মুহুর্মুহু বোমার শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাবার মত অবস্থা! আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা পড়ছে যেন ঝুম বৃষ্টি। এইমাত্র রুমির পায়ের কাছে একটি তাজা গ্রেনেড এসে পড়েছে। ফোঁড়া ফুলে ফেঁপে পেকে গেলে যেমন চামড়া ভেদ করে বের হয়ে আসতে চায়, ঠিক তেমনি ঐ গ্রেনেডটি ফাটতে বাকী।
সৌভাগ্যবশত গ্রেনেডটি সময়মত ফাটেনি; এই ফাঁকে যত দ্রুত সম্ভব রুমি আহত সহযোদ্ধা বশিরকে কোনোভাবে টেনে হিঁচড়ে খানিকটা দূরে গিয়ে অবস্থান নেয়। ঠিক তখনই সেই গ্রেনেড আকাশে বাতাসে মারাত্মক আওয়াজ সৃষ্টি করে ফেটে উঠে।
বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসিকতার কাছে পাক হানাদার বাহিনী পদে পদে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতীয় বাহিনী যদি বাংলাদেশি যোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র না দিত তবে পাক হানাদার বাহিনীকে হারানো অসম্ভব না হলেও অনেক কঠিন হত।
রুমি এইমাত্র যার জীবন বাঁচিয়েছে সেই বশির একজন ভারতীয়। তার পায়ে স্প্লিণ্টার ঢুকে এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে যে সেটিকে আর পা বলা যায় না। চাষাবাদের জন্য মাটিকে যেমন ট্রাক্টরের মাধ্যমে নরম এবং গুঁড়া গুঁড়া করা হয় বশিরের পায়ের অবস্থাও অনেকটা সেই রকম।
রুমি একবার আহত বশিরের দিকে তাকায়, আরেকবার দূর থেকে গুলী ও বোমাবর্ষণকারী হানাদার বাহিনীর দিকে গুলী ছুঁড়তে থাকে। সে জানে যে অতি দ্রুত বশিরকে আরও নিরাপদ স্থানে নিয়ে না যেতে পারলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু অনিবার্য।
বশিরের জন্য রুমির মনটা কেঁদে উঠে। সে শিশুর মত কাঁদতে থাকে। সে তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে নিজের জীবন গেলে যাক, যে করেই হোক বশিরকে বাঁচাতেই হবে। নিজের রাইফেলটি কাঁধে ঝুলিয়ে অনেক কষ্টে বশিরকে উপুড় করে কাঁধে তুলে নিয়ে দ্রুতগতিতে দৌড়াতে থাকে।
রুমি জানে যে আশেপাশে পাক হানাদার সৈন্যরা এবং রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ক্ষুধার্ত সাপের মত ওঁত পেতে আছে, যে কোনও সময় তাদের উপর হামলে পড়তে পারে। শত ঝুঁকি নিয়ে রুমি এগিয়ে যেতে থাকে।
শুরুতে রুমির হাঁটার গতি অনেক বেশী থাকলেও এখন সে বড্ড ক্লান্ত; সে এমনভাবে হাঁটছে যেন কেউ তার পায়ে কোনও ভারী পাথর বেধে দিয়েছে! সূর্যের অবশ্য এসবে কোনও কিছুই যায় আসে না; তার কাজ হচ্ছে শুধুই আলো দিয়ে যাওয়া। কোথায় মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে, কে মারা যাচ্ছে, কে কাঁদছে, কে হাসছে তাতে তার কিচ্ছুই যায় আসে না! সূর্য ধীরে ধীরে দিগন্তে লুকিয়ে যাবার পায়তারা করছে।
সন্ধ্যার কালো চাদরও যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বীভৎসতা আড়াল করতে পারছে না। বাতাসে শুধুই লাশের গন্ধ। শুকনো রক্ত পচে পচে বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে মহামারীর মত দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
রুমি বশিরকে সযত্নে রাস্তার ধারে একটি কড়ই গাছের সাথে হেলান দিয়ে রেখে একটি গাড়ির সন্ধানে রাস্তার দুই প্রান্তে তাকাতে থাকে। বশিরকে নিয়ে এতোটা পথ হেঁটে আসার ফলে তীব্র ব্যথায় রুমির দুই পা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। কোনওমতে অনেক কষ্টে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে সে গাড়ির জন্য চাতক পাখীর মত অপেক্ষায় আছে। তীব্র কষ্টে মুখের চামড়া কুঁচকে বশির বলে,
- মেরে ভাই! মেরে ফিকার ছোড়কে তুম আপনে জান বাঁচাও!
- চিন্তা করবেন না; We'll taste freedom together!
আকস্মিকভাবে রুমি একটি গাড়ির লাইট দেখতে পায়; রুমি নিজেকে গাছের আড়ালে নিয়ে যায় কারণ সে জানে না যে সেই গাড়িটি ভারতীয় সৈন্যদের নাকি পাক হানাদার বাহিনীর। ধীরে ধীরে গাড়িটি এগিয়ে আসতে থাকে; তখন রুমির কানে ভেসে আসে একটি গান- “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে”; প্রথমে তার মনে হয় সে ভুল শুনছে না তো? খরগোশের মত কানদুটো খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে একই ফল হয়!
গাড়িটি যতই সন্নিকটে আসতে থাকে, সেই গান ততই স্পষ্টতর হয়ে রুমির কানে আসে। সে অবাক না হয়ে পারে না এই ভেবে যে এভাবে জোরে জোরে আওয়াজ করে গান গাওয়ার পেছনে কারণটি কি হতে পারে! এটাকি চরম বোকামি নয়? একদিকে যুদ্ধ চলছে, আর এদিকে গাড়ির ভেতরে উচ্চস্বরে বিজয়ের গান গাওয়া হচ্ছে- তবে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে?
রুমি তাড়াতাড়ি গাড়ির সামনে গিয়ে ইশারায় চালককে থামতে বলে। সে এতো ক্লান্ত যে তার গলা দিয়ে কোনও স্বর বের হচ্ছে না। চালক গাড়িটি থামায় ঠিকই তবে রুমিকে অনেক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার পরে দুজনকে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়।
গাড়িতে প্রবেশের পর রুমি এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে পায়। সেখানে উপস্থিত সকল নরনারীর মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বাধা; তাদের হাতেও লাল সবুজের নান্দনিক পতাকা শোভা পাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার পরই রুমি বুঝতে পারে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এতদিন খাঁচায় বন্দী পাখীর মত অবস্থা ছিল সবার; এখন তারা মুক্ত পাখীর মত অনুভব করছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে চিরতরে মুক্তি মিলেছে। রুমির মনে হচ্ছে যেন সমস্ত আকাশটাই এখন হাতের মুঠোয়; সে যেখানে ইচ্ছা উড়ে বেড়াতে পারবে; যেন কেউ বাধা দেবার নেই।
রুমি আহত বশিরের দিকে তাকানোর পর আনন্দাশ্রু ঝরতে থাকে। তখনও বাধভাঙ্গা উল্লাসে মেতে আছে গাড়ির ভেতরের প্রতিটি যাত্রী। এমনকি রাস্তায়ও বিভিন্ন বয়সী লোকজন মিছিলে মিছিলে বাতাসকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে!
রুমি আকাশের দিকে তাকায়; তখন তার মনে হয় কতদিন সে আকাশ দেখেনি! আকাশটাকে আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে; একেবারে নতুন, যেন কেউ ঘরের দেয়ালের মত আকাশটাকেও নতুন রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে! রাতের আকাশে কোথাও একটুও মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। অত্যাচারী হানাদার বাহিনীর ছায়া সরে গিয়ে বাংলাদেশের মাটি যেমন পবিত্র হয়েছে, ঠিক তেমনি পরিস্কার স্বচ্ছ আকাশ যেন সেটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রুমি সেই নতুন আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে; এ দীর্ঘশ্বাস হতাশার নয়, স্বর্গীয় স্বস্তির। গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাস এসে একটু পরপর রুমিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। তার মনে হয় সে যেন বাতাসের কথা শুনতে পাচ্ছে! বাতাস যেন বলছে- স্বাধীনতার চেয়ে আনন্দের কিছুই নেই! স্বাধীনতাই বড়, আকাশ নয়!