দেয়া কাগজের মতই মূল্যহীন তাদের কাছে।
- কি বলিস?
- সত্যি বলছি মা।
- আমি একবার খালেদের মার সাথে কথা বলে দেখবো নাকি?
- কোনও লাভ নেই মা!
- তাহলে সমাধান কি হবে?
- সমাধান একটাই মা!
- কি?
- আমরা পালিয়ে বিয়ে করবো!
- তুই কি আমার সাথে মশকরা করছিস নাকি?
- না মা, আমি সত্যিই বলছি। আমরা মনে মনে এমনটাই ঠিক করে রেখেছি।
- এভাবে বিয়ে করলে সমাজের লোকে কি বলবে? তাছাড়া তুই আমার কথা কি একবারও ভাববি না? মানুষ আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলবে, “ঐ যে পালিয়ে বিয়ে করা মেয়ের মা যাচ্ছে!” তুই কি তাই চাস?
- তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি মা। কিন্তু আমি খালেদকে কথা দিয়েছি। তাছাড়া আমি খালেদকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামীর আসনে বসাতে পারবো না।
খালেদ জানে যে বাবা মার কাছে টিয়ার কথা বলা আর হাতির সামনে কবিতা পাঠ করা একই কথা! তারপরও বুকে এক সাগর সাহস নিয়ে বাবা এখলাস আহমেদকে বিষয়টি বলে। বাবা শোনার সাথে সাথে রাগে এমনভাবে লাফিয়ে উঠেন যেন কোনও সিংহ প্রচণ্ড ক্রোধে বহিরাগত কোনও সিংহকে আক্রমণ করছে! খালেদ বলে,
- টিয়া খুব ভালো মেয়ে বাবা! সে খুব ভালো একটি চাকরীও পেয়েছে। বউ হিসেবে সে খুব লক্ষ্মী হবে।
- তোমার মুখ থেকে এসব কথা আমি আর দ্বিতীয়বার শুনতে চাই না। যদি আমাদের পছন্দমত মেয়েকে বিয়ে করো তবে তোমার জন্য ভালো, আর যদি এর বিরোধিতা করো, তবে তোমাকে এই ঘর ছাড়তে হবে! The choice is yours!
“The choice is yours!” বাবার মুখ থেকে বের হওয়া এই ছোট বাক্যটি খালেদের হৃদয়ে বুলেটের মতন আঘাত করে! সে আর কোনও কথা না বাড়িয়ে পরাজিত খেলোয়াড়ের মত মাথা নিচু করে বের হয়ে যায়। সেই যে বের হয়, সে আর ঘরে ফেরে না! টিয়াকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করে; ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া করে নিজেরা সংসার শুরু করে। ওথেলো যেমন ডেসডিমোনাকে পালিয়ে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছিল ঠিক তেমন।
পাড়া প্রতিবেশী নানান কুৎসা রটায়, তাদের বিয়ে নিয়ে কটূক্তি করে, কিন্তু টিয়া এবং খালেদ এসবে মোটেও পাত্তা দেয় না কারণ তারা খুব ভালো করেই জানে যে তারা যেখানেই যাক না কেন এরকম কিছু মানুষ জোঁকের মত লেগে থাকবেই! এসব নিয়ে ভেবে ভেবে নিজের মন খারাপ করার চেয়ে কাজে মনোযোগ দিলে সময় বাঁচবে এবং স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।
টিয়া মাঝে মাঝে তার মাকে দেখতে যায়। যখনই দেখা হয়, মমতা তার মেয়েকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। মায়ের কান্না দেখে টিয়ার চোখও জলে ভিজে যায়। তবে টিয়া ও খালেদের সুখী দাম্পত্য জীবনের গল্প শুনে মায়ের মন আনন্দে ভরে উঠে।