গত রাতেই জুয়েল ঘুড়ি আর নাটাই খুব সযত্নে খাটের নিচে লুকিয়ে রেখেছে। সে জানে যে মায়ের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই! কোথায় যে যাবে ঘুড়ি এবং কোথায় যাবে নাটাই! জুয়েল যেখানে রেখেছে, ঘুমানোর আগে একটু পরপর এসে দেখে যাচ্ছে সেখানে সব ঠিকমত আছে কিনা। কারণ কাল শুক্রবার; স্কুলে যাবার চিন্তা নেই।
সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই জুয়েল নাস্তা শেষ করে তার প্রাণপ্রিয় ঘুড়ি এবং নাটাই নিয়ে বের হয়। খোলা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ যেন সারারাত হু হু করে কেঁদেছে। যেন সেই মাঠ জুয়েলসহ অন্যান্য ফুলের মত কোমল ছেলেমেয়েদের পদস্পর্শে নব জীবন লাভ করেছে। যেন মাঠের অস্তিত্ব একেবারে অর্থহীন এইসব ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি ছাড়া।
আজ আকাশে মেঘের একটুও ছিটেফোঁটা নেই। নোংরা এবং শ্যাওলায় ঢাকা দেয়াল যেমন নতুন রঙের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠে, খোদাও যেন তেমন করে আকাশটাকে একেবারে পরিস্কার করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন আকাশটাও এই শিশুদের আনন্দের অংশ হবার জন্য একদম প্রস্তুত।
জুয়েল তার বন্ধু নিশাতের সহায়তায় ঘুড়ি উড়ায়। তার নাটাইয়ে সুতা খুব বেশী নয় আবার কমও নয়। ঘুড়ি খোলা আকাশে “দেবদাস” উপন্যাসের চন্দ্রমুখীর মত ধেই ধেই করে নেচে উঠছে। একবার ডানে যায়, একবার বামে, একবার সোঁ করে বিমানের মত খাড়া উপরে উঠে যায়, আবার তীরের মত নিচে নেমে আসে!
ঘুড়ির এসব কাণ্ড দেখে জুয়েলের মুখে হাসির খই ফুটে। নিশাত কিছুক্ষণ তার সাথে থেকে পরে তার নিজের ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে আকাশ বিভিন্ন রঙের ঘুড়িতে মুখরিত হয়ে উঠে। পাখী ছাড়া আকাশের সৌন্দর্য যেমন ম্লান হয়, তেমনি রঙিন ঘুড়ি ছাড়া আকাশের নান্দনিকতা কিছুটা হলেও কমে।
জুয়েল ঘুড়িটাকে বেশী দূরে উড়তে দিতে চায় না কারণ তার ভয় এই ভেবে যে অন্য ঘুড়ি এসে যদি তার ঘুড়িটাকে পেঁচিয়ে ফেলে, যদি তার ঘুড়িটা ছিঁড়ে অনেক দূরে চলে যায়। এমনিতেই মা ঘুড়ি উড়ানো একেবারেই পছন্দ করে না, তার উপর আরেকটা ঘুড়ি কেনার টাকা চাইতে গেলে মায়ের হাতে বেদম পিটুনি খেতে হবে- এসব ভেবে ভেবে ঘুড়ি উড়াতে থাকে।
কিন্তু কথায় আছে যে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। জুয়েলের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। অকস্মাৎ অনেক দূরে থাকা একটি ঘুড়ি এসে তার ঘুড়িটার উপর সাইক্লোনের মত আছড়ে পড়ে। জুয়েল কিছু বুঝে উঠার আগেই এমনটি ঘটে যায়।
ঐ ঘুড়িটা জুয়েলের ঘুড়িটাকে সাপের মত পেঁচাতে থাকে। এখন জুয়েল শত চেষ্টা করেও সেই পেঁচ খুলতে পারবে না। কারণ যদি সে নাটাইয়ের সুতা টানতে থাকে, তবে ঘুড়ি ছিঁড়ে উড়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। তাই নিয়ম হচ্ছে ধীরে ধীরে সুতা ছাড়তে থাকা। হুইল বরশিতে মাছ আটকালে যেমন সুতা ছেড়ে ছেড়ে মাছটিকে ক্লান্ত করে পরে তীরে টেনে আনতে হয় অনেকটা সেরকম।
যাইহোক, জুয়েল সুতা ছাড়তে ছাড়তে তার নাটাইয়ে আর সুতা অবশিষ্ট নেই! এখন হয় বোকার মত নাটাই ধরে ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, নতুবা নাটাই গুটিয়ে সুতা টেনে আনতে হবে। এই টেনে আনার প্রক্রিয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ তা একটু আগেই বলা হয়েছে।
কিন্তু আর কোনও উপায় না দেখে জুয়েল খুব দ্রুততার সাথে নাটাই গুটিয়ে সুতা টানতে শুরু করে। সে সুতা টেনে নিচ্ছে এটা টের পেয়ে ঐ ঘুড়ির মালিকও তাই করতে শুরু করে। কয়েক মিনিট এভাবে যাবার পর জুয়েলের ঘুড়িটা ছিঁড়ে যায়। তখন তার চোখে পানি চলে আসে, তার মনে হয় যেন ঘুড়িটা ছিঁড়ে যায়নি, কেউ যেন টেনে তার হৃদয়টাই নিয়ে গেছে!
জুয়েল নাটাইটা নিশাতের কাছে রেখে সেই ছিঁড়ে যাওয়া ঘুড়ির দিকে পাগলের মত দৌড়াতে থাকে। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে ঘুড়িটা খুব বেশী দূরে গিয়ে পড়বে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই যে একবার নাটাই ছেড়ে ঘুড়ি উড়ে গেলে সে ঘুড়ির মালিকানা বদল হয়ে যায়। তার মানে হচ্ছে এই যে ঘুড়িটা যে সবার আগে ধরতে পারবে, সেই হবে সেটির মালিক।
জুয়েল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ঘুড়িটা বিশাল একটি পুকুরের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বিশাল এক কড়ই গাছের উপর গিয়ে পড়েছে। যে স্থানটিতে ঘুড়িটি আটকে আছে তার পাশে অনেকগুলো সাদা বক বসে আছে। ঘুড়িটি উড়ে এসে কাছে পড়াতে তাদের তেমন কোনও সমস্যা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। আসলে এই দুধের মত শুভ্র বকেরাও ঘুড়ি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে!
এখন জুয়েলের হাতে দুটি পথ খোলা। হয় গাছে চড়ে ঘুড়িটি উদ্ধার করতে হবে, নতুবা বাসায় ফিরে যেতে হবে। নাছোড়বান্দা জুয়েল প্রথম পথটিই বেছে নেয়। কারণ সে সেইসব মানুষদের দলে যারা চেষ্টা করেও হার মানতে রাজী আছে। চেষ্টা না করে হেরে যাওয়া কাপুরুষতা!
জুয়েল বেশ সাবধানে গাছে উঠে ঘুড়ির সাথে লেগে থাকা সুতার নাগাল পেয়ে যায়। সেই সুতাটি আস্তে করে টান দিতেই ঘুড়িটি উড়ে গিয়ে বটগাছের নিচে পড়ে। এখন জুয়েলের খুশীর আর কোনও সীমা নেই! আনন্দে আত্মহারা হয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে নিচে পড়ে যায় সে।
যখন হুঁশ ফেরে তখন জুয়েল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। মায়ের হাত ধরেই সে সর্বপ্রথম যে কথাটি বলে তা হচ্ছে- “মা, আমার ঘুড়িটা কোথায়?”