সখিনা খাতুনের যে বয়সে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্জন করার কথা, বিকেলে বান্ধবীদের সাথে কুতকুত আর কানামাছি খেলার কথা, সেই বয়সে তার লোভী বাবা আমজাদ তাকে বিয়ের নামে এক অর্থে বিক্রিই করে দেয়।
সখিনার যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। বিয়ের প্রস্তাব আসার শুরু থেকেই তার মা জামিলা এবং সখিনা নিজেও এ বিয়েতে ঘোর আপত্তি জানায়। কিন্তু রিক্সাচালক বাবা আমজাদ সংসারের চাকা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েই তার ছোট ফুলের মত মেয়েটিকে নিয়ে এক প্রকার জুয়া খেলে।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের সেলিম মিয়া আমজাদের বন্ধু। একদিন কথায় কথায় সেলিম বলে যে তার ছেলে আক্কাসের বউ হিসেবে আমজাদের মেয়ে সখিনাকেই পছন্দ করেছে। আমজাদ শুরুতে একটু ইতস্তত বোধ করলেও সেলিম যখন তাকে বলে যে তার কোনও যৌতুক দিতে হবে না, উপরি হিসেবে আমজাদকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হবে, তখন আমজাদের চোখদুটো লোভী হায়েনার মত জ্বলে উঠে; এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!
আমজাদ খুশি মনে বাসায় ফিরেই সখিনার মাকে এই সুখবরটি দিলে জামিলা ‘কি’ বলে ছ্যাঁত করে উঠে! যেন কেউ গরম খুন্তি দিয়ে তার গায়ে ছেঁকা দিয়েছে! সে বলে,
- সখিনারতো অহনও বিয়ার বয়সই অয় নাই!
- অইছে, অইছে! তুমি যেইডা জানো না হেইডা লইয়া কতা কইও না!
- হ, হক্কলতা খালী তুমিই বুজো না? আমরারে কি বেহুব পাইছো নি?
- বেশী কতা বাড়াইও না কইলাম! আমি সেলিমরে জবান দিছি! এই বিয়া অইবই অইব!
যে মেয়ে বিয়ের সংজ্ঞাও ঠিকমত জানে না, সেই সখিনা যখন জানতে পারে যে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে কাঁদতে কাঁদতে পরম আবেগে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা আমার বান্ধবীরা কেউতো অহনও বিয়া করে নাই! আমিও বিয়া করুম না!”
কিন্তু লোভী আমজাদের মনে তার মেয়ের কান্না এবং স্ত্রীর ইচ্ছার কোনও মূল্যই নেই। যাইহোক, যথাসময়ে বিয়েটা হয়। বিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড খুব পারিবারিকভাবে এবং রীতিমত গোপনেই সম্পন্ন হয়।
অল্প বয়সে বিয়ে হবার কারণে তার শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। কিছুদিন পরপরই তাকে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়। ঔষধ হয়েছে তার নিত্যসঙ্গি। প্রতিদিন কোনও না কোনও ঔষধ তাকে খেতেই হয়।
বিয়ের এক বছরের মাথায় সখিনা সন্তানসম্ভবা হয়। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা! আগেই সখিনার শারীরিক জটিলতা অনেক বেশী ছিল, এখন যেন তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সখিনার কষ্টের আর সীমা থাকে না। অশিক্ষিত হবার কারণে সে অনেক কিছু ঠিকমত বুঝেও না। এই পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজেকে সামলে নিতে হয়, কোন কোন বিষয়গুলো সতর্কতার সাথে মেনে চলতে হয়, কোন কোন খাবার বেশী করে খেতে হয় ইত্যাদি কোনও ধারণাই নেই তার।
তার শাশুড়ি সফুরার কাছ থেকেও যেসব পরামর্শ পায়, সেসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সফুরা মাঝে মাঝে কিসব ঔষধ পানিতে মিশিয়ে সখিনাকে খেতে দেয়। সখিনার তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সেটা প্রায় প্রতিদিন পান করতে হয়। তার শাশুড়ি বলে, “খা মা, খাইয়া লো! এই অসুদ খাইলে তোর একটা মরদ পোলা অইব; পোলাডা দুধের মত ফর্সা আর সুন্দরও অইব!”
এমনিতেই শারীরিক যন্ত্রণা লেগেই আছে, তার উপর এই ঔষধ খাওয়ার ফলে প্রায়ই সখিনার পেটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। সে শাশুড়িকে বলেছে যে এই ঔষধ খাওয়ার পরপরই তার পেটে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়ে যায় কিন্তু সফুরা হাসতে হাসতে বলে যে এ ব্যথা ঔষধ খাওয়ার কারণে নয়, বাচ্চা পেটে লাথি মারে বলেই নাকি এমনটি হয়!
নির্দিষ্ট দিনে সখিনাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে। ডাক্তাররা শত চেষ্টা করেও সখিনাকে বাঁচাতে পারেনি। এই সখিনার মত আরও কত সখিনা যে এভাবে বাল্য বিবাহের শিকার হয়ে অকালে নিস্পাপ ফুলের মত ঝরে যাচ্ছে তার হিসেব কি আমরা সভ্য সমাজের বাসিন্দারা রাখি?