সফুরা বেগমের দুই বছর বয়সী ছেলে কুদ্দুসের জ্বর ছাড়ার কোনও নামই নেই! জ্বরতো নয় যেন হতচ্ছাড়া জোঁক! দিনের পর দিন ছায়ার মত লেগেই আছে। জ্বরের প্রকোপে বেচারা কুদ্দুস কংকালসার হয়ে গেছে।
যেহেতু এলোপ্যাথি ডাক্তার দেখানোর মত সামর্থ্য সফুরার নেই, তাই সে কয়েকদিন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কিছুতেই কুদ্দুসের জ্বর কমছে না। একদিন পাশের বাড়ির জহুরা সফুরাকে পরামর্শ দেয় যে পার্শ্ববর্তী গ্রামে এক সমঝদার এবং নেক সাধু বাবা আছেন, তার কাছে কুদ্দুসকে একবার নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি যদি একবার কুদ্দুসের মাথায় ফু দিয়ে দেন, তবে সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
সফুরা শুরুতে ইতস্তত করলেও জহুরার কথায় আশ্বস্ত হয়। জহুরা বলে,
- সাধু বাবা কোনও টাকা পয়সা নেয় না।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ!
- তুমি আমার সাথে মশকরা করছো নাতো?
- আরে না, না, কি যে বলো না তুমি? তোমার সাথে এই বিষয় নিয়ে মশকরা করব কেন?
- কোনও টাকা নেয় না! তাহলেতো খুব ভালো খবর!
সফুরা ভাবে যে একবার দেখালেই বা দোষ কি! বলাতো যায় না কার উছিলায় কে ভালো হয়? পরদিন জহুরাকে অনুরোধ করে তার সাথে ঐ সাধু বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। কারণ সে তো পথঘাট চিনবে না তাই। কিন্তু জহুরার কি একটা কাজ থাকার ফলে সে যেতে পারবে না; কিন্তু সে খুব ভালো করে ঠিকানা এবং যাওয়ার পথ বাতলে দেয়।
সফুরা অনেক কষ্ট করে কুদ্দুসকে নিয়ে সেই সাধু বাবার আস্তানায় পৌঁছে যায়। গিয়ে দেখে সেখানে মানুষ আর মানুষ। এতো মানুষের জটলা দেখেই সফুরা বুঝতে পারে যে সাধু বাবা কতটা জনপ্রিয়! একটি লাইনে এতো মানুষ দাঁড়াতে দেখে সফুরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়! দূর থেকে মানুষের লাইনটি দেখতে রীতিমত পিঁপড়ার লাইনের মতই ঠেকে।
যাইহোক, প্রখর রৌদ্রের তাপ থেকে কোনওমতে কুদ্দুসকে বাঁচানোর চেষ্টায় সফুরা তাকে নিজের আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখে। একটি ক্যাঙ্গারু যেমন করে তার বাচ্চাকে বুকের থলেতে রেখে রক্ষা করে অনেকটা তেমনি। আসলে প্রকৃতি মাকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে পারে না, হোক তা ঝড়, প্রখর রোদ, কিংবা বন্যা; মায়ের মনে কষ্টের তীর তখনই বিদ্ধ হয় যখন তার সন্তান কষ্ট পায়!
অবশেষে সফুরার ডাক আসে। সে কুদ্দুসকে নিয়ে সাধু বাবার কক্ষে প্রবেশ করে। সেই কক্ষে সাধু বাবা একটি আলখাল্লা পরা অবস্থায় ধ্যানরত গৌতম বুদ্ধের মত চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তার ডান হাতে একটি তসবিহ ধরা। সামনেই আগরবাতি জ্বলছে; সুমিষ্ট ঘ্রাণ সফুরার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে।
সফুরা বিনীতভাবে সালাম দিতেই সাধু বাবা চোখ খুলে তাকান। সফুরা কিছু বলার আগেই তিনি ডান হাত তুলে কিছু না বলার জন্য ইশারা করেন। কুদ্দুস এতক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
সাধু বাবা তার স্থান থেকে উঠে এসে কুদ্দুসের এক পা ডান হাতে নিয়ে নিজের মাথার উপর ঘুরাতে থাকে! বাচ্চারা মেলা থেকে খেলনা কিনে মাথার উপরে যেমন ঘুরায় ঠিক তেমনি। এদিকে কাণ্ডটি শুরু করার সাথে সাথেই কুদ্দুসের ঘুম ভেঙে যায় এবং সে প্রচণ্ড আওয়াজ করে কাঁদতে থাকে।
সফুরা নিজের আঁচল মুখে চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো চোখে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় কুদ্দুসের চরকির মত ঘোরা দেখতে থাকে। তার মনে হয় সাধু বাবা কুদ্দুসকে নয়, যেন তাকেই ঘুরাচ্ছে!
প্রায় দুই মিনিট ঘোরানোর পর কুদ্দুসকে সফুরার কোলে ফিরিয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় বাইরে চলে যেতে বলে। সফুরাও বুঝে যায় যে কুদ্দুসের চিকিৎসা হয়ে গেছে। বাড়িতে ফিরে এসে কুদ্দুসের কপালে হাত দিয়ে দেখে যে জ্বর একদমই নেই!
সফুরা মনে মনে সেই সাধু বাবার প্রশংসা করতে থাকে। পরদিন সকালে সফুরা ঘুম থেকে উঠে কুদ্দুসকে কোলে নেয়। কিন্তু কুদ্দুসের দেহ সাপের মত শীতল হয়ে আছে। নিঃশ্বাসও বন্ধ; অনেক ডাকাডাকি এবং নাড়াচাড়ার পরও কুদ্দুস সেই আগের মতই পাথরের টুকরার মত হয়ে আছে।
আর কালক্ষেপণ না করে কুদ্দুসকে নিয়ে আগের সেই হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন যে কুদ্দুস মৃত। ডাক্তার ভালো করে জিজ্ঞেস করতেই সফুরা গতকালের সেই সাধু বাবার অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলে।
ডাক্তার প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পেরে সফুরাকে থানায় যেতে বলে। সেই সাধু বাবার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ তার আস্তানায় গিয়ে তাকে পায়নি। তার সন্ধান চলছে...