টারজানকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জঙ্গলের আশেপাশে যাদের বসবাস ছিল তারা অনেক দিন ধরেই টারজানের সেই বিখ্যাত “ও ও ও ও ও” ডাকটি শুনতে পায় না! কেউ টারজানের এমন অকস্মাৎ ভূতের মতন উধাও হয়ে যাবার পেছনের কারণটি বের করতে পারছে না। এ ব্যাপারে সবাই অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েই চলেছে। কেউ বলছে, “মনে হয় টারজান মারা গেছে”, কেউ বলছে, “মনে হয় সে অন্য কোনও জঙ্গলে চলে গেছে!”
যাইহোক, টারজানের এভাবে গায়েব হয়ে যাবার মূল কারণটি হচ্ছে কিছু স্বার্থপর এবং লোভী মানুষের বিকৃত মানসিকতা। আগে যে জঙ্গলে শুধুমাত্র সবুজ গাছগাছালির মেলা দেখা যেত, এখন সেখানে গাছের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় মরুভূমির মত অবস্থা হয়েছে।
মানুষরূপী কিছু শয়তান দিনে রাতে অবৈধভাবে গাছ কাটে এবং শহরে বহু মূল্যে বিক্রি করে নিজের পকেট ভারী করে। প্রকৃতি ধ্বংস হোক, তাতে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। গাছপালা আলোর গতিতে কমার সাথে সাথে জঙ্গলের পশুপাখীও শান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ধীরে ধীরে অন্যত্র সরে যাচ্ছে।
যে জঙ্গল একসময় স্বর্গের বাগানের মত ছিল, দিনরাত পশুপাখীদের নির্ভীক বিচরণ ছিল, সৃষ্টিকর্তা যে জঙ্গলটিকে পরম আদরে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন, সেই বন পাথরের মত তিলে তিলে ক্ষয় নয়, হায়েনার মত নিষ্ঠুর, লোভী এবং বিবেকহীন কিছু অমানুষের কারণে এভাবে চোখের পলকে জাদুর মত হাওয়া হয়ে যাচ্ছে দেখে টারজান আর সহ্য করতে না পেরে নিজেতো চলে গেছেই, তবে যাবার আগে তার অতি আদরের এবং প্রিয় হাতি, টিয়া, বানর, বাঘ ইত্যাদি পশুদেরও বলেছে তারাও যেন তাদের প্রাণপ্রিয় বাসভূমি নরকে পরিণত হবার আগে অন্য কোনও বনে চলে যায়। নতুবা লোভীর চোখ যদি তাদের উপর পড়ে তবে গাছগাছালীর মত তাদেরকেও খাঁচায় ভরে বিক্রি করে দেয়া হবে। তখন হয়তো তাদেরকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হবে নতুবা দেশ বিদেশের কোনও নোংরা চিড়িয়াখানায় বন্দী থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। টারজান সবার উদ্দেশে বলে,
- আজ আমি বাধ্য হয়ে তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। অনুগ্রহ করে তোমরা আমাকে স্বার্থপর ভেবো না। আমি কতটুকু কষ্ট নিয়ে যাচ্ছি তা তোমাদেরকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি এও বুঝি যে তোমাদেরও খুব কষ্ট হচ্ছে আমাকে এভাবে চলে যেতে দেখে।
- টারজান তুমি যেও না! হাতি তার লম্বা সুর তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে।
- আমাকে যে যেতেই হবে সাথী। পাশাপাশি আমি চাই তোমরাও যত দ্রুত সম্ভব এই বন ছেড়ে অন্য কোনও নিরাপদ স্থানে চলে যাও। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না মানুষরূপী শয়তানগুলো কিভাবে দিনদিন পত্রপল্লবে ঢাকা অরণ্যকে যুদ্ধের পরের ভূমির মতন করে দিচ্ছে? সময় থাকতে সবাই পালাও; নিজের জীবন বাঁচাও বন্ধুরা!
- কিন্তু আমাদের এই প্রিয় বাসভূমি ছেড়ে আমরা কোথায় যাবো? ক্রন্দনরত টিয়া পাখী বলে।
- যেতে যে হবে বন্ধু! তা না হলে গাছ বিক্রির সাথে সাথে তোমাদেরকেও ধরে বিক্রি করে দেয়া হবে। তাই বলছি, যত দ্রুত সম্ভব কোনও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নাও!
- তোমার সাথে কি আমাদের আর কক্ষনো দেখা হবে না বন্ধু? ময়না পাখী কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে।
- জানি না বন্ধু! হয়তো হবে, হয়তো না! এবার আমায় যেতে হবে। ভালো থেকো বন্ধুরা! বিদায়!
- বিদায় বন্ধু! তুমিও যেখানেই থাকো, ভালো থেকো! সব পশুপাখী সমস্বরে বলে।
পশুপাখীদের প্রাণপ্রিয় টারজান যখন তাদেরকে এই বাসভূমি ছেড়ে চলে যেতে বলছে, তখন তারা তার কথায় সায় না দিয়ে আর পারে না। কারণ টারজানের মতন এমন শুভাকাঙ্ক্ষী তারা আর কখনও দেখেনি। বিদায়ের ক্ষণে টারজানের বুকটা গ্রীষ্মের ক্ষেতের মতন ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তার নয়ন জোড়া অবারিত কান্নার ঝরনায় পরিণত হয়।
বনের সকল পশুপাখী তাকে সাদরে বিদায় জানিয়ে নিজেরাও ক্রমান্বয়ে জঙ্গল থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। টারজান এবং পশুপক্ষীদের অবর্তমানে বনটি মরুভূমির মত খাঁখাঁ করে! যেন কোনও প্রেতাত্মার অভিশাপের কারণে দেখতে দেখতে এতো সুন্দর জঙ্গলটি নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।
এখন আর বাঘের গর্জন নেই, নেই বানরের লম্ফঝম্ফ; ময়না এবং টিয়ার ডাকে আকাশ বাতাস আগের মত মুখরিত হয় না, হাতির ভারী পদধ্বনিতে মাটিতে শিহরণ জাগে না; যেদিকে চোখ যায় শুধু শ্মশানের মত নীরবতাই অনুভব হয়।
টারজান এবং এইসব ঘরহারা পশুপাখী আর কখনও ফিরে আসবে কিনা কেউ জানে না। তবে তাদের এভাবে চলে যাওয়াটা কাপুরুষতা নয়, এটি এক ধরণের নীরব প্রতিবাদ যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা মানুষরা সভ্যতার নামে কতটুকু অসভ্যতায় লিপ্ত হচ্ছি, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে আমরা কিভাবে হিটলারের মত নির্দয় হয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছি।
তাদের প্রস্থান আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে প্রকৃতির ধ্বংস মানে সবারই ধ্বংস! প্রকৃতিকে কষ্ট দিলে তার ফল কখনও ভালো হয় না। প্রকৃতিই সময়মত সুদে আসলে অন্যায়কারীকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেয়, তখন বিবেকহীন, স্বার্থপর এবং লোভীদের সাথে সাথে নির্দোষরাও কষ্টে ভোগে। হয়তো এ কারণে যে যারা বিবেকবান তারা কেন এগিয়ে এসে ঐ মুষ্টিমেয় লোভীদেরকে প্রতিহত করেনি? কেন তারা দূর থেকে সিনেমা দেখার মত করে নীরবে এমন ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হল? তাই যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রকৃতির চোখে বিবেকবান এবং বিবেকহীন দুই পক্ষই সমান অপরাধী। রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত লাইনদুটির মতন,
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”।