আধুনিক ফাঁদ! [Bangla Story]

এ দুনিয়ায় কত রকম ফাঁদ যে আছে তা শুধু আল্লাহ্‌ই ভালো জানেন! প্রায় প্রতিটি ফাঁদের পেছনেই কাজ করে ব্যক্তিগত হিংসা এবং স্বার্থপরতা।

 

আমাদের সমাজে বেশীরভাগ মানুষই একে অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না। কেউ সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উপরের দিকে উঠতে লাগলেই তার পেছনে একগুয়ে প্রেতাত্মার মত কিছু মানুষ উঠেপড়ে লাগে! তারা নিজেরা চেষ্টা করে নিজেদের ভাগ্যের চাকা সামনে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে ঐ সফল ব্যক্তিকে কিভাবে সফলতার শীর্ষ থেকে টেনে নিচে নামানো যায় সেই চেষ্টাই করতে থাকে।

 

এমন অসুস্থ চেষ্টার জন্য যদি নিজের নাকও কাটতে হয় তবে তারা তাই করে! মিশু পরিসংখ্যান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ছাত্রদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় একজন শিক্ষকে পরিণত হয়। সকল ব্যাচের ছাত্ররাই তার ক্লাস চায়। ইতোমধ্যে অনেকেই এসে মিশুর কাছে অনুরোধ করেছে কিন্তু সে তাদেরকে সঠিক নিয়ম বাতলে দিয়েছে আর তা হচ্ছে এই যে বিভাগীয় প্রধানের কাছে গিয়ে অনুরোধ করা। তিনি যদি রাজী হন তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাচে ক্লাস নিতে মিশুর কোনও আপত্তি নেই।

 

কিন্তু মিশুর এই তুমুল জনপ্রিয়তাই তার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার সহকর্মীদের মধ্যে কয়েকজন ভেতরে ভেতরে হিংসায় অগ্নিকুণ্ডের মত জ্বলতে থাকে। তার বিভাগীয় প্রধানও এর ব্যতিক্রম নয়।

 

মিশু বুঝতে পারে যে কিছু ঈর্ষান্বিত লোক তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে চায়; সে তার নির্দিষ্ট বসার স্থানে এসে বসার পর কতিপয় সহকর্মী তাকে উদ্দেশ্য করে বাজে কটূক্তি করতে থাকে। যদিও তার নাম ধরে বা সরাসরি কিছু বলে না, তবে আকার ইঙ্গিতে বোঝা যায় যে কথাগুলো তাকে লক্ষ্য করেই বলা হচ্ছে।

 

মিশুর সাথে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ প্রায় প্রতিদিনই হতে থাকে। এসব কারণে অফিসে এক মুহূর্তও বসতে ইচ্ছে হয় না। যতক্ষণ সে ক্লাসে থাকে মনে হয় যেন স্বর্গে আছে। ছাত্রদের তৃপ্ত মুখের পানে তাকালেই মিশুর মনটা আনন্দে ফড়িঙের মত নেচে উঠে! সে অনুভব করতে পারে যে ছাত্ররা তার লেকচার খুব সহজেই বুঝতে পারছে।        

 

কিন্তু বাসায় ফিরেই মিশু রীতিমত বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই হিংসুটে সহকর্মীদের খোঁচা দিয়ে বলা প্রতিটি কথা তার মনে রিপিট মোডে দেয়া গানের মত বাজতে থাকে। সে তার মনোযোগ অন্য দিকে নেয়ার চেষ্টা করলেও ঐসব কথা ঘুরেফিরে তার মস্তিষ্কের বারান্দায় পায়চারী করতে থাকে।

 

এসব কারণে মিশুর খাওয়া দাওয়ায় অনীহা চলে আসে। দুশ্চিন্তার কালো ছায়া যেন তার নিত্যসঙ্গী। সারাক্ষণ এসব নিয়ে ভাবার কারণে তার অস্বাভাবিকভাবে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং সারাদিন তার মাথাব্যথা করতে থাকে। সে বুঝে যে এগুলো পাত্তা দেয়ার ফলে তার শরীর খারাপ হচ্ছে কিন্তু যতই সে ভুলতে চায় ততই দূরে ফেলে দিয়ে আসা বিড়ালের মত তা ফিরে ফিরে আসে!

 

ইতোমধ্যে মিশুর কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ এবং বই দেশ বিদেশের খ্যাতনামা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হবার পরে ঐসব হিংসুটে লোকের হিংসার মাত্রা যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তার একেকটি লেখা বা বই যেন আগুনে পেট্রোল ঢালার মত তাদের ঈর্ষা বাড়িয়ে তুলতে থাকে।

 

হিংসার আগুনে অন্যরা জ্বলে ঠিকই কিন্তু হিংসুটে নিজে সবচেয়ে বেশী জ্বলে! এ সহজ সরল কথাটি যদি তারা বুঝত! যাইহোক, একদিন মিশুর মা অসুস্থ থাকার কারণে তাকে তিন দিনের ছুটি নিতে হয়। নিয়মানুসারে সে বিভাগীয় প্রধানের সাথে দেখা করে বিষয়টি জানায়। তিনিও হাসিমুখে ছুটি মঞ্জুর করেন।

 

মিশু ছুটির জন্য নির্দিষ্ট ফর্মটি পূরণ করার জন্য সেকশন অফিসারের কক্ষে গেলে সেখানে তাকে না পেয়ে বাসায় চলে যায়। তার মনে হয় যে মৌখিকভাবে তো অনুমতি পেয়েই গেছে, তাই আর কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। তাছাড়া ঐ ছুটির ফর্মটি ঢাকা থেকে ফিরে আসার পরেও পূরণ করা যাবে।

 

যেহেতু মিশু ছুটি নিয়েছে, তাই সে ফোন করে প্রত্যেকটি ব্যাচের ছাত্রদেরকে জানিয়ে দিয়েছে যে আগামী তিন দিন সে ক্লাস নেবে না। তিন দিন পর মিশু সেকশন অফিসারের কাছে ছুটির ফর্ম চাইতে গেলে সে তাকে একটি সো কজ লেটার ধরিয়ে দেয়। এটি হাতে পেয়ে সে আকাশ থেকে পড়ে! কারণ মিশু বুঝতে পারছে না যে সে কি এমন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে যে তাকে সো কজ লেটার দেয়া হয়েছে!

 

যাইহোক, সো কজ লেটারটি পড়ে দেখে যে যেই তিন দিনের ছুটি নিয়ে মিশু ঢাকা গিয়েছে, সেই তিন দিন তাকে অনুপস্থিত দেখিয়ে সো কজ লেটার ইস্যু করা হয়েছে। বিভাগীয় প্রধানের কাছ থেকে এমন অন্যায় আচরণ সে কখনই আশা করেনি।

 

যেহেতু মিশু ছোটবেলা থেকেই নজরুলের মত প্রতিবাদী ধরণের, সে এই অন্যায়টি সহজে হজম করতে পারেনি। সে পূর্বে নেয়া ছুটির অনুমতি সম্পর্কে বলতেই বিভাগীয় প্রধান এমন ভাব করলেন যেন এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না!

 

মিশুর আর বোঝার বাকী থাকে না যে তাকে এক ধরণের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এরকম বেইমানীর শিকার সে আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি। বিভাগীয় প্রধানের এমন আচরণের ফলে তার প্রতি পূর্বে যে কিছুটা শ্রদ্ধা ছিল তা কুয়াশার মত মিলিয়ে যায়। তার পরিবর্তে মিশু তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। বিভাগীয় প্রধানের মত এমন অন্যায় কাজ কেবলমাত্র ধূর্ত শাইলক কিংবা ইয়াগোই করতে পারে। এছাড়াও তিনি অন্যদের সামনে মিশুকে কারণে অকারণে হেয় প্রতিপন্ন করতে সদা সচেষ্ট থাকে। 

 

মিশু বুঝতে পারে যে এসবই তার আসন্ন প্রোমোশন আটকানোর নীলনকশার অংশ। অন্যদের মত সে সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় যে কাপুরুষের মত যুদ্ধের ময়দান থেকে সে পালাবে না। সে সাহসী থরের মতই যুদ্ধ করবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে। তার সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসুক বা না আসুক, সে তার ন্যায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যেতেই থাকবে। কারণ সে রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীতে বিশ্বাসী- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে। 

View kingofwords's Full Portfolio
tags: