হতাশা [Bangla Story]

কয়েকদিন রিনার মা আছিয়া বেগম খুব অসুস্থ। যে কোনও সময় পরপারে চলে যেতে পারেন। রিনা একটি ক্লিনিকে কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করে তাতে একজনই ঠিকমত চলতে পারে না, সেখানে তাকে তার মৃতপ্রায় মা এবং আট বছরের ছোট ভাই জনির দেখাশুনা করতে হয়।

 

রিনার বাবা জব্বার ট্রাক ড্রাইভার ছিলেন। তার বেপরোয়া জীবন যাপনের কারণেই পরিবারটির আজ এমন করুণ হাল। ট্রাক চালিয়ে যা উপার্জন করতেন সবই হয় মদ খেয়ে না হয় পতিতালয়ে বেশ্যার সাথে শুয়ে নষ্ট করতেন। একদিন রাতে মদ্যপান করে ট্রাক চালানোর সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল এবং জব্বার মারা গেলেন।

 

জব্বার পরপারে গেলেন ঠিকই কিন্তু পরিবারটিকে এপারে ভয়ংকর সঙ্কটে ফেলে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে রিনার উপর। সে ক্লিনিকে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রোগীদের সেবা করে বাসায় ফিরে মায়ের সেবায় ন্যস্ত হয়।

 

প্রতিদিন সকাল হতে রাত বারোটা পর্যন্ত রিনার এ সংগ্রাম চলে। যেহেতু সে সারাক্ষণ কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকে, তাই সময় যে কখন বুলেটের মত গতিতে চলে যায় সে সেটা টেরও পায় না। বাসায় মাকে সময় দিলে ছোট ভাইটিকে সময় দিতে পারে না। এ রকম এক টানাপড়েনের মধ্যেই তার যৌবন অতিবাহিত হতে থাকে।

 

অতি শোকে মানুষ যেমন পাথর হয়ে যায়, ঠিক তেমনি অতি পরিশ্রমে মানুষ সত্যিকারের মানুষে রূপান্তরিত হয়! যন্ত্রের মত হাড়ভাঙা পরিশ্রমই রিনাকে একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষে পরিণত করেছে। সে জানে যে শামুকের মত এক স্থানে বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না; তাকে বাতাসের মত সদা বহমান এবং পিঁপড়ার মত পরিশ্রমী হতে হবে। যদিও দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা খুব একটা হয়ে উঠেনি তবুও রিনা বোঝে যে গতিময়তা এবং পরিশ্রমই প্রকৃতির অনেকগুলো মূলমন্ত্রের মধ্যে অন্যতম।

 

যাইহোক, যেদিন সে ঈদের বোনাস পায়, সেদিন তার মনে আনন্দের আর কোনও সীমা থাকে না। হোক না তা যৎসামান্য, তবুও সে স্বপ্ন দেখে মার জন্য একটি নতুন শাড়ি কেনার, জনিকে শার্ট প্যান্ট এবং নতুন জুতা কিনে দেয়ার; সে নিজের জন্য কোনও কিছুই কেনে না। সেই পুরনো ড্রেসই প্রতি ঈদে পরে। দরিদ্র যারা তাদের অতিরিক্ত সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই কারণ সেই সাধ অপূর্ণ থাকলে কষ্ট বেড়েই চলে। রিনা এটা বুঝে বলেই তার মনে আকাশকুসুম কল্পনা বা দিবাস্বপ্নের স্থান নেই। তার চিন্তাধারা গি দ্য মোপাসঁ দ্যা নেকলেইসগল্পের নায়িকা মাটিল্ডের মত নয়, তা বরং আর্থার মিলারের বিখ্যাত নাটক ডেথ অব এ সেলসম্যান”-এর প্রধান চরিত্র উইলি লোম্যানের স্ত্রী লিন্ডার মত। কারণ রিনা বাস্তবতা এবং দিবাস্বপ্নের মাঝখানে যে বিশাল ব্যবধান আছে, সেটি সে খুব সহজেই দেখতে পায়।

 

একবার ঈদের বোনাস পেয়ে রাত এগারোটার দিকে রিক্সায় চড়ে বাসায় ফেরার পথে খানিকটা নির্জন স্থান ফেলে যাওয়ার সামনে যাওয়ার সময় অকস্মাৎ একটি সি এন জি ট্যাক্সি রিনা যে রিক্সায় বসা সেটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন লোক ঈগলের মত ছোঁ মেরে রিনার কোলে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটি নিয়ে নেয়। মুহূর্তেই সেই ট্যাক্সিটি ভূতের মত এক অন্ধকার গলিতে মিলিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় রিনা এবং রিক্সাচালক দুজনই হতভম্ব হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রয়! 

 

ব্যাগে থাকা ঈদ বোনাসের টাকা গেছে যাক, কিন্তু রিনার সবচেয়ে বেশী কষ্ট হচ্ছে সেখানে থাকা মায়ের জন্য কেনা ওষুধের জন্য। মা যে ওষুধ না খেতে পারলে মারা যাবে। রিক্সা সময়ের মত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। রিনা ওড়নায় তার মুখ চেপে বাচ্চার মত কাঁদছে। রিক্সাচালক আর কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা ছাড়া তার কান্না আর কেউ শুনছে না!  

View kingofwords's Full Portfolio
tags: