ছেলেটির নাম আকাশ। আকাশের মতই তার হৃদয়। বয়স ১৪। বাবা মার চার সন্তানের মধ্যে সে তৃতীয়। লোকে বলে তৃতীয় সন্তান নাকি খুব মেধাবী হয়। তবে আকাশের মা আলেয়া এবং বাবা ইমতিয়াজের অবশ্য সেরকম মনে হয় না। অবশ্য মনে না হবার পেছনে তাদের প্রচুর যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে।
আলেয়া এবং ইমতিয়াজ অন্যান্য সন্তানদের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী কিন্তু আকাশের ব্যাপারে তারা যেন অনেকাংশেই হতাশ। চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক আকাশের কোন কোন কারণে তার বাবা মার মনে হতাশার চাদর পড়েছে।
প্রথমত, আকাশ দেখতে বেশ সুদর্শন। অনেকটা বর্তমানের বলিউড সুপারস্টার রণবীর কাপুরের মতন। তার গায়ের রং গ্রীষ্মের আকাশে উড়ন্ত শুভ্র মেঘের মতন। তার চাল চলনেও আছে স্বকীয়তা। ঠিক যেন কোনও রাজার মতন তার কথা বলা, বসা এবং হাঁটার ভঙ্গি! আকাশের মাথার চুল অবশ্য খুবই সুন্দর; সে তার মায়ের মতই ঘন এবং কালো চুল পেয়েছে। তার চুল দেখলেই বোঝা যায় যে তার মাথায় কখনও টাক পড়বে না! আকাশের চোখদুটোও খুব সুন্দর; ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের মত!
যাইহোক, আকাশ অল্পতেই অসুস্থ হয়ে যায়। শীতকালে যে তাকে কতবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয় তার ইয়ত্তা নেই! এছাড়াও আজকে ডায়রিয়া তো কালকে আমাশয় ইত্যাদি রোগতো শীতকালের হতচ্ছাড়া মশাদের মত পিছু লেগেই আছে! উপরন্তু আকাশ গণিতে খুবই কাঁচা। সে নিজেও অংক করতে বসলে মন থেকে তাগিদ বোধ করে না। মোট কথা অংক জিনিসটাই তার দু চোখের বিষ! একজন মাঝির কাছে যেমন সাগরের উত্তাল ঢেউ বিষের মতন, ঠিক তেমন।
বাবার হাতে যে কতবার বেদম পিটুনি খেয়েছে তা বলাই বাহুল্য! অনেক অর্থ খরচ করে সবচেয়ে ভালো এবং অভিজ্ঞ গৃহ শিক্ষক রাখার পরও আকাশের গণিতের দুর্বলতা একটুও কাটেনি। যাকে বলে- যেই লাউ সেই কদু আর কি?
তবে আকাশের মনে কেন জানি এক অদ্ভুত বিশ্বাস কাজ করে সবসময়। সে মনে করে যে জীবনের যে কোনও পরীক্ষায় সে খুব সহজেই পার পেয়ে যাবে। উল্লেখ্য, তার মধ্যে সাধুদের মত আধ্যাত্মিক কিছু না থাকলেও কেন জানি তার এমন দৃঢ় বিশ্বাস! এই বিশ্বাসের উৎস কোথায় তা আকাশ নিজেও জানে না।
পরীক্ষার সময় আসে, আকাশ পরীক্ষা দেয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে পাসও করে! সে খুব ভালো নাম্বার না পেলেও মোটামুটিভাবে উতরে যায়। তার বাবা এখন আর তাকে নিয়ে বেশী ভাবে না; আগের মত মারধরও করে না কারণ তার বোঝা হয়ে গেছে যে যার নয়ে হয়নি তার নিরানব্বইয়েও হবে না! মোট কথা ইমতিয়াজ আকাশের ভবিষ্যতের বিষয়টা আল্লাহ্র উপরই ছেড়ে দিয়েছে।
আকাশের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে এই যে সে অন্য মানুষের সামনে কথা বলতে খুব অস্বস্তি বোধ করে। বাসায় কোনও মেহমান আসলে সে চোরের মত কোনও এক কোণায় লুকিয়ে থাকে! আলেয়া অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মেহমানদের সামনে নিতে পারলেও তার মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয় না। হয় আকাশ মেয়েদের মত লজ্জায় নিজের নখ কামড়াতে থাকে, নয় ধীরে ধীরে কৈ মাছের মত তাদের সামনে থেকে সরে পড়ে।
আকাশ নিজেও বুঝে যে বাসায় কেউ আসলে তাদের সাথে কথা বলা, কুশল বিনিময় করা একটি সামাজিকতার ব্যাপার এবং করা উচিত কিন্তু কেন জানি সে ভেজা বিড়ালের মত হয়ে যায়! এসব নিয়েও যে তার মায়ের হাতে কত সহস্র চড় খেয়েছে তার কোনও হিসেব নেই! যদি আকাশের গালে পড়া চড়ের হিসেব কেউ রাখতো তাহলে হয়তো গিনেস বুকে তার নাম নিশ্চয়ই উঠত!
বন্ধুদের মাঝেও আকাশ যে খুব বেশী প্রাণ খুলে কথা বলে বা মিশে তা কিন্তু নয়। সে তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু না হলে নিজেকে মেলে ধরে না। সে যেন ঠিক ঐ লজ্জাবতী গাছের মত যে মুহূর্তেই চুপসে যায়! আকাশের আচার ব্যবহার এমনিতে বেশ মার্জিত। কখনও কারো ক্ষতি করে না; বরং সবসময় অন্যের বিপদে এগিয়ে যায় এবং যথাসাধ্য সাহায্য করে। কথাবার্তায় অতটা পটু না হবার কারণে অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করে এবং হেয় করতে চায়। আকাশ অবশ্য মনের দিক থেকে লোহার মত বেশ শক্ত; এসব খুব একটা গায়ে লাগায় না।
আকাশের গুণাবলী সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করার আগে তার কিছু দোষ সম্পর্কে কিছুটা আভাস দেয়া যায়। তার এমন কিছু বদ অভ্যাস আছে যেগুলো “অ্যা পোট্রেট অব দি আর্টিস্ট এজ অ্যা ইয়াং ম্যান”- এর ষ্টিফেন ডিডেলাসের মতই। সেসব বদ অভ্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে গল্পটি একটি উপন্যাস হয়ে যাবে! তাই এখানে দাড়ি টানাই বুদ্ধিমানের কাজ!
আকাশ দিবাস্বপ্ন দেখতে অসম্ভব ভালোবাসে ঠিক “লর্ড জিম” উপন্যাসের নায়ক জিমের মতন! এই বয়সে সে জানে না দিবাস্বপ্ন দেখা ভালো নাকি খারাপ। যখনই সুযোগ হয়, তখনই সে দিবাস্বপ্নের রঙিন রাজ্যে নিজেকে পাখীর মত উড়িয়ে নিতে থাকে! উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন সে টিভিতে শাহ্রুখ খানের গেরুয়া গানটি শুনে তখন তার নিজেকে শাহরুখ খান মনে হয়; মনে হয় সে কাজলের সাথে গান গেয়ে এবং নেচে বেড়াচ্ছে! আবার কখনও বিকেল বেলা শুয়ে শুয়ে আজব সব কল্পনা করতে থাকে; হয়তো দু দিন বাদে কোনও এক ক্রিকেট ম্যাচ আছে তার স্কুলের মাঠে, আকাশ আগে থেকেই কল্পনা করতে থাকে যে সে সেঞ্চুরি করে নট আউট রয়েছে এবং তার দল জিতেছে! শুধু তাই না সবাই তাকে মাথায় তুলে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে এবং “আকাশ! আকাশ!” ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হচ্ছে!
ক্রিকেট ফুটবল, ব্যাডমিন্টনসহ যে কোনও খেলা, বরশীতে মাছ ধরা, দূর দূরান্তে বন্দুক নিয়ে পাখী শিকারে যাওয়া, বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেট সংগ্রহ এসব অভ্যাস আকাশের কাছে মাদকের মত কাজ করে!
যদিও আকাশ অত্যন্ত লাজুক তবুও স্কুলের যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে অংশ নেয়। হোক সেটা গান, অভিনয়, বিতর্ক কিংবা কবিতা আবৃত্তি। যখন সে এমন কোনও প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়, তখন তার দিবাস্বপ্নের মাত্রা যেন আরও শত গুণ বেড়ে যায়!
একদিন একজন লোক আকাশের জীবনে ফেরেশতার মত এলেন এবং তার জীবনটাকে সূর্যের মত আলোকিত করে গেলেন। হয়েছে কি- আকাশ এবং তার বন্ধুরা একটি হোটেলে বসে গরম গরম পরোটা আর সবজি খাওয়া অবস্থায় একটি কাগজে লেখা কবিতা আবৃত্তি করছে। আবৃত্তি শুনে পাশে বসা একজন তরুণ দেখতে লোক তাদের দিকে এগিয়ে আসে। সে বলে যে এইভাবে নয়, এইভাবে আবৃত্তি করো; মানে দাঁড়ালো এই যে সেই অপরিচিত লোকটি কবিতার কাগজটি নিজের হাতে নিয়ে আবৃত্তি করা শুরু করে দেয়! তার আবৃত্তি শেষ হলে একে একে আকাশ ও তার বন্ধুদেরকে আবৃত্তি করতে বলে। তারাও বাধ্য শিশুর মত তার কথা শুনতে থাকে। যেন সে কোনও জাদুকর যার জাদুর মোহে তারা শুষ্ক পাতার মত উড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই! একপর্যায়ে সে নিজের লেখা একটি গান একটি কাগজে লিখে আকাশের হাতে দেয়। সে নিজে মৃদু স্বরে গানটি গায় এবং আকাশকেও গাইতে বলে। আকাশ প্রথমে একটু ইতস্তত বোধ করে ঠিকই কিন্তু সেই লোকটির প্রবল অনুপ্রেরণায় সে গানটি গাইতে সক্ষম হয়। কিছুক্ষণ পরেই লোকটি ধূমকেতুর মত কোথায় যেন চলে যায়। সে চলে যাবার পরে আকাশ এবং তার বন্ধুদের মনে হয় যে তার নামই তো জানা হল না! পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের কাছেই এমন অসাধারণ কিছু মুহূর্ত আসে যেখানে কেউ হঠাৎ কোনও অবতারের মত আসে এবং সবকিছু খুব সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে যায়!
আসলে আকাশের অজান্তেই এসব ছোট ছোট পরিবর্তন তার মধ্যে সংঘটিত হচ্ছে যা কিনা আদতে তার মেধাবী হবার প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করছে! সে যে সময়ের পরিক্রমায় একজন অসাধারণ মেধাবী মানুষে পরিণত হবে এসব তারই প্রাথমিক লক্ষণ!
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সন্তান যদি একটু আলাদা হয় আচারে কিংবা ব্যবহারে, পিতা মাতার মনের শান্তি গ্রীষ্মের মেঘের মতই যেন উধাও হয়ে যায়! দুনিয়ার দুশ্চিন্তা এসে ভূতের মত ভর করে তাদের মনে! হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয়, ঠিক তেমনই একেকটি সন্তান একেক রকম; তাদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ইত্যাদি আলাদা। একেকজন তার নিজের মত করে পৃথিবীটাকে দেখে। কিন্তু হায়! বছরের পর বছর ধরে যে সন্তানকে তার পিতা মাতা লালন পালন করে, সেই সন্তানের সুপ্ত প্রতিভা উপলব্ধি করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা হয়তো সকল মাতা পিতাকে দেননি!
এই আকাশই একসময় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে বেশ ভালোভাবে সম্মান এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে। এক পর্যায়ে সে নিজের ভেতরকার বহুমুখী প্রতিভার মধ্য থেকে সেটাকেই প্রধান হিসেবে বেছে নেয় যেটা হচ্ছে ‘লেখালেখি’। সেই ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে মজা করে ছন্দের তালে তালে ছড়া ও কবিতা লেখার যে একটা প্রবণতা ছিল, সেটাই এখন তার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। একজন ভালো লেখক হতে গেলে একটি অসাধারণ ছেলেবেলা থাকতে হয়; আকাশের সেটি আছে; প্রকৃতি, গ্রাম, গ্রামের মানুষ, ধান ক্ষেতের স্বর্গীয় সৌন্দর্য, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, নানান ধরণের পাখী, তাদের বাসা, বৃষ্টিস্নাত গ্রাম, রংধনুর অবর্ণনীয় নান্দনিকতা, কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহর, আগুন জ্বালিয়ে মানুষের উষ্ণ বোধ করার তাগিদ, রাত জেগে নানী দাদীর মুখে অসাধারণ স্বব গল্প শুনে বেড়ে উঠা, গাছে উঠে পেয়ারা পেড়ে আনা, কবুতর পোষা, বককে পোষ মানানোর চেষ্টা, বাসা খুঁজে ঘুঘু ধরার তীব্র বাসনা ইত্যাদি ছোট ছোট কিন্তু সহস্র ভালোলাগাময় মুহূর্তই আকাশের শিশুকালটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে!
আজ আকাশ একটি সূর্যের মতই তার মেধার আলো ছড়াচ্ছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তার নাম লোকে জানে। নানান দেশের মানুষ তার লেখা পড়ছে, প্রশংসা করছে। আজ আকাশের খ্যাতি দেখে তার মাতা পিতার মাথা হিমালয়ের মত উঁচু হয়ে যায়! আকাশ সৃষ্টিকর্তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে তিনি না চাইলে আকাশ এতটা বিখ্যাত মানুষ হতে পারত না।
মানুষ ইহজগতে তার নামটি অমর করতে চায়। তাইতো সবাই খ্যাতির পেছনে পাগলা ঘোড়ার মত ছোটে। কিন্তু আকাশ খ্যাতির পেছনে কখনও ছোটেনি; সে ছুটেছে সাফল্যের পেছনে। কারণ সে জানে যে খ্যাতি হয়তো নামযশ ইত্যাদি এনে দেয় কিন্তু সফলতা একটি জিনিস এনে দেয় যা হচ্ছে ‘মানসিক প্রশান্তি’!
আজ আকাশ তৃপ্ত, সে স্বর্গীয় স্বস্তি অনুভব করে। সে চায় যাতে লেখালেখির মাধ্যমে সে আরও বেশী করে সমাজের উপকারে আসতে পারে। বৃষ্টি যেমন সকল ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে দেয়, ঠিক তেমনই আকাশের লেখালেখি, তার সৃষ্টিকর্ম সমাজ হতে সকল কুসংস্কার দূর করবে এটাই তার আশা, এটাই তার স্বপ্ন!